ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

সর্বস্তরের মানুষের শ্রদ্ধা ভালবাসায় চিরনিদ্রায় শায়িত মাইনুল

প্রকাশিত: ০৪:২৩, ১৩ নভেম্বর ২০১৪

সর্বস্তরের মানুষের শ্রদ্ধা ভালবাসায় চিরনিদ্রায় শায়িত মাইনুল

স্টাফ রিপোর্টার ॥ বড় বেদনার মতো বেজেছ তুমি হে...। সত্যি বড় বেদনায় ভরা কাব্য আর শোকসঙ্গীত হয়েছিলেন সৈয়দ মাইনুল হোসেন। কিংবদন্তি স্থপতি বুকে কী এক কান্না গোপন করে রেখেছিলেন। কেউ সে ইতিহাস জানে না অথবা জানার সময় কারও হয়নি অথচ যে সে মানুষ নন, তিনি ছিলেন জাতীয় স্মৃতিসৌধের নক্সাবিদ। ৩০ লাখ শহীদের অম্লান স্মৃতি, বাঙালীর শৌর্যবীর্যের প্রতীক জাতীয় স্মৃতিসৌধের নক্সাটি তিনি করেছিলেন মাত্র ২৬ বছর বয়সে। এইটুকুন বয়সে কী বড় কাজ! আশ্চর্য কীর্তি! কিন্তু এর পরের পুরোটাই বেদনায় ভরা। অজানা কারণে মেধাবী স্থপতি নির্মোহ দেশপ্রেমিক আর দিনের আলোয় আসেননি। চার দেয়াল ভালবেসে একলা কাটিয়েছেন। জাতীয় দিবস, সরকারী অনুষ্ঠান, দৈনিকের ক্রোড়পত্র, টেলিভিশনের টকশো কোথাও ছিলেন না তিনি অথচ বেঁচে ছিলেন। সোমবার সেই বেঁচে থাকারও অবসান হয়েছে। এদিন পৃথিবী থেকে চির বিদায় নিয়েছেন তিনি। বুধবার মহান স্থপতিকে শেষ বিদায় জানায় জাতি। সর্বস্তরের মানুষ। সকালে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে এ শ্রদ্ধা নিবেদন অনুষ্ঠানের আয়োজন করে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট। সোয়া ১১টার দিকে মরদেহ এসে পৌঁছে সেখানে। গগনশিরিষ গাছের তলায় রাখা হয় নিথর দেহ। তারও আগে থেকে ফুল হাতে দাঁড়িয়েছিলেন বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষ। দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিলেন প্রিয় মুখটি শেষবার দেখার জন্য। শ্রদ্ধা জানানোর জন্য। এদিন সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের পক্ষে মাইনুল হোসেনের কফিনে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর ও সচিব ড. রণজিৎ কুমার বিশ্বাস। রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের পক্ষে শ্রদ্ধা জানান তথ্য ও গবেষণাবিষয়ক সম্পাদক এ্যাডভোকেট আফজাল হোসেন। সিপিবি, বাসদ, জাসদের পক্ষেও জানানো হয় শেষ শ্রদ্ধা। সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের পক্ষ থেকে ছায়ানট, উদীচী, খেলাঘর, নাট্যসংগঠন আরণ্যক ফুল দিয়ে শেষ শ্রদ্ধা জানায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলা একাডেমি, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি, জাতীয় জাদুঘর, গণগ্রন্থাগার অধিদফতর, প্রতœতত্ত্ব অধিদফতরের পক্ষে ফুল দেয়া হয় কফিনে। শ্রদ্ধা জানায় বাংলাদেশ স্থপতি ইনস্টিটিউট, প্রগতিশীল স্থপতি ফোরাম, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ চিকিৎসক ফোরাম, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ, সামাজিক আন্দোলন, বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক জোটসহ বিভিন্ন সংগঠন। বরেণ্য শিল্পী মুস্তাফা মনোয়ার, নাট্যজন আতাউর রহমান, অভিনেতা পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়, স্থপতি রবিউল হুসাইনসহ অনেকেই ব্যক্তিগতভাবে শ্রদ্ধা জানাতে আসেন। সভাপতি গোলাম কুদ্দুছের নেতৃত্বে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের শ্রদ্ধা নিবেদনের মধ্য দিয়ে এ পর্বের সমাপ্তি হয়। পরে প্রয়াতের স্মৃতির উদ্দেশ্যে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। এসব আনুষ্ঠানিকতার মাঝেই বার বার উঠে আসছিল মাইনুলের প্রতি অবহেলা অনাদরের কথা। অনেকেই অভিযোগটি করছিলেন। ক্ষোভ প্রকাশ করছিলেন কেউ কেউ। বাদ যাননি সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূরও। স্থপতি সৈয়দ মাইনুল হোসেনকে শ্রদ্ধা জানাতে সরকারের কিছুটা ঘাটতি ছিল বলে স্বীকার করেন তিনি। সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী বলেন, সমাজ ও মানুষের কাছ থেকে তিনি নিজেকে আড়াল করে রেখেছিলেন। এ কারণেও কিছুটা দূরত্ব তাঁর সঙ্গে তৈরি হয়ে গিয়েছিল। প্রচারবিমুখ হওয়ায় আমরা তাঁকে বহুবার চেষ্টা করেও লোকসমাজে আনতে পারিনি। সংবেদন ও সৃজনশীল মানুষ হলে যা হয় তাঁর বেলায় আসলে তাই হয়েছে। সাধারণ মানুষ সৈয়দ মাইনুল হোসেনকে চিরকাল শ্রদ্ধার পাত্র করে রাখবেন বলেই আশা প্রকাশ করেন আসাদুজ্জামান নূর। শ্রদ্ধা নিবেদন করে বরেণ্য শিল্পী ও মাইনুল হোসেনের স্বজন মুস্তাফা মনোয়ার বলেন, বাংলাদেশের সর্বশ্রেষ্ঠ স্থপতি মাইনুল হোসেন। এমন একটি স্থাপনা পৃথিবীর অন্য কোন দেশে আছে কিনা আমার জানা নেই। আমি মনে করি এটি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ স্মৃতিসৌধ। বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান বলেন, যতদিন এদেশ থাকবে তাঁর নক্সা করা স্মৃতিসৌধটি থাকবে। বেঁচে থাকবেন তিনিও। স্থপতি রবিউল হুসাইন বলেন, অনন্য শিল্পী ও স্থপতি মাইনুল হোসেন। আজ তিনি নেই। অবশ্য অভিযোগ উঠেছে, শেষ শ্রদ্ধা নিবেদনের দিনেও মাইনুল অবহেলার শিকার হয়েছেন। অন্যান্য বরেণ্য ব্যক্তির বেলায় রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানানো হয়। বহুদিন ধরে তাই হয়ে এসেছে। এবার তা হয়নি। রাষ্ট্রপ্রধান মোঃ আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শোকবার্তা দিলেও, প্রয়াতের কফিনে তাঁদের পক্ষ থেকে কোন ফুল দেয়া হয়নি। শহীদ মিনারে উপস্থিতিও এদিন ছিল তুলনামূলকভাবে কম। ফলে অনেকেই বেদনাহত হয়েছেন। এর আগে সৈয়দ মাইনুল হোসেনের মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় বুয়েটে। সেখানে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা ফুল দিয়ে তাঁকে শেষ শ্রদ্ধা জানান। শেষ শ্রদ্ধা জানানোর আনুষ্ঠানিকতা শেষে বাদ জোহর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় মসজিদে মাইনুলের জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। বিকেলে মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী কবর স্থানে দাফন করা হয় তাঁকে। অত্যন্ত মেধাবী স্থপতি সৈয়দ মাইনুল হোসেন সোমবার মৃত্যুবরণ করেন। ৬২ বছর বয়সী স্থপতি জীবনের মানসিকভাবে পুরোপুরি সুস্থ ছিলেন না। প্রচারের আড়ালে একেবারেই নিভৃতে একাকী থেকেছেন। শান্তিনগরের একটি বাসায় জীবন কাটে তাঁর। ১৯৭৬ সালে জাতীয় স্মৃতিসৌধের জন্য নক্সা আহ্বান করা হলে বহু প্রতিযোগীর সঙ্গে অংশ নেন তিনিও। মেধাবী স্থপতির নক্সা নির্বাচিত হয়। সে নক্সা অনুসারেই সাভারে গড়ে ওঠে জাতীয় স্মৃতিসৌধ। এ ছাড়া ৩৮টি বড় বগ স্থাপনার নক্সাও করেন তিনি। তবে একুশে পদক ছাড়া তেমন কোন পদক পুরস্কার বা সম্মান তাঁর পাওয়া হয়নি। সে বেদনা নিয়েই বিদায় নিলেন সৈয়দ মাইনুল হোসেন।
×