ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

অজয় রায়

বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি ॥ বিশুদ্ধ চিত্তের মানুষ জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী

প্রকাশিত: ০৬:৩৪, ১৪ নভেম্বর ২০১৪

বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি ॥ বিশুদ্ধ চিত্তের মানুষ জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী

আজ বুধবার ১২ নবেম্বর, ২০১৪। সময় সকাল ১০-৩০। সবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বিজ্ঞান গ্রন্থাগার চত্বরে অবস্থিত ‘বিজ্ঞান গবেষণা উন্নয়ন কেন্দ্রে’ আমার কক্ষে উপবেশন করেছি, তখনই আমার এক সাংবাদিক বন্ধু টেলিফোনে জানালেন যে আমাদের সকলের প্রিয়ভাজন এবং শ্রদ্ধেয় জ্ঞানতাপস অধ্যাপক জিল্লুর রহমান আর নেই। ইহলোকের সকল মায়া কাটিয়ে বন্ধন ছিন্ন করে এক অজানা লোকে যাত্রা করেছেনÑ যেখান থেকে কেউ আর ফিরে আসে না। এই অজানা লোককে নানাজন নানাভাবে প্রকাশ করেছেন। ইসলাম ধর্মের মতে বলা হয় ‘তিনি জান্নাতবাসী হয়েছেন’ এবং পুণ্যবান হলে আল্লাহ তায়ালার সান্নিধ্য লাভ করে শান্তিতে থাকবেন। জান্নাতে গিয়েই আমরা তার অস্তিত্ব অনুভব করতে সক্ষম হব এবং তখনই হয়ত সদ্য প্রয়াত এই প্রিয় মানুষটিকে আরও অনেক পুণ্যবান মানুষের সঙ্গে দেখা হতে পারে। হিন্দু মিথোলজি অনুসারে মৃত ব্যক্তি গোলকধামে বাস করেন। ঠিক দেহধারী যে মানুষটি ইহলোকে যেভাবে আমাদের কাছে দোদীপ্যমান ছিলেন, ঠিক সেভাবে নয় অশরীরী পবিত্র আত্মারূপে সেখানে তিনি অস্তিত্বমান। ইসলাম এবং খ্রিস্টধর্ম মতে একটি শেষ বিচারের দিন আছে। সেইদিনে আল্লাহ তায়ালা বা বাইবেলের ঈশ্বর সকল মানুষ অশরীরী রূপে তার সম্মুখে উপস্থিত হবেন। পাপপুণ্যের হিসাব-নিকাশের পর আমাদের অবস্থান হবে বেহেস্তে বা দোজখে। যাঁরা বেহেস্তে যাবেন এবং মহাসুখে, যা ইহজগতে কাক্সিক্ষত ছিল, কিন্তু পাওয়া যায়নি তার সবই সেখানে লভ্য। এ সম্পর্কে চমৎকার বর্ণনা আছে মোটামুটি সকল পবিত্র ধর্মগ্রন্থে। আমরা ফিরে আসি ইহলোকের জ্ঞানী ও প্রিয় মনুষটি অধ্যাপক জিল্লুর রহমান প্রসঙ্গে। শুধু জ্ঞানী নন, তিনি আমাদের সাহিত্য-সংস্কৃতি-সমাজের নানা ক্ষেত্রে দৃপ্ত পদচারণা করেছেন। ছিলেন অসাধরণ কবি, তাঁর কবিতার ঈর্ষণীয় শব্দচয়ন, বাক্য বিন্যাস আমাদের চমৎকৃত করে, ছিলেন কথাসাহিত্যিক, সৃষ্টিশীল প্রবন্ধকার। তিনি ছিলেন সুলেখক এবং অনুসুন্ধিৎসু শিক্ষাবিদ। শিক্ষার মানের ক্রম-অবনতিতে তিনি মূহ্যমান হতেন। আপাতদৃষ্টিতে বিভিন্ন পাবলিক পরীক্ষায় আপাত চমক দেয়া ফলাফলে তিনি মোটেই সন্তুষ্ট হতে পারেননি। তখনই তিনি কলম ধরতেন প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত সকলস্তরে কিভাবে শিক্ষার মানে উন্নতি আনা যায়। তিনি শিক্ষাপ্রদায়ী প্রতিষ্ঠানগুলোর মান ও কার্যক্ষমতায় সন্তুষ্ট ছিলেন না। নিজে ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অব্যবস্থাপনা