ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

ওয়াহিদ নবি

আমাদের কিছু চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য

প্রকাশিত: ০৬:৩৫, ১৪ নভেম্বর ২০১৪

আমাদের কিছু চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য

ইতিহাসবিদ মুনতাসীর মামুন দৈনিক জনকণ্ঠে ‘এক পাকি দণ্ডিত লক্ষ পাকি বর্তমান’ শিরোনামে একটি ধারাবাহিক প্রবন্ধ লিখেছেন। ৪ নবেম্বর এর শেষ অংশ প্রকাশিত হয়েছে। এই অংশটিকে উপসংহার বলা যেতে পারে। আমাদের জাতির ইতিহাসের কয়েকটি ঘটনার উল্লেখ করেছেন তিনি। এ ঘটনাগুলো পড়লে জাতি হিসেবে আমাদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের পরিচয় মেলে। ঘটনাগুলো হৃদয়বিদারক। এগুলো যে কোন সচেতন মানুষের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ ঘটাবে। মুনতাসীর মামুনেরও হৃদয়ে রক্তক্ষরণ ঘটেছে নিশ্চয়। তাই হয়ত এ সব ঘটনার বা আমাদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের কারণ আলোচনা করেননি তিনি বা বিস্তারিত কিছু লেখেননি। কিন্তু জাতি হিসেবে আমাদের উচিত হবে এ সব ঘটনা সম্বন্ধে অবহিত হওয়া, ঘটনাগুলোর কারণ জানা এবং আমাদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য জানবার চেষ্টা করা। সব জাতির মধ্যে কিছু বৈশিষ্ট্য থাকে যেগুলো না থাকলেই ভাল হতো। যেহেতু আমরা চাই আমরা জাতি হিসেবে উন্নততর হব, তাই এগুলো পরিহার করবার চেষ্টা করা উচিত। এ জন্য প্রথমেই উচিত এগুলো সম্বন্ধে সজাগ হওয়া। আমাদের কিছু মিথ্যা অহঙ্কার আমাদের অগ্রগতিতে বাধার সৃষ্টি করে। জাতীয় জীবনেও এ কথা সত্য। মুনতাসীর মামুন উল্লেখ করেছেন যে, বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পর তাঁর জানাজা হয়নি। তাঁকে সমাহিত করা হয়েছে মফস্বলে, যাতে সেখানে বেশি মানুষ যেতে না পারে। তিনি আমাদের জাতির জনক। জাতির প্রত্যেকটি মানুষের অধিকার রয়েছে তাঁকে সম্মান করবার। সত্য কথা এই যে, তাঁর জন্মস্থান বলেই যে তাঁকে টুঙ্গিপাড়ায় সমাহিত করা হয়েছে তা নয়। কোথায় তাঁকে সমাহিত করা হবে সে সম্বন্ধে তিনি কোন ইচ্ছা প্রকাশ করবার সুযোগ পাননি। তাঁর পরিবারের কাউকেই এ ব্যাপারে জিজ্ঞেস করা হয়নি। একবার সমাহিত হলে সেই মৃতদেহ স্থানান্তর করা আমাদের ধর্মে স্বীকৃত নয়। কিন্তু বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ মতিউর রহমানের সমাধি স্থানান্তরিত করা হয়েছিল, তাতে কেউ কোন আপত্তি করেননি এ জন্য যে একটা অস্বাভাবিক অবস্থায় তাঁকে প্রথমে সমাহিত করা হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর বেলায়ও একই কথা বলা চলে। যেহেতু ধর্মের নাম করে বলা হয়েছে তাই আমরা সবাই চুপ করে গেছি। আমাদের স্ববিরোধী মনোভাবের আর এক প্রমাণ জিয়াউর রহমানের সমাধি। তার মৃতদেহ অন্যত্র সমাহিত করা হয়েছিল। প্রশ্ন, ধর্মে মানা থাকলেও তার মৃতদেহ স্থানান্তর করা হলো কেন? কিছু হলেই ‘জিয়ার মাজারে’ তার সমর্থকরা সমবেত হন। আর জাতির পিতার সমাধি থেকে যায় লোকচক্ষুর অন্তরালে। এই