ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

অনুবাদ : এনামুল হক

আরেক সবুজ বিপ্লবের হাতছানি

প্রকাশিত: ০৬:৩৬, ১৪ নভেম্বর ২০১৪

আরেক সবুজ বিপ্লবের হাতছানি

জাতিসংঘের পূর্বাভাস অনুযায়ী ২০৫০ সাল নাগাদ বিশ্বের জনসংখ্যা ২শ’ কোটিরও বেশি বাড়বে। অর্থাৎ এখনকার ৭শ’ কোটির জায়গায় তখন ৯শ’ কোটি হবে। এখন যে পরিমাণ খাদ্যোৎপাদন হচ্ছে তাতে মাঝে মধ্যে টানাটানি হলেও ৭শ’ কোটি মানুষের মোটামুটি চলে যাচ্ছে। কিন্তু জনসংখ্যা যখন ৯শ’ কোটি হবে তখন বাড়তি জনসংখ্যার অন্নসংস্থান কিভাবে হবে? খাদ্য উৎপাদন কি সেই অনুপাতে বাড়ানো যাবে? ফিলিপিন্সের আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটে (আইআরআরআই) একই ধরনের গবেষণা কাজের পরিণতিতে অধিক ফলনশীল জাতের ধান উদ্ভাবিত হয়। ষাটের দশক থেকে নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত এশিয়ার ধান গমের উৎপাদন দ্বিগুণ হয়। এ সময় মহাদেশের জনসংখ্যা ৬০ শতাংশ বাড়লেও খাদ্যশস্যের দাম হ্রাস পায়। এশিয়ার গড় মানুষের ‘ক্যালরি গ্রহণ বাড়ে প্রায় এক-তৃতীয়াংশ। দারিদ্র্যের হার অর্ধেক হ্রাস পায়। ২০৫০ সাল নাগাদ যে ২শ’ কোটি লোক বাড়বে তার অর্ধেকের জন্ম হবে আফ্রিকার সাহারা সন্নিহিত অঞ্চলে এবং ৩০ শতাংশের জন্ম হবে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায়। এসব অঞ্চল আবার জলবায়ু পরিবর্তনে সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্ত হবার আশঙ্কা আছে। ঠিক এই কারণে ইতোমধ্যে বিশ্বে খাদ্য সরবরাহ মার খেয়েছে। গত ২০ বছরে ধান, গম, ভুট্টার উৎপাদন বাড়লেও বৃদ্ধির হারে মন্থরতা দেখা দিয়েছে। আগের শতাব্দীতে খাদ্য সঙ্কটে কোটি কোটি লোকের মৃত্যু আশঙ্কা থাকলেও সবুজ বিপ্লবের সঙ্কট উতরে যাওয়া সম্ভব হয়েছে। চলতি শতাব্দীতে জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও জলবায়ুর বিরূপ প্রভাবে সেই সঙ্কট উঁকি দিলেও তা কাটাতে আরেক সবুজ বিপ্লবের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে কারোর দ্বিমত নেই। আমেরিকার মনসানটো কোম্পানি উদ্ভাবিত জিএম ফসল উৎপাদনে সাফল্য এনেছে আবার বিতর্কেরও কারণ ঘটিয়েছে। নব্বইয়ের দশকে প্রচলন শুরু হবার পর থেকে জিএম ফসল এ পর্যন্ত ২৮টি দেশে উৎপাদিত হচ্ছে। বিশ্বের ১১ শতাংশ আবাদযোগ্য জমিতে এর চাষ হচ্ছে। তার মধ্যে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রে অর্ধেক পরিমাণ ফসলী জমি। যুক্তরাষ্ট্রে উৎপাদিত প্রায় ৯০ শতাংশ ভুট্টা তুলা ও সয়াবিন হলো জিএম ফসল। অর্থাৎ এগুলোর জিন রূপান্তরিত। আমেরিকানরা প্রায় দুই দশক ধরে জিএম ফসল খেয়ে আসছে। এই ফসলের সমর্থকরা বলে যে ওই ফসল আবাদের কারণে যুক্তরাষ্ট্র শত শত কোটি ডলারের লোকসান থেকে বেঁচে গেছে। এগুলোর আবাদে পরিবেশের ক্ষতি না হয়ে বরং লাভই হয়েছে। মার্কিন কৃষি বিভাগের সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে যে বিটি