ও মানের অবনতি তাঁকে শঙ্কিত করে তুলত। তিনি উচ্চশিক্ষার আনুভূমিক প্রসারের বিরোধী ছিলেন না, তত্ত্বীয়ভাবে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের তাই বিরোধিতা করেননি। কিন্তু একইসঙ্গে সোচ্চার ছিলেন এসব উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যেন মেধা ও মানসম্পন্ন শিক্ষক নিযুক্ত হয়, শিক্ষাকর্মসূচী যেন বাস্তবমুখী ও উন্নতমানসম্পন্ন হয় আন্তর্জাতিক মাত্রাকে মাথায় রেখে যেন থাকে বিজ্ঞানসহ সকল জ্ঞানের শৃঙ্খলায় গবেষণার সুযোগ ও পরিবেশ। তিনি অনেকদিন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজী বিভাগে অধ্যাপক হিসেবে শিক্ষকতা করেছেন, সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চা ও অনুশীলন। সমমনা সহকর্মীদের সঙ্গে রাজশাহী থেকে প্রকাশ করেছেন চমৎকার একটি মাসিক পত্রিকা। এক কথায় তিনি রাজশাহীর সংস্কৃতি-জগতের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। রাজশাহী ছেড়ে এক সময় তিনি চলে এসেছেন। যোগদান করেছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজীর অধ্যাপক হিসেবে। পরে অলঙ্কৃত করেছেন উপাচার্যের পদকে। এক সময় সাভারস্থ গণবিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যপদেও অধিষ্ঠিত ছিলেন। কিন্তু একইসঙ্গে অব্যাহত রেখেছিলেন সাহিত্য ও সংস্কৃতিচর্চা। এই নানা মাত্রিক কর্মতৎপরতা প্রমাণ করে যে তিনি বিচ্ছিন্নভাবে বিশুদ্ধ সংস্কৃতি-সাহিত্যের ক্ষেত্রে নিজেকে গ-িবদ্ধ রাখেননি। তিনি ছিলেন প্রকৃত অর্থেই কর্মবীর। নানা বিচিত্র ক্ষেত্রে তিনি অবদান রেখেছেন। মানবাধিকার রক্ষায় তিনি ছিলেন সতত উচ্চকণ্ঠ। এমনকি সংবাদপত্রের কলামিস্ট হিসেবেও অনেক পেশাজীবী সাংবাদিককে অতিক্রম করে গেছেন। তাঁর কলামগুলোতে থাকত সমকালীন নানা সমস্যার আলোচনা এবং বিশ্লেষণ, আর ছিল উত্তরণের নির্দেশনা। চেতনা-চিন্তায় আপাদমস্তক ধর্মনিরপেক্ষ যাকে আমরা ইংরেজিতে বলি সেক্যুলারিস্ট আর উদারনৈতিক গণতন্ত্রে বিশ্বাসী। এমনই ছিলেন আমার প্রিয় ও শ্রদ্ধেয় জিল্লুর ভাই যাঁর ¯েœহধন্যে অমি আপ্লুত। তাঁর বন্ধুবৃত্ত অনেক জ্ঞানী-গুণী মাানুষের সমাবেশে গড়ে উঠেছেÑ মোস্তাফা নূরউল ইসলাম, প্রয়াত ইতিহাসবিদ সালাউদ্দিন আহমেদ, ফজলুল হালিম চৌধুরী, মমতাজুর রহমান তরফদার প্রমুখ এই বৃত্তে প্রবেশের অধিকার পেয়েছি। বিশেষ করে অধ্যাপক জিল্লুর রহমানের ¯েœহ-স্পর্শ পেয়েছি। আমি সত্যি ধন্য। জয়তু জিল্লুর রহমান। আপনাকে সশ্রদ্ধ প্রণাম। লেখক পরিচিতি : অধ্যাপক অজয় রায় ৪০ বছরের অধিক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করে অবসর জীবনযাপন করছেন। পদার্থবিজ্ঞান তাঁর অধ্যয়ন ও গবেষণার ক্ষেত্র। বিশিষ্ট বিজ্ঞানী ও শিক্ষাবিদ হিসেবে সুপরিচিত। সুলেখক ও বিশিষ্ট প্রবন্ধকার এবং সংবাদপত্র কলামিস্ট। জ্ঞান-বিজ্ঞানের নানা ক্ষেত্রে তাঁর পদচারণা। সবার উপরে তিনি মানবহিতৈষী ও মানবতাবাদী।
×