ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ব্রিকস প্রতিদ্বন্দ্বী না সম্পূরক বিকল্প?

প্রকাশিত: ০৪:৪১, ১৩ নভেম্বর ২০১৪

ব্রিকস প্রতিদ্বন্দ্বী না সম্পূরক বিকল্প?

২০১৪ সালের জুলাই মাসে ব্রিকস দেশগুলো তাদের ষষ্ঠ সামিটে ‘অভিনব উন্নয়ন ব্যাংক’ (এনডিবি =নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক) প্রতিষ্ঠা করে। অবশেষে এনডিবি প্রাতিষ্ঠানিক ‘এনটিটি’ পায়, বহু জল্পনা-কল্পনারও অবসান ঘটে। ১০০ বিলিয়ন ডলার মূল্যের ব্রিকস-ব্যাংকের রিজার্ভ-কারেন্সি পুলের পরিমাণও ১০০ বিলিয়ন ডলার! এনডিবিকে আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিলের বিকল্প ব্যবস্থা বলা যায়। আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল ‘ব্রেটন উডস কনফারেন্সে’র (নিক্সন-শকের মাধ্যমে বিলুপ্তপ্রাপ্ত) সংস্থাপন একটি। কিন্তু সংস্থাটির কাঠামোগত ফন্দিফিকির, ঋণ ও সাহায্য গ্রহীতাকে কতটুকু পরিমাণে নিজের পায়ে দাঁড়াতে সাহায্য করছে ইত্যাদি ইত্যাদি বিষয়ে ঘনীভূত সন্দেহ ও অসন্তোষ অনেক দিনের। ব্রিকসের দেশগুলো তাই আইএমএফ তো বটেই, বিশ্বব্যাংকেরও সংস্কারের দাবি করে আসছিল অনেকদিন ধরেই। ইউরো-আটলান্টিক শক্তিও মাথা নেড়ে সায় দেয় ঠিকই, কিন্তু ২০১০ সালে মার্কিন কংগ্রেসে সংস্কার বিষয়ক বিলটি খারিজ হয়ে যায়। ফলে, সংস্থা দুটোর সংস্কার বিষয়টিও ধামাচাপার দলে চলে যায়। এরও আগে, ২০০৮ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাব-প্রাইম মর্টগেজ স্ক্যান্ডাল, ইউরো-আটলান্টিক অর্থ-ব্যবস্থায় যে ধস নিয়ে আসে, তারই পরিণতিতে আইএমএফকে অথর্ব ইউরো-জোনের অর্থনৈতিক স্বাস্থ্য উদ্ধারে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়তে হয়। অদ্যাবধি এই অবস্থা বিদ্যমান। তারপর যুক্ত হয় ইউক্রেন। ফলে, নিকট ভবিষ্যতে অবসন্ন আইএমএফ-সংস্কারের আশায় বালি। ব্রিকস-ব্যাংকের তাই বিশ্বীয় আর্থ ম্যানেজমেন্টের ঝঞ্ঝাটময়, বেগোছালো অবস্থার প্রতি প্রেরিত সিগন্যাল বলা যায় অনায়াসে। ব্যাংকটি মূলত সদস্য দেশগুলোর জন্য হলেও, অসদস্য দেশগুলোর ইনফ্রাস্ট্রাকচার প্রজেক্টেও অর্থ বিনিয়োগ করবে বলেও মনে করা যায়। কারণ, দক্ষিণ আমেরিকার দেশগুলো নিয়ে গঠিত ‘ইউনিয়ন অব সাউথ আমেরিকান নেশনসের’ সঙ্গে ব্রিকসের সম্পর্ক খুবই নিকটের এবং ব্রাজিল সামিটের সময়, পেরুর প্রশান্ত মহাসাগরীয় উপকূল থেকে ব্রাজিলের আটলান্টিক মহাসাগরীয় উপকূল পর্যন্ত সুবিস্তৃত রেলপথটি অবশেষে বাস্তবায়নের সম্ভাবনাও খুবই বেড়ে গেছে। এই সুবৃহৎ ট্রান্সকন্টিনেন্টাল রেলপথের ডিজাইন, নির্মাণ ও পরিচালনার জন্য ব্রাজিল-পেরু-চীন ওয়ার্কিং গ্রুপও একটি গঠিত হয়েছে। ব্রিকস-ব্যাংকের হেড অফিস থাকছে সাংহাইয়ে (সাংহাই কো-অপারেশন সংস্থাও এখানেই)। ব্যাংকের জীবনের প্রথম পাঁচটি বছর পরিচালনার দায় ভারতের; তারপরে নেতৃত্ব নেবে ব্রাজিল ও রাশিয়া; চীনের পালা আসবে একেবারে শেষে। ইউরো-আটলান্টিকের প্রবল প্রভাবাধীন আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকের অভিজ্ঞতা, এশিয়া ও আফ্রিকার যেসব দেশের রয়েছে, তাদের কাছে বিকল্প হিসেবে ব্রিকসের এনডিবি আকর্ষণীয় হতে বাধ্য। বিগত কয়েক বছর থেকে আইএমএফের ভূমিকায় অন্য মেজাজ আরও প্রকট হয়ে উঠতে থাকে। যেমন : ইউরোজোনের আর্থ-বিপর্যয়, একদিকে যেমন আইএমএফের সমস্ত উদ্যোগ ও মনোযোগ মূলত ইইউ-র ‘রেস্ক্যু’ কর্মে নিয়োজিত হয়, অপরদিকে বিশ্বীয় ঘটনাবলীর পরিপ্রেক্ষিতে আইএমএফ বাংলাদেশসহ অপেক্ষাকৃত কম উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য বিবিধ ধরনের ঋণের ও ধারকর্জের এমন সব নিয়মকানুনের কঠিন বেড়াজাল বেঁধে দিচ্ছে যে, দেশগুলোর পক্ষে স্বাধীনভাবে উন্নয়ন প্রকল্প অব্যাহত না রাখতে পারার স্বাধীনতা ঊর্ধŸমুখীর দিকে যাচ্ছে। যেমন : আইএমএফের তরফ থেকে ঋণের সর্বোচ্চ সীমা বেঁধে দেয়ার কারণে সংশ্লিষ্ট দেশের পক্ষে অতিরিক্ত ঋণ বা ধারকর্জ করা অসম্ভবের দলে পড়ে। আবার কখনওবা বহিস্থ অন্য উৎস থেকে ঋণ করলেও (যে ক্ষেত্রে আইএমএফ সরাসরি জড়িত নয়, যেমন : চীন বা রাশিয়া), সেই ঋণের সর্বোচ্চ সীমা বেঁধে দেয়ার এবং সমস্ত বহিস্থ ঋণ মনিটরিংয়ের শর্তাবলী আরোপের চেষ্টা করে থাকে আইএমএফ। এমতাবস্থায়, বাংলাদেশসহ সমপর্যায়ের দেশগুলোর জন্য ব্রিকস-ব্যাংক এবং দিনকয় আগে (অক্টোবর ২৪, ২০১৪) ঘোষিত এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক (এআইআইবি) নতুন আশার আলোকবর্তিকাস্বরূপ। তবে শত ইচ্ছা থাকলেও ব্রিকস-ব্যাংকে যোগ দিতে হলে পূর্বাবশ্যক কিছু গুণাবলী সংশ্লিষ্ট দেশকে থাকতে হবে, যাতে সে অন্যসব ব্রিকস দেশের সঙ্গে তালে তাল মিলিয়ে চলতে পারে। অর্থাৎ, মজবুত এবং দক্ষ কার্যকরী আর্থ-কাঠামো নামক বালিশের সাপোর্ট। কিন্তু আইএমএফ, বিশ্বব্যাংকসহ অধিভুক্ত সংস্থাগুলোর ঋণ, ধারকর্জ, সহায় সাহায্য এবং বুদ্ধিপরামর্শ মতো চলেও ‘বালিশের সাপোর্ট’ অর্জন করার মতো অবস্থায় কোন দেশই পৌঁছতে পারেনি। যেমন : বাংলাদেশের কথাই ধরা যাক। উন্নয়ন কর্মকা-ের নিউক্লিয়াস হল : ইনফ্রাস্ট্রাকচার, অর্থাৎ, রাস্তাঘাট, রেলপথ, নদীপথ, বন্দর, এবং জ্বালানির নিরাপত্তা। এগুলোর কোন একটিকে নিয়ে অন্তত গর্ব করার মতো পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ নেই। আবার, ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে ‘মধ্য আয়ের দেশে’ টেনে তোলার যে লক্ষ্য স্থির করা হয়েছে, সেটি অর্জনের জন্য বা অন্তত লক্ষ্যবস্তুতে পৌঁছবার পথকে প্রশস্ত করার প্রশ্নে জিডিপি বৃদ্ধির প্রসঙ্গ চলে আসছে। ফলে, ইনফ্রাস্ট্রাকচার চলে আসতে বাধ্য। তাই জিডিপি বৃদ্ধির প্রয়াসে ব্যক্তিগত মালিকাধীন বিনিয়োগকে প্রাধান্য দেয়ার বা কৃষিসহ নিত্যদিনের কিছু কিছু প্রয়োজনীয় পণ্যের ভর্তুকি তুলে নেয়ার চাপ বা প্রস্তাব প্রশ্নবিদ্ধ হতে বাধ্য। কারণ, আন্তর্জাতিক সংস্থার সাহায্যপুষ্ট সফল প্রোগ্রামগুলো সুসম এবং দীর্ঘমেয়াদি সুদূরপ্রসারী প্রভাব সৃষ্টি করতে যদি পারতই, তাহলে কিছুটা পরিমাণে বালিশের সাপোর্ট অর্জিত হতো। তা হয়নি। আইএমএফ, বিশ্বব্যাংক, এডিবি ইত্যাদি একাধিক উৎস থেকে সম্মিলিতভাবে উন্নয়ন-প্রকল্প খাতে যে সাইজের প্যাকেজ দেয়া হয়, তা দিয়ে চাহিদা পূরণ হয় না। যেমন : ২০১২-১৩ ফিস্কাল বছরে আইএমএফ, বিশ্বব্যাংক, এডিবি ইত্যাদি একাধিক উৎস সম্মিলিতভাবে উন্নয়ন-প্রকল্প খাতে মাত্র প্রায় ২.৭৮ বিলিয়ন ডলারের প্যাকেজ দেয়। অপরদিকে, বিভিন্ন ধরনের ইনফ্রাস্ট্রাকচার খাতে চীন যে কোটি কোটি ডলার ঋণ দিতে চায়, আইএমএফের আরোপিত ‘ঋণ গ্রহণের সর্বোচ্চ সীমা’র মারপ্যাঁচে বাংলাদেশ সুযোগটি নিতে পারে না। বাংলাদেশ ও সম লেভেলের দেশগুলোর জন্য পরিস্থিতি এমন যে, বিকল্প উপায় হিসেবে এআইআইবি তুলনাহীন ভূমিকা রাখতে পারে। এআইআইবিকে বিশ্বব্যাংকের বিকল্প বলা হচ্ছে, এর প্রধান পেট্রন চীন। বাংলাদেশসহ সাকুল্যে ২২টি দেশ এআইআইবির প্রতিষ্ঠা-সদস্য দেশের তালিকায় সই করেছে। ফলে, সরাসরি ব্রিকস-ব্যাংকভুক্ত হওয়া না গেলেও, ভবিষ্যতে একদিন হতেও পারে! কারণ, বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থাকে ১৯৮০-র দশকের চীনের সঙ্গে তুলনা করা যায়। তাই এআইআইবির অন্তর্ভুক্তি বাংলাদেশকে অর্থনৈতিক-রেনেসাঁ’র ইঞ্জিনে পরিণত করতে পারে। বর্তমানে পুরনো সিল্ক-রোড ও ভারত মহাসাগরের প্রাচীন বাণিজ্য-রুটের (যে রুটে মসলা ও মূল্যবান ধাতুর পরিবহন হতো) সর্বত্র চীনের উপস্থিতি লক্ষণীয়। যেমন : কারাকোরাম হাইওয়ের মাধ্যমে চীনের পশ্চিমাংশ থেকে সরাসরি ইউরেশিয়ায় আসার কাজ চলছে এবং ইত্যবসরেই সম্প্রসারিত কারাকোরাম হাইওয়ের অংশ হিসেবে পাকিস্তান পর্যন্ত বড় মাপের একটি টানেলের কাজ চীন সম্পূর্ণ করেছে। বা মার্কিনী চাপ সত্ত্বেও প্রবহমান গোয়াডর (পাকিস্তান)-হামবানটোটা (শ্রীলঙ্কা)-চট্টগ্রাম (বাংলাদেশ)-কিয়াউকফিয়ু (মিয়ানমার) রুটের কাজ। চীন-বাংলাদেশ সম্পর্ক থেকেও সৃষ্টি হবে বাংলাদেশ-চীন-ভারত-মিয়ানমার (বিসিআইএম) অর্থনৈতিক বা বাণিজ্য করিডর এবং এই করিডর বাংলাদেশসহ সব ক’টি দেশকে, দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় সংস্থাভুক্ত দেশগুলোকেও খুব কাছে নিয়ে আসবে। এই সুবাদে বিভিন্ন দেশের অভ্যন্তরে ও পারস্পরিক লেভেলে সুস্থ প্রতিযোগিতামূলক মানসিকতা সতেজে বেড়ে উঠতে উৎসাহিত হবে। বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যে যেসব চুক্তি সই হয়েছে, সেগুলোর মধ্যে, যেমন রয়েছে মুন্সীগঞ্জে গার্মেন্টস ভিলেজ প্রতিষ্ঠা, সোনাদিয়া এলাকায় গভীর সাগরে বন্দর নির্মাণ, পটুয়াখালীতে কয়লাচালিত বিদ্যুত-কেন্দ্র স্থাপন ইত্যাদি। এবং ইনফ্রাস্ট্রাকচারের মহারাজা চীনের কাছে পদ্মা নদী পারাপারে জবরজং ফেরি ব্যবস্থা চক্ষু পীড়ার কারণ হওয়াটাই হবে স্বাভাবিক। পদ্মা ব্রিজ প্রজেক্টে চীনের অংশগ্রহণের সম্ভাবনাই হবে তাই স্বাভাবিক। ফলে, সব যদি ঠিকঠাক মতো চলে, ‘মধ্য আয়ের দেশ’ হতে দরকারি পয়েন্ট অর্জনেও আর বাধা থাকবে না বাংলাদেশের। [email protected]
×