তিনটি সমাধির কথা মনে হলেই মনে হয় যে ধর্মের নাম করে সময়মতো কেউ কিছু বললেই আমরা চুপ করে যাই। অবশ্য এটাই কাহিনীর সবটুকু নয়। কোন দেশের সেনাবাহিনী ক্ষমতা দখল করলে ব্যাপারটা এমন ভয়াবহ হয় যে, সাধারণ মানুষের পক্ষে প্রতিবাদ করা দুঃসাধ্য হয়ে পড়ে। এটা সব দেশেই হয়েছে। তারা বিদেশী শক্তির সাহায্যে ক্ষেত্র তৈরি করে নেয়। ডেভিড হেবডিচ ও কেন কোনর রচিত ‘হাউ টু স্টেজ এ মিলিটারি ক্যু’ ও এডোয়ার্ড লাটওয়াক রচিত ‘ক্যু দে-তা এ প্র্যাক্টিক্যাল হ্যান্ডবুক’ বই দুটি পড়লে এ সব বিষয়ে জানা যায়। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর তাঁর সমাধি সম্পর্কে কিছু বলা সম্ভব ছিল না জনগণের পক্ষে। অন্যদিকে জিয়া হত্যার পর ক্ষমতা দখলের পরিকল্পনার অংশ হিসেবে বিশাল আকারের প্রচারকার্য চালানো হয়। জনমনে সস্তা আবেগ সৃষ্টি করা হয়। জিয়াউর রহমান স্বাধীনতার আদর্শকে ভূলুণ্ঠিত করে দেশকে পশ্চাদমুখী অবস্থানে নিয়ে যান। স্বাধীনতার শত্রুদের পুনর্বাসিত করেন। এ সব ঢাকা দেয়ার জন্য জোরেশোরে তার ব্যক্তিগত সাধুতার প্রচার চলে। হায়রে আমাদের নিয়তি! ছেঁড়া গেঞ্জি আর ভাঙ্গা বাক্সের জন্য জিয়াউর রহমান প্রশংসিত হন, আবার সম্পদের প্রাচুর্যের জন্য তার পরিবার প্রশংসিত হয়। প্রশ্নটা হচ্ছে এই যে, তার এবং তার দলের শাসন এত ভাল হলে আরেক সেনাকর্তা অতি সহজে ক্ষমতা দখল করেন কিভাবে? এ সব খেলা আমাদের বুঝতে তো অসুবিধা হবার কথা নয়। এক সেনাকর্তা সংবিধান পরিবর্তন করেন স্বাধীনতাবিরোধীদের স্বার্থেÑ আরেকজন রাষ্ট্রধর্ম নিয়ে খেলা করেন। এদের ব্যক্তিগত জীবনে ধর্মের কোন বালাই নেইÑএ কথাটা আমরা বুঝি না কেন? আসলে আমরা যুক্তিবুদ্ধির চেয়ে অকারণ ভীতির দ্বারা পরিচালিত হই বেশি। ছেঁড়া গেঞ্জি, ভাঙ্গা বাক্স আর স্বাধীনতার ঘোষক এ সব একই সূত্রে গাথা। একজন সম্পূর্ণ অপরিচিত সাধারণ মেজরের ডাকে কোন জাতি স্বাধীনতা সংগ্রামে নামে না, এটুকু বুঝবার মতো বুদ্ধি আমাদের নেইÑএ কথা বিশ্বাস করা শক্ত। কারও কারও মতে, গোলাম আযমের পোশাক নাকি পুণ্যের প্রতীক! ফ্রেডরিক নিচির অমর বাক্যÑ মানুষের স্মৃতিশক্তি ক্ষণস্থায়ী। সম্ভবত অনেকেই গোলামের একাত্তরের কীর্তিকলাপের কথা ভুলে গেছে। মনে আছে পরকালের কথা। তাই হয়ত বায়তুল মোকাররমে তার জানাজায় অনেক মানুষের সমাগম। সাঈদীর ওয়াজের ক্যাসেট বিক্রি, তার মুখ চাঁদে দেখা গিয়েছিল শুনে মিছিল আর পাওয়ার হাউস পোড়ানোÑ নিশ্চয়ই আমাদের বড় গলদ আছে। এ সব নিয়ে চিন্তা করা উচিত। স্বাধীনতার বিপক্ষের শক্তিকে অবশ্যই নিন্দা করতে হবে। কিন্তু স্বাধীনতার পক্ষের কেউ অনুচিত কিছু করলে আমাদের দৃষ্টি অন্যদিকে ফিরিয়ে রাখলে চলবে না। আমাদের অতীতের সংগ্রামী ছাত্রসমাজ আর আজকের টেন্ডারবাজ ছাত্রসমাজÑ তুলনা করলে অনুভব করি, আমরা কোথায় অবস্থান করছি? আসলে প্রশাসনকে রাজনীতিমুক্ত রাখাই সবার জন্য মঙ্গল। যে অপরাধ করবে তাকে শাস্তি পেতে হবে। এই হোক স্বাধীনতার পক্ষের সেøাগান। লেখক : রয়্যাল কলেজ অব সাইকিয়ার্ট্রিস্টের ফেলো
×