ভুট্টা প্রচলনের পর থেকে ভুট্টার ক্ষেতে কীটনাশকের ব্যবহার ৯০ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। কেউ কেউ ফিলিপিন্সে আইআরআরআই-এর কর্মকা-ের প্রসঙ্গ টেনে আনে। তারা ধান গবেষণায় সংস্থার সাফল্যের দৃষ্টান্ত দিয়ে বলে যে এশিয়ায় ইতোমধ্যে নতুন সবুজ বিপ্লব শুরু হয়ে গেছে। উদ্ভাবিত হয়েছে ইন্ডিয়া রাইস বা আইআর ৮ নামে এক আশ্চর্য ধান। তাইওয়ানের বামন জাতের ধান গাছ আর ইন্দোনেশিয়ার লম্বা জাতের ধান গাছের ক্রসব্রিডিং করে উদ্ভাবিত এই ধান দ্রুত বর্ধনশীল ও উচ্চ ফলনশীল। এতে এশিয়ায় ধান উৎপাদনে বিপ্লব ঘটছে। এই ধানের উদ্ভাবক আইআরআরআই সংস্থাটি প্রতি বছর নতুন কয়েক ডজন জাতের ধান বাজারে ছাড়ে। ষাটের দশক থেকে সারা বিশ্বে এদের প্রায় এক হাজার জাতের ধান আবাদ করা হয়েছে। ফলন বেড়েছে বছরে এক শতাংশের সামান্য নিচে। এই হার ২ শতাংশে উন্নীত করার চেষ্টা চলছে। বলাবাহুল্য বিশ্বে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার এখন বছরে ১.১৪ শতাংশ। ২০৫০ সাল নাগাদ তা ০.৫ শতাংশে নেমে আসবে। কাজেই ২ শতাংশ হারে খাদ্যোৎপাদন বাড়লে সমস্যা হবে না। শুধু জনসংখ্যা বৃদ্ধি নয়, বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া যেমন খরা, বন্যা, লবণাক্ততা বৃদ্ধি প্রভৃতি সমস্যা মাথায় রেখে আইআরআরআই সে ধরনের ধানও উদ্ভাবন করেছে। ইতোমধ্যে খরাসহন জাতের ধান বের হয়েছে যা শুকনো মাটিতে লাগানো যায়। ভুট্টা ও গমের মতো এই ধান শুধু বৃষ্টিনির্ভর। তাছাড়া বেরিয়েছে লবণাক্ততাসহন ধান যা বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলীয় এলাকার জন্য বিশেষ উপযোগী। তবে আইআরআরআইয়ের গুটিকয়েক জাতের ধান হচ্ছে জিএম ফসল। সেটা এই অর্থে যে ওগুলোতে আছে ভিন্ন প্রজাতি থেকে স্থানান্তরিত করা জিন। এমনি এক ধানের নাম গোল্ডেন রাইস। ওতে আছে ভুট্টা থেকে নিয়ে আসা এমন এক জিন যার বদৌলতে ঐ ধান বিটা ক্যারোটিন তৈরি করতে পারে যার কাজ ভিটামিন ‘এ’-এর ঘাটতি দূর করা। বেশ কয়েক দশক ধরে সংস্থার বিজ্ঞানীরা জিনেটিক রূপান্তরের সেই প্রাচীন সূত্রটি অনুসরণ করে এসেছেন। সেটা হলো কাক্সিক্ষত বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন উদ্ভিদ নির্বাচন। তারপর সঙ্কর প্রজনন। চারাগাছ পূর্ণতা অর্জন করতে দেয়া। তারপর সর্বোত্তম ফলন কোনগুলো থেকে পাওয়া যায় তা দেখে বেছে নেয়া এবং তারপর একই প্রক্রিয়া বার বার চালাতে থাকা। এখন সেই কষ্টকর ও দীর্ঘস্থায়ী প্রক্রিয়ার বিকল্প বের হয়েছে। উন্মোচিত হয়েছে ধানের গোটা জিনম। চিহ্নিত হয়েছে প্রায় ৪০ হাজার জিন। ফলে গবেষকদের পক্ষে এখন সেই সব জিন বেছে নেয়ার কাজ সহজতর হয়েছে যেগুলো ধারণ করে আছে মূল্যবান বৈশিষ্ট্য। যেমন ২০০৬ সালে পূর্ব ভারতীয় এক জাতের ধান থেকে সাব-১ নামে একটি জিন বিচ্ছিন্ন করা হয়। ফলন খুব কম বলে এই জাতের ধান কদাচিৎ আবাদ করা হয়। তবে এর এক অসাধারণ বৈশিষ্ট্য হলো এই ধান দু’সপ্তাহ পানির নিচে বেঁচে থাকতে পারে। বেশিরভাগ জাতের ধান তিন দিন পানিতে থাকার পর মরে যায়। আইআরআরআইয়ের গবেষকরা ঐ ধানের সঙ্গে ভারত ও বাংলাদেশে বহুল জনপ্রিয় স্বর্ণা নামের অধিক ফলনশীল জাতের ধানের সঙ্কর প্রজনন ঘটিয়ে স্বর্ণা সাব-১ নামের নতুন জাতের বন্যাসহন ধান উদ্ভাবন করেছেন। এই ধান এখন এশিয়ার ৪০ লাখ কৃষক আবাদ করছে। বলাবাহুল্য প্রতিবছর বন্যায় এশিয়ায় ৫ কোটি একর জমির ধান নষ্ট হয়। এই ধান বন্যায় নষ্ট হবার আশঙ্কা নেই। তবে প্রতিষ্ঠানটির অতি উচ্চাভিলাষী একটি প্রকল্প আছে যার কাছে এসব সাফল্য কিছুই না। ওই প্রকল্পটি সফল হলে ধানের আমূল পরিবর্তন ঘটে যাবে এবং উৎপাদনও নাটকীয়ভাবে বাড়বে। কিভাবে? দেখা গেছে ধান, গম ও আরও অনেক উদ্ভিদ সি-৩ নামে এক ধরনের ফটোসিন্থেসিস বা আলোক সংশ্লেষণকে কাজে লাগায়। সি-৩ হলো তিনটি কার্বনের যৌগ। সূর্য কিরণ শোষিত হবার সময় এগুলো তৈরি হয়। ভুট্টা, আখ ও অন্যান্য উদ্ভিদ সি-৪ আলোক সংশ্লেষণকে কাজে লাগায়। সি-৩ ফসলের তুলনায় সি-৪ ফসলে অনেক কম পানি ও নাইট্রোজেনের প্রয়োজন হয় এবং অন্যদিকে উৎপাদন বেশি হয় ৫০ শতাংশ। আইআরআরআইয়ের ওই প্রকল্পের লক্ষ্য হচ্ছে ধানের নিজস্ব জিনের পরিবর্তন ঘটিয়ে একে সি-৪ ফসলে রূপান্তরিত করা ও তার পূর্ণ সুফল নেয়া। স্বর্ণা সাব-১ এর মতো বন্যাসহন ধান একটি জিন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। আর সি-৪ শুধু একটি নয় অনেক জিন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। সেজন্য এই বৈশিষ্ট্য চালু করা অত সহজ নয়। তবে বর্তমানে এক জাতের ঘাষের ওপর সি-৪ নিয়ে পরীক্ষা চলছে। সাফল্য অনেকটা এসেছে পুরো সাফল্য পাওয়া গেলে তা ধানের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হবে। তবে তার জন্য আরও ১১/১২ বছর লেগে যেতে পারে। শুধু কি ধান গম? টমেটোর মতো সবজির কথাই ধরুন না! বিজ্ঞান সেখানেও সাধনা করে চলেছে। টমেটো হয় উষ্ণ ও শুষ্ক আবহাওয়ায় এবং প্রচুর পরিমাণ সেচের পানি প্রয়োজন। গড়ে এক একটি টমেটোর পেছনে ১৩ গ্যালনেরও বেশি। গবেষকরা এখন টমেটো গাছের সঙ্গে বিশ্বের শুষ্কতম স্থানের অন্যতম পেরুর আটাকামা মুরুর একটি বুনো জাতের টমেটো গাছের সঙ্কর প্রজনন ঘটিয়ে এমন এক নতুন জাত উদ্ভাবনের চেষ্টা করছেন যা অনেক কম পানি খাবে। এইভাবে বিজ্ঞানের অগ্রগতি বিশেষ করে জিনপ্রযুক্তি কৃষিক্ষেত্রে নতুন বিপ্লবের সম্ভাবনা নিয়ে এসেছে। কৃষি বিপ্লবের আরেক মতের প্রবক্তা অর্গানিক চাষাবাদের অনুসারীরা বলে জিন রূপান্তরিত ফসল মানব দেহের জন্য নিরাপদ নয়। এই ফসল ব্যয়বহুল। সুতরাং আগামী দিনের খাদ্য সংস্থান নিয়ে সম্ভবত দুশ্চিন্তার তেমন কারণ নেই। বিজ্ঞানের বদৌলতে আজ কৃষিক্ষেত্রে যে অপার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে তাতে ভবিষ্যতে খাদ্যসঙ্কট সহজেই কাটিয়ে ওঠা যাবে। সূত্র : ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক
×