ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

উন্মুক্ত বাজেট চর্চা বাড়ছে

প্রকাশিত: ০৪:৩৯, ১২ নভেম্বর ২০১৪

উন্মুক্ত বাজেট চর্চা বাড়ছে

হামিদ-উজ-জামান মামুন ॥ উন্মুক্ত বাজেট চর্চা বাড়ছে তৃণমূলে। ফলে ইউনিয়ন পরিষদের স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতাও বাড়ছে। সেই সঙ্গে বাড়ছে উন্নয়নে স্থানীয় মানুষের অংশগ্রহণও। কেননা এ পদ্ধতির ফলে সাধারণ মানুষের মতামতের প্রতিফলন ঘটেছে। বাজেট ঘোষণার সময় যেন উৎসবমুখর পরিবেশ বিরাজ করে ইউনিয়নগুলোতে। সম্প্রতি সিরাজগঞ্জ জেলার বিভিন্ন ইউনিয়ন ঘুরে এমনই চিত্র দেখা গেছে। সরেজমিন সিরাজগঞ্জ ঘুরে দেখা যায়, এ উপজেলার ১০টি ইউনিয়নেই নিয়মিত উন্মুক্ত বাজেট করা হয়ে থাকে। বাজেটের আগে ওয়ার্ড সভা অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে সভাপতিত্ব করেন সংশ্লিষ্ট ওয়ার্ডের সদস্যরা। স্থানীয় সমস্যা এবং করণীয় ওই সভাতেই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। তারপর সব ওয়ার্ডের প্রস্তাবগুলো নিয়ে পুরো ইউনিয়নের একটি খসড়া বাজেট তৈরি করা হয়। পরবর্তীতে আনুষ্ঠানিকভাবে খসড়া বাজেট উপস্থাপন করা হয়, সে সময় প্রশ্ন-উত্তর পর্ব থাকে। সাধারণ মানুষ প্রশ্ন করলে চেয়ারম্যান বা সদস্যরা উত্তর দেন। এ সময় সংশ্লিষ্ট উপজেলার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাসহ উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকেন। এ বিষয়ে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) মহাপরিচালক বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. মোস্তফা কে মুজেরী জনকণ্ঠকে বলেন, সব সময় মনে রাখতে হবে তথ্য শেয়ারিং যদি হয় এবং সেটি যদি হয় বাজেটের মতো গুরুত্বপূর্ণ একটি জায়গায় তাহলে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা অবশ্যই নিশ্চিত হবে। কেননা যে বছর উন্মুক্ত বাজেট হবে সে বছর ওই ইউনিয়নে কি ধরনের উন্নয়ন প্রকল্প নেয়া হবে, কত টাকা ব্যয় হবে, কোন কোন খাত থেকে অর্থ ব্যয় হবে সব বিষয় যদি স্টেকহোল্ডার বা জনগণ জানতে পারেন তাহলে কাজের মান ভাল হয়। তাছাড়া জনগণ তাদের ইচ্ছা ও অনুভূতি প্রকাশ করতে পারেন বাজেটে প্রক্রিয়ার মধ্যে। পাশাপাশি জনগণ যদি জানতে পারেন তাদের করের টাকা কোথায় ব্যয় হবে তাহলে তারা অবশ্যই কর দেবেন। ইউনিয়নের মানুষ বছর শেষে হিসাব মেলাতে পারেন। তখন জনপ্রতিনিধিদের বলতে পারেন বাজেটে এটা-ওটা করার কথা ছিল, কিন্তু হলো না কেন? অন্যদিকে যারা বাজেট বাস্তবায়নের দায়িত্বে রয়েছেন তারাও মনে রাখেন বছর শেষে জনগণের প্রশ্নের মুখে পড়তে হবে। তখন কাজের কোয়ালিটি নিশ্চিত করবে। এভাবে পরস্পরের মধ্যে অংশীদারিত্ব তৈরি হবে এবং স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা এবং পারস্পরিক সহযোগিতাও বৃদ্ধি পাবে। উন্মুক্ত বাজেট বিষয়ে সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ সালাউদ্দিন জনকণ্ঠকে জানান, আমার উপজেলার দশটি ইউনিয়নের সবগুলোতেই নিয়মিতভাবে উন্মুক্ত বাজেট হচ্ছে। এ বিষয়ে কোন ছাড় নেই। এছাড়া এবারই সিরাজগঞ্জ উপজেলা পরিষদে প্রথমবারের মতো উন্মুক্ত বাজেট হয়েছে। যা সারাদেশের মধ্যে প্রথম। এর মধ্য দিয়ে একদিকে যেমন ইউনিয়ন পরিষদের স্বচ্ছতা নিশ্চিত হচ্ছে, অন্যদিকে তেমনি সাধারণ মানুষ যখন জানতে পারে যে তাদের করের টাকা কোন খাতে ব্যয় হচ্ছে তখন তারা কর দিতে উৎসাহীত হয়। এর মাধ্যমে ইউনিয়ন পরিষদে জনগণের একটা ওনারশিপ তৈরি হয়। আমি গ্রাম পর্যায় গেলে সাধারণ মানুষদের জিজ্ঞাসা করি আপনাদের গ্রামে কি কি উন্নয়ন কাজ হয়েছে এবং এগুলো কিভাবে হয়েছে। তখন তারা অনেকেই উত্তর দিতে পারেন। এতে বোঝা যায় মানুষ সচেতন হয়েছে। এ বিষয়ে সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলার ৯নং কালিয়াহরিপুর ইউনিয়ন পরিষদের অর্থ ও সংস্থাপন কমিটির সভাপতি এবং ইউপি সদস্য হালিমা বেগম জনকণ্ঠকে জানান, উন্মুক্ত বাজেট হওয়ায় জনগণ জানতে পারছে তাদের করের টাকা কোথায় কিভাবে ব্যয় হচ্ছে। ফলে তারা কর দিতে উৎসাহিত হয়। এছাড়া বাজেটের সময়ই সিদ্ধান্ত নেয়া হয় ওই বছর কোন ওয়ার্ডে কি ধরনের উন্নয়ন কাজ করা হবে। এক্ষেত্রে স্থানীয় জনগণের চাহিদাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া হয়। যদি সে বছর বাজেট অনুযায়ী কাজ না হয় তখন পরের বছরের বাজেট করার সময় তারা প্রশ্ন করে, জানতে চায় সেটি কেন হয়নি। এভাবে জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠান হচ্ছে। এতে ভুল বোঝাবুঝি কম হয়। সবাই খুশি থাকে। এ বিষয়ে একই উপজেলার ৮ নং কাওয়াকোলা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সাহাদত হোসেন ঠা-ু বলেন, আমি ১০ বছর ইউপি সদস্য ছিলাম, তারপর ১০ বছর ধরে এ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছি। আগে বাজেটের বিষয়টি এত গুরুত্ব দেয়া হতো না। তখন ইউনিয়ন পরিষদের কার্যক্রম সম্পর্কে মানুষ অন্ধকারে ছিল। কিন্তু ২০০৪ সাল থেকে উন্মুক্ত বাজেট শুরু করেছি। যেদিন বাজেট ঘোষণা করা হয়, সেদিন ইউপির আয়-ব্যয় জনগণের সামনে তুলে ধরা হয়। তারপর ট্যাক্স বিষয়ে আলোচনা করা হয়। গত বাজেটের বাস্তবায়নের চিত্রও তুলে ধরা হয়। পরবর্তীতে নতুন বছরের বাজেট উপস্থাপন করা হয়। জনগণের মতামতের ভিত্তিতে বাজেট করা হয়। ফলে মানুষের মধ্যে এখন অনেক সচেতনতা বৃদ্ধি পেয়েছে। নদী ভাঙ্গা ইউনিয়ন হলেও কর আদায়ের পরিমাণ বাড়ছে। কাওয়াকোলা ইউনিয় পরিষদের সচিব মনোয়ারুল ইসলাম জানান, ২০১০-১১ অর্থবছরে বাজেটে কর আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ১ লাখ ৫০ হাজার টাকা, কিন্তু আদায় হয়েছিল মাত্র ৩০ হাজার টাকা। ২০১১-১২ অর্থবছরে কর আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১ লাখ ৫০ হাজার টাকা, কিন্তু আদায় হয়েছিল ৭৭ হাজার টাকা। ২০১২-১৩ অর্থবছরে দেড় লাখ টাকা লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে আদায় হয়েছিল ৭৭ হাজার টাকা। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২ লাখ ৫০ হাজার টাকা, আদায় হয়েছিল ২ লাখ টাকা। চলতি ২০১৪-১৫ অর্থবছরে কর আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ২ লাখ ৫০ হাজার টাকা, গত অক্টোবর ৬নং ওয়ার্ডের সদস্য জোনাব আলী জানান, বাজেটের সময় অনুষ্ঠানে ব্যাপক মানুষের অংশগ্রহণ থাকে। প্রথম দিকে গ্রামের মানুষদের ডাকলেও আসত না। কিন্তু এখন অনেকটাই সচেতনতা বেড়ে গেছে। মাইকিং শুনেও অনেকে আসেন। প্রায় একই ধরনের মন্তব্য করেন ৪নং ওয়ার্ড সদস্য আবুল কালাম শেখ এবং ৭নং ওয়ার্ড সদস্য আবদুস সালাম। বড় কয়রা গ্রামের জোহার আলী বলেন, এখন বাজেটের দিন চেয়ারম্যান ও সদস্যদের ধরা যায়। কথা দিয়ে সেই কথা না রাখলে তার জন্য জবাবদিহিতার সুযোগ পাওয়া যায়। আগে এরকম অনুষ্ঠান দেখিনি। প্রায় একই মন্তব্য করেন ৯নং কালিয়া হরিপুর ইউনিয়নের সমাজসেবক আতাহার আলী, শিক্ষক জহুরুল ইসলাম, মসজিদের ইমাম মোঃ ওমর আলী ও এনজিও কর্মী শুভ্রারানীসহ আরও অনেকেই। চলতি (২০১৪-১৫) অর্থবছরের বাজেট ঘোষণা অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে বই আকারে প্রস্তাবিত বাজেট প্রকাশ করেছিল কালিয়া হরিপুর ইউনিয়ন পরিষদ। ওই বইতে পূর্ববর্তী তিন অর্থবছরের বাজেটসহ প্রস্তাবিত বাজেট তুলে ধরে। বইতে কোন কোন খাত থেকে কত টাকা আয়ের লক্ষ্য এবং ব্যয় কত হবে সবকিছুই বিস্তারিত তুলে ধরার পাশাপাশি চেয়ারম্যান ও সদস্যদের সম্মানী ভাতা, সচিব ও গ্রাম পুলিশদের বেতন-ভাতার তালিকা, বিভিন্ন ওয়ার্ড কমিটির পরিচিতি, স্কিম সুপারভিশন কমিটির পরিচিতি, ইউনিয়ন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটি, অতিদরিদ্র্যদের জন্য কর্মসংস্থান কর্মসূচী বাস্তবায়নে ইউনিয়ন কমিটি এবং বিভিন্ন বিষয়ে ১৩টি স্টান্ডিং কমিটির তালিকা ও পরিচিতি তুলে ধরা হয়েছে। ৯নং কালিয়া হরিপুর ইউনিয়ন পরিষদের সচিব এস এম মনিরুল ইসলাম বলেন, উন্মুক্ত বাজেট হওয়ায় সাধারণ মানুষের কাছে অনেক বিষয়ই পরিষ্কার হয়ে যায়। যেমন কোন কাজ যদি করা না হয় তাহলে কেন হলো না, এর জবাব যদি মানুষ জানতে পারে তাহলে আর ভুল বোঝাবুঝির অবকাশ থাকে না। এ কারণে মানুষের কর দিতেও কষ্ট লাগে না। তারা উৎসাহিত হয়েই এখন কর দিচ্ছে। এ বিষয়ে ৯নং কালিয়া হরিপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান বলেন, আমার ইউনিয়নে প্রতিবছরই উন্মুক্ত বাজেট হচ্ছে। এর মধ্য দিয়ে স্থানীয় জনগণের মতামতের প্রতিফলন ঘটছে।
×