ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

আওয়ামী লীগ কাউন্সিল ঘিরে তৃণমূল রাজনীতি চাঙ্গা

প্রকাশিত: ০৪:১৯, ১৩ নভেম্বর ২০১৪

আওয়ামী লীগ কাউন্সিল ঘিরে তৃণমূল রাজনীতি চাঙ্গা

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ তৃণমূল কাউন্সিলের ব্যাপক কর্মযজ্ঞে শাসকদল আওয়ামী লীগ সারাদেশেই নেতাকর্মীদের মাঝে ব্যাপক প্রাণের সঞ্চার করতে পারলেও শীর্ষপদে নতুন নেতৃত্ব সৃষ্টি করতে পারছে না দলটি। কোন জেলায় দেড়যুগ পর, কোথাও একযুগ, আবার কোথাও ৭ থেকে ১০ বছর পর দলীয় কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হচ্ছে। বছরের পর বছর নেতৃত্ব থেকে যেসব জেলার সভাপতি বা সাধারণ সম্পাদকদের বিরুদ্ধে সংগঠনকে জনবিচ্ছিন্ন করার অভিযোগ রয়েছে কাউন্সিলরদের ভোটের অজুহাতে প্রভাব-প্রতিপত্তি খাটিয়ে সেসব নেতাই আবার একই পদে পুনর্নির্বাচিত হচ্ছেন। এ পর্যন্ত প্রায় ১৭-১৮টি জেলার সম্মেলন হলেও হাতেগোনা তিন থেকে চারটি জেলা ছাড়া বাকি সব জেলার সম্মেলনেই আগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকরাই পুনর্নির্বাচিত হয়েছেন। কাউন্সিলকে ঘিরে তৃণমূলে আওয়ামী লীগের রাজনীতি চাঙ্গা ও উজ্জীবিত হলেও নেতৃত্ব গঠনের ক্ষেত্রে পদপ্রত্যাশী পোড়খাওয়া ও জনপ্রিয় নেতাদের হতাশ হয়েই ফিরে যেতে হচ্ছে। তবে তৃণমূলে সম্মেলনের দায়িত্বপ্রাপ্ত কেন্দ্রীয় নেতারা অবশ্য বলছেন, জেলা বা মহানগরের শীর্ষ দুই পদে অধিকাংশ স্থানেই তেমন পরিবর্তন না আসলেও পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠনের ক্ষেত্রে প্রবীণের অভিজ্ঞতা ও নবীনের তারুণ্যকে প্রাধান্য দেয়া হবে। প্রতিটি স্থানেই ত্যাগী, আদর্শবান ও জনপ্রিয় নেতারা জেলা কমিটিতে স্থান পাবেন। টানা দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় এসেই বছরের পর বছর সম্মেলন না হওয়ায় সারাদেশে বিদ্যমান দলের নাজুক অবস্থার কথা তুলে ধরে দ্রুত সম্মেলনের মাধ্যমে দলকে শক্তিশালী করার নির্দেশ দেন শেখ হাসিনা। সর্বশেষ গতমাসে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের আগামী ডিসেম্বরের মধ্যেই সম্মেলন শেষ করার নির্দেশ সম্বলিত একটি চিঠি সারাদেশের তৃণমূল নেতাদের কাছে পাঠানো হয়। এছাড়া সম্মেলন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে সাত বিভাগের জন্য দলের কেন্দ্রীয় শীর্ষ নেতাদের সমন্বয়ে আটটি শক্তিশালী টিমও গঠন করা হয়। আর এ টিম গঠনের পরপরই তৃণমূল কাউন্সিল অনুষ্ঠানে কোমড়বেঁধে মাঠে নামেন দলটির দায়িত্বপ্রাপ্ত কেন্দ্রীয় নেতারা। দলের তৃণমূল সম্মেলনের সর্বশেষ অবস্থা জানতে গত শুক্রবার টানা দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসার পর প্রথম তাঁর ধানমন্ডির রাজনৈতিক কার্যালয়ে যান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেখানে দলের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে তৃণমূল কাউন্সিলের সর্বশেষ অগ্রগতি জানতে চান। জানা গেছে, ওই বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী দলের সুবিধাভোগী, আদর্শহীন নেতাদের বাদ দিয়ে ত্যাগী ও জনপ্রিয় নেতাদের সমন্বয়ে জেলা কমিটি গঠনের নির্দেশ দেন দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতাদের। প্রবীণের অভিজ্ঞতা ও নবীনের সাংগঠনিক কর্মদক্ষতাকে সমন্বয় করেই সারাদেশে সংগঠনকে শক্তিশালী ভিত্তির ওপর দাঁড় করানোরও নির্দেশ দেন তিনি। সারাদেশে তৃণমূল সম্মেলনের প্রকৃত অবস্থা সম্পর্কে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এ পর্যন্ত প্রায় ১৯টি জেলার সম্মেলন শেষ হলেও হাতেগোনা তিন/চারটি ছাড়া সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পদে কোন পরিবর্তন হয়নি। কোথাও তৃণমূলের ভোটে আবার কোথাও সমঝোতার ভিত্তিতে প্রভাব খাটিয়ে আগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকরাই নির্বাচিত হয়েছেন। সম্মেলনের আগে অনেক যোগ্য নেতাই ওই দুইটি শীর্ষপদে নিজেদের প্রার্থিতা ঘোষণা করলেও শেষ পর্যন্ত টিকে থাকতে পারেননি। বরং নিজেদের প্রার্থিতা ঘোষণা করায় সম্মেলনের পর ওইসব নেতাই এখন জেলায় নিজেদের আগের পদটি হারানোর শঙ্কাতে ভুগছেন। এ ব্যাপারে বিভিন্ন জেলার সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতার ঘোষণা দিয়েও পরে সরে দাঁড়ানো অনেক তৃণমূল নেতার সঙ্গে কথা বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে, তিন বছরের কমিটি হওয়া সত্ত্বেও সম্মেলন না করে ১০ থেকে ১২ বছর সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের পদে থেকে তাঁরা নিজেদের পছন্দের ও আজ্ঞাবহ নেতাদের নিয়ে কাউন্সিলর করেছেন। বিরোধীপক্ষের কাউকেই কাউন্সিলর করা হয়নি। ফলে সমঝোতায় হোক বা ভোটের মাধ্যমেই হোক, কোনভাবেই জেলার সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে হারানো কঠিন। নির্বাচনে গেলে ভবিষ্যতে হয়তো জেলার একটি সদস্যপদও দেয়া হবে না, এমন আশঙ্কা থেকেই সম্মেলনের আগে অধিকাংশ জেলায় সম্ভাব্য প্রার্থীরা সরে যেতে বাধ্য হয়েছেন। এক্ষেত্রে দায়িত্বপ্রাপ্ত কেন্দ্রীয় নেতারাও দলের ভবিষ্যতের চেয়ে সংগঠনকে চাঙ্গা করার শত ব্যর্থতা থাকলেও ওইসব ব্যর্থ সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককেই পুনরায় নির্বাচিত করছেন। এক্ষেত্রে তাঁরা নিজেদের অসহায়ত্বের কথাও তুলে ধরেন। ধানমন্ডিস্থ আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর রাজনৈতিক কার্যালয় এবং তৃণমূলে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এ পর্যন্ত মেয়াদোত্তীর্ণ নীলফামারী, ঠাকুরগাঁও, দিনাজপুর, খাগড়াছড়ি, বান্দরবান, রাঙ্গামাটি, ফেনী, হবিগঞ্জ, বরিশাল জেলা ও মহানগর, চট্টগ্রাম উত্তর ও দক্ষিণ, রাজশাহী মহানগর, জয়পুরহাটসহ ১৭-১৮টি জেলার সম্মেলন শেষ হলেও মাত্রটি চারটি জেলায় হয় সভাপতি নতুবা সাধারণ সম্পাদক পদে নতুন মুখ এসেছেন। বাকি সব জেলাতেই আগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকরাই নির্বাচিত হয়েছেন। জানা গেছে, মাত্র কিছুদিন আগে অনুষ্ঠিত ঠাকুরগাঁও জেলার সম্মেলনে তৃণমূলের ভোটে পূর্বের সভাপতি সাবেক মন্ত্রী রমেশ চন্দ্র সেনকে পরাজিত করে নতুন সভাপতি নির্বাচিত হন দবিরুল ইসলাম এমপি। তবে সাধারণ সম্পাদক পদে সাদেক কোরাইশী পুনর্নির্বাচিত হন। রাজশাহী মহানগরের সম্মেলনে তৃণমূলের ভোটে সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক মেয়র খায়রুজ্জামান লিটন সভাপতি পদে নির্বাচিত হন। সাধারণ সম্পাদক পদে নতুন মুখ ডাব্লু সরকার নির্বাচিত হন। ফেনীর সম্মেলনে পূর্বের সাধারণ সম্পাদক আবদুর রহমান বিকম সভাপতি নির্বাচিত হন, আর সাধারণ সম্পাদক পদে নির্বাচিত হন নিজাম উদ্দীন হাজারী এমপি। এছাড়া বাদবাকি প্রায় সকল জেলাতেই পূর্বের কমিটি পুনর্বহাল থাকে। এ ব্যাপারে যোগাযোগ করা হলে রাজশাহী বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন এমপি জনকণ্ঠকে বলেন, দীর্ঘদিন মাঠের রাজনীতি করে প্রতিষ্ঠিত রাজনীতিক হিসেবে নিজেদের গড়ে তুলেই একজন নেতা জেলার সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক হোন। পোড়খাওয়া এসব নেতাকে হঠাৎ করেই বাদ দেয়া যায় না। যেসব জেলার সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক তৃণমূল নেতাদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখেননি বা নিজেদের অবস্থান ধরে রাখতে পারেননি, তাঁরাই সম্মেলনে তৃণমূলের ভোটে ছিটকে পড়ছেন। আর যাঁরা তৃণমূলের নেতাদের কাছে এখনও অধিক জনপ্রিয় তাঁরাই পুনর্নির্বাচিত হচ্ছেন। তবে নতুন নেতৃত্ব আসছে না- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, অবশ্যই নতুন নেতৃত্ব আসবে। শুধুমাত্র সভাপতি বা সাধারণ সম্পাদক নিয়েই তো জেলা বা মহানগর কমিটি নয়। ৭১ সদস্যের পূর্ণাঙ্গ কমিটিতে অবশ্যই প্রবীণ ও নবীনের সমন্বয়ে ত্যাগী নেতাদের অন্তর্ভুক্ত করা হবে। আমরা কোথাও উপর থেকে নেতৃত্ব চাপিয়ে দিচ্ছি না। সমঝোতা না হলে তৃণমূলের ভোটেই নতুন নেতৃত্ব গঠন করা হচ্ছে। এ প্রসঙ্গে রংপুর বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক খালিদ মাহমুদ চৌধুরী এমপি জনকণ্ঠকে বলেন, তৃণমূল নেতাদের কাছে যাঁরাই জনপ্রিয় ও অধিক গ্রহণযোগ্য তাঁরাই সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হচ্ছেন। আর যাঁরা দীর্ঘদিন শীর্ষপদে থেকে নেতাকর্মীদের ধরে রাখতে পারেননি তাঁরা তৃণমূলের ভোটে ছিটকে পড়ছেন। আমরা কোথাও কেন্দ্রীয় থেকে নেতৃত্ব চাপিয়ে দিচ্ছি না। অধিকাংশ জেলায় সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পদে তেমন পরিবর্তন না আসলেও পূর্ণাঙ্গ কমিটিতে সুবিধাভোগী, ব্যর্থ নেতাদের বাদ দিয়ে নবীন-প্রবীণের সমন্বয়ে ত্যাগীদের নেতারাই স্থান পাবেন। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে সম্মেলন শেষ করতে ব্যাপক কর্মযজ্ঞ চলছে শাসক দলটিতে। এর মধ্যে ১৪ নবেম্বর পটুয়াখালী, ১৫ নবেম্বর বরগুনা, ২৬ নবেম্বর চাঁপাইনবাবগঞ্জ, ২৯ নবেম্বর পাবনা, ৪ ডিসেম্বর নাটোর, ৬ ডিসেম্বর রাজশাহী জেলা, ৭ ডিসেম্বর সিরাজগঞ্জ, ৯ ডিসেম্বর নওগাঁ, ১০ ডিসেম্বর বগুড়াসহ অধিকাংশ মেয়াদোত্তীর্ণ জেলা ও মহানগরের সম্মেলনের তারিখ চূড়ান্ত করা হয়েছে।
×