ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

জামায়াত নেতার নানা দুর্নীতি

ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার সংবাদ প্রকাশে শরীয়তপুরে তোলপাড়

প্রকাশিত: ০৪:৩১, ১৩ নভেম্বর ২০১৪

ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার সংবাদ প্রকাশে শরীয়তপুরে তোলপাড়

নিজস্ব সংবাদদাতা, শরীয়তপুর, ১২ নবেম্বর ॥ ’৭১-এর শিশু আজকের জামায়াত নেতা এখন মুক্তিযোদ্ধা-শিরোনামে দৈনিক জনকণ্ঠে বুধবার সংবাদ প্রকাশিত হওয়ার পর শরীয়তপুরে তোলপাড় শুরু হয়েছে। শরীয়তপুরের মুক্তিযোদ্ধারা ভূয়া মুক্তিযোদ্ধা জামায়াত নেতা ইউসুফ আলী মিয়ার শাস্তির দাবি জানিয়েছেন। অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসছে ইউসুফ আলী মিয়ার নানা অনিয়ম ও সীমাহীন দুর্নীতির তথ্য। চাকরিক্ষেত্রেও তার বিরুদ্ধে অসংখ্য জালিয়াতি, অনিয়ম ও অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ পাওয়া গেছে। অবৈধভাবে অর্থ অর্জন করে শরীয়তপুরসহ রাজধানী ঢাকায় বাড়ি-গাড়ির মালিক হয়েছেন। শরীয়তপুর জেলা সমাজসেবা অধিদফতরের কয়েকজন সাবেক ও বর্তমান কর্মকর্তাদের সূত্রে জানা গেছে, শরীয়তপুর জেলার ডামুড্যা উপজেলার ধানকাটি ইউনিয়নের চরমালগাঁও গ্রামের কালাচান বেপারীর ছোট ছেলে ইউসুফ আলী মিয়া বর্তমানে সমাজসেবা অধিদফতরের দুইটি পদে অধিষ্ঠিত রয়েছেন। গত ৮ বছর যাবৎ তিনি ডামুড্যা উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তার পদে রয়েছেন। একই সঙ্গে গত ২ বছর ধরে তিনি জেলা সমাজসেবা অধিদফতরের উপপরিচালকের পদেও রয়েছেন। ইউসুফ আলী মিয়া চাকরি জীবনের প্রায় ২৫ বছর শরীয়তপুরে কাটিয়ে একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিকারী বনে গেছেন। ২০০৯-১০ অর্থবছরে ইউসুফ আলী মিয়া ডামুড্যা উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা থাকাবস্থায় উত্তর ডামুড্যা দারুছসুন্নাহ এতিম খানা লিল্লøাহ বোডিং-এর ১৮০ জন এতিম ছাত্রের নামে ১ লাখ ৮০ হাজার টাকা ডামুড্যা সোনালী ব্যাংক থেকে উত্তোলন করে এতিমখানার শিক্ষক হাফেজ মোঃ আবু বকরের কাছে ১ লাখ ৩০ হাজার টাকা বুঝিয়ে দিয়ে বাকি ৫০ হাজার টাকা তিনি নিজে আত্মসাত করেছেন। ২০০৭Ñ০৮ অর্থবছরে ডামুড্যা উপজেলার ধানকাটি ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামের ১০ ভূয়া ব্যক্তির নামে ১ লাখ টাকা উত্তোলন দেখিয়ে সম্পূর্ণ টাকা নিজে আত্মসাত করেন। একই অর্থবছরে শারীরিক প্রতিবন্ধী ও এসিড দগ্ধ মহিলাদের নামে ৮০ হাজার টাকা উত্তোলন দেখিয়ে সমুদয় টাকা আত্মসাত করেন। ২০০৬Ñ০৭ অর্থবছরে ডামুড্যা উপজেলার ধানকাটি ইউনিয়নের মডেরকান্দি, বাহেরচর ও মোল্যাকান্দি গ্রামের তার আত্মীয়-স্বজনের নাম দেখিয়ে ৬ষ্ঠ পর্বের ১ লাখ ৩০ হাজার টাকা উত্তোলন দেখিয়ে সম্পূর্ণ টাকা নিজে আত্মসাত করেন। ইউসুফ আলী মিয়া তার আপন ভগ্নিপতি নয়ন মোল্যাকে ডামুড্যা উপজেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের নৈশপ্রহরী পদে অবৈধভাবে নিয়োগ প্রদান করেন। নয়ন মোল্যা দায়িত্ব পালন না করে মাসে একবার অফিসে এসে পুরো মাসের হাজিরা খাতায় স্বাক্ষর করে বেতন তুলে নেন। অপরদিকে ইউসুফ আলী তার বোন আমেনা খাতুনকে অনিয়মতান্ত্রিকভাবে বয়স্কভাতা পাইয়ে দিয়েছেন। ২০১২Ñ১৩ অর্থবছরে ডামুড্যা উপজেলা হাসপাতালে সমাজসেবা কার্যক্রমের আওতায় ৪০ হাজার টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়। এ অর্থ কোন কাজে ব্যয় না করে ইউসুফ আলী নিজে খেয়ে ফেলেন। ২০১০ সালে সমাজসেবা কার্যক্রমের জেলার নড়িয়া, ভেদরগঞ্জ, ডামুড্যা উপজেলা ও শরীয়তপুর শহর সমাজসেবা অফিসের আওতায় ব্যাংক সুদের ২ লাখ ৮৭ হাজার টাকা বিধিবহির্ভূতভাবে ইউসুফ আলী আত্মসাত করেন। এ অভিযোগে ২০১০ সালের ৮ জুন সমাজসেবা অধিদফতরের অতিরিক্ত পরিচালক জুলিয়েট বেগম স্বাক্ষরিত একটি চিঠির মাধ্যমে পরবর্তী ১৫ দিনের মধ্যে সমুদয় টাকা পরিশোধের নির্দেশ দিলেও গত ৪ বছর পার হলেও তা পরিশোধ করেনি ইউসুফ আলী মিয়া। অনুসন্ধানে জানা গেছে, ২০০৮Ñ০৯ অর্থবছর থেকে ২০১২Ñ১৩ অর্থবছর পর্যন্ত জাতীয় সমাজকল্যাণ পরিষদ থেকে জেলা সমাজকল্যাণ পরিষদের নামে প্রায় সাড়ে ৮ লাখ টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়। এই অর্থ জেলা প্রশাসক ও সমাজসেবার উপপরিচালকের যৌথ স্বাক্ষরে উত্তোলন করা কথা থাকলেও জেলা প্রশাসককে না জানিয়ে তার স্বাক্ষর জাল করে ইউসুফ আলী এককভাবে উত্তোলন করে খরচ করছেন। এ বিষয়ে তদন্ত ও নিরীক্ষণের জন্য জেলা প্রশাসনের ২ জন উর্ধতন কর্মকর্তার সমন্বয়ে একটি কমিটি গঠন করলে সে কমিটির তদন্তে ইউসুফ আলীর টাকা আত্মসাতের প্রমাণ মিলে। ইউসুফ আলী মিয়ার সরকারী অর্থ আত্মসাতের প্রমাণ মিলবে তার নিজের ও স্ত্রী নাসিমা আক্তারের ব্যাংক হিসেব নাম্বারে খোঁজ নিলে। তিনি বেশির ভাগ অর্থই লেনদেন করেছেন স্ত্রীর হিসাব নম্বরে। স্ত্রীর সঞ্চয়ী হিসাব নং- ২১৪৭, ইসলামী ব্যাংক, মিরপুর, পল্লবী শাখা, ঢাকা এবং তার নিজের হিসাব নং- ৩০, ইসলামী ব্যাংক, শরীয়তপুর সদর শাখা। মুক্তিযেদ্ধা সনদ ব্যবহার করে ইউসুফ আলী তার বড় ছেলেকে এমবিবিএস ডাক্তারি পাস করিয়ে সরকারী চাকরি পাইয়ে দিয়েছেন। এমনকি চাকরি করা অবস্থায় সরকারী খরচে ইংল্যান্ডে উচ্চ শিক্ষারও ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। সামান্য চাকরি করে মুক্তিযোদ্ধা সনদ অর্জনের কল্যাণে ইউসুফ আলী মিয়া শরীয়তপুর জেলা শহরে কোটি টাকা মূল্যের এক বিঘা জমি কিনে ৪ তলা ইমারত নির্মাণ করেছেন। শুধু তাই নয়, ঢাকা ডিওএইচএসের ২১ নং সড়কে গার্ডেনিয়া কিংডম এ্যাপার্টমেন্টের সি-৫ ফ্ল্যাটটি তার স্ত্রীর নামে অর্ধ কোটি টাকা দিয়ে ক্রয় করেছেন বলেও জানা গেছে। তার স্ত্রী ও সন্তানদের ব্যবহারের জন্য ইউসুফ আলী ঢাকায় ২৪ লাখ টাকা দিয়ে একটি প্রাইভেট গাড়ি ক্রয় করেছেন। যার নাম্বার ঢাকা মেট্রো-গ, ২৭-২৫৩৭। জেলা সমাজসেবা ও শরীয়তপুর শহর সমাজসেবা কার্যালয়ের নিজস্ব ভবন থাকা সত্বেও কয়েক বছর যাবৎ সে ভবনকে পরিত্যক্ত দেখিয়ে শহরের ধানুকায় নিজ স্ত্রীর নামে নির্মিত ভবনে অধিদফতরের পূর্বানুমতি গ্রহণ না করে এবং সম্পূর্ণ অনিয়মতান্ত্রিকভাবে গণপূর্ত বিভাগের নিয়মের বাইরে নিজ বাড়ির নিচ তলা ও তৃতীয় তলায় ২০১২ সালের ১ জানুয়ারি থেকে অফিস ভাড়া দেখিয়ে কার্যক্রম চালাচ্ছেন। ভাড়ার চুক্তি অনুযায়ী ২০১৪ সালের ৩০ জুন মেয়াদ শেষ হলেও অবৈধভাবে অফিস চালিয়ে যাচ্ছেন অদ্যাবধি। ইউসুফ আলী মিয়ার সবচেয়ে বেশি দুর্নীতি বেরিয়ে এসেছে হতদরিদ্র মানুষের বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা ও প্রতিবন্ধী ভাতা থেকে ঘুষ গ্রহণের ক্ষেত্রে। এ সব বিষয়ে শরীয়তপুর সমাজসেবা অধিদফতরের সাবেক দুইজন উপপরিচালক কহিনুর বেগম এবং মোঃ মাহবুবুল ইসলাম বিভিন্ন সময়ে অধিদফতরের প্রধান কার্যালয়ে ও মন্ত্রণালয়ে ইউসুফ আলী মিয়ার অপকর্মের বিরুদ্ধে আবেদন করলেও কোন বিচার হয়নি। এ সব অনিয়ম ও দুর্নীতির বিষয়ে ইউসুফ আলী মিয়ার ০১১৯৯১৫৮৪৩৩ নম্বর মুঠোফোনে জানতে চাইলেÑ নিজের স্ত্রীর নামে নির্মিত বাড়িতে ভাড়া দেখিয়ে জেলা সমাজসেবা অধিদফতরের কার্যালয় চালানোর কথা স্বীকার করে তিনি বলেন, আমি কিছুটা ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছি। আমি চাকরি জীবনে কোন প্রকার দুর্নীতি করিনি। আমি এখন একটু ব্যস্ত। আপনাদের সঙ্গে সময় নিয়ে এ সব বিষয়ে বিস্তারিত আলাপ করব।
×