ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

চট্টগ্রাম বন্দরে ধুলোর আস্তরে আড়াই হাজার গাড়ি

প্রকাশিত: ০৪:৩৯, ১২ নভেম্বর ২০১৪

চট্টগ্রাম বন্দরে ধুলোর আস্তরে আড়াই হাজার গাড়ি

অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ চট্টগ্রাম বন্দরের বিভিন্ন শেডে অবহেলায় পড়ে আছে ২ হাজার ৪৯০টি গাড়ি। কোটি টাকার ল্যান্ড ক্রুজার থেকে শুরু করে ছোট-বড় দামি-বেশি দামি নানা ব্র্যান্ডের গাড়ির ওপর ধুলোর আস্তর। তারপরও আঙ্গুলে ঘষা দিলে বেরিয়ে আসে ঝকঝকে বেগুনি নীল রং। সূর্যের আলো পড়ে আরও ঝলকে ওঠে। আরও একটু ঘষে দেখা গেল একদম নতুন চকচকে রঙের বনেট। গাড়ি দামি, ব্র্য্যান্ডনেমটিও ঢাকা পড়েছে ধুলোর আস্তরে। এমন কয়েক হাজার গাড়ি অধিকাংশ ধুলোয় ঢাকা পড়ে জমা হয়ে আছে বাণিজ্যিক রাজধানী চট্টগ্রাম বন্দরে। অধিকাংশই গাড়িই শেডহীন খোলা মাঠে। এগুলো রিকন্ডিশন্ড। তাই একটু বেশিই অবহেলা। আর যেগুলো ব্র্যান্ড নিউ সেগুলো চারদিক আটকানো বড় আকারের টিনের ঘরের মধ্যে, অপেক্ষাকৃত যতেœ রয়েছে। চট্টগ্রাম বন্দরে ঢোকার অনুমতি মানেই গাড়ির শেডে ঢোকা যাবে, এমনটা নয়। নিতে হবে আলাদা অনুমতি। সেই অনুমতি নিয়েই গাড়ির শেডে ঢুকছেন ক্রেতা বিক্রেতা। সেখানেই চলে বেচাকেনা। নিরাপত্তার দায়িত্বে যারা তারা আশপাশেই কড়া চোখ রাখছেন। নজর তো থাকবেই। এই গাড়ির গুদাম চট্টগ্রাম বন্দরের একটা বড় আয়ের উৎস। চট্টগ্রাম বন্দরের পরিবহন বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, গত ৬ নবেম্বর পর্যন্ত চট্টগ্রাম বন্দরের বিভিন্ন শেডে দুই হাজার ৪৯০টি গাড়ি ছিল। চলতি বছরের ৫ নবেম্বর পর্যন্ত ২৯টি জাহাজে করে ১০ হাজার ৩৭৩টি গাড়ি চট্টগ্রাম বন্দরে আসে। এর মধ্যে অক্টোবর পর্যন্ত ২৭টি জাহাজে ৯ হাজার ৭৫৩ এবং ৫ নবেম্বর পর্যন্ত দুটি জাহাজে করে ৬২০টি গাড়ি বন্দরে আসে। অক্টোবর পর্যন্ত ১০ মাসে আসা মোট গাড়ির মধ্যে ৮ হাজার ৬৪৮টি রিকন্ডিশন্ড ও ১ হাজার ১০৪টি ব্র্যান্ড নিউ গাড়ি রয়েছে। এই সময়ের মধ্যে ৮ হাজার ২৪৮টি গাড়ি খালাস হয়েছে। এই খালাস হওয়া আর গাড়ির চালানের মধ্যে যে পার্থক্য ওগুলোই জমা পড়ে থাকে। যাতে ধুলো জমতে থাকে দিন পর দিন। কোনটি মাসের পর মাস ঘুরে বছরও পেরিয়ে যায়। টিন শেডের ভেতরে একটি গাড়ি দেখা গেল ২০০০ সালের মডেল। এই গাড়িটি একযুগেরও বেশি সময় ধরে আছে। নিলামে তুলেও বেচতে পারেনি বন্দর কর্তৃপক্ষ। শেডে ঘুরে ঘুরে নিরাপত্তারক্ষী আর ক্রেতা-বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল এখানকার নানা সমস্যার কথা। সবচেয়ে বড় যে অভিযোগ তা হচ্ছে শেডে রাখা গাড়িগুলো থেকে যন্ত্রাংশ ও তেল চুরি। একজন তো দাবিই করে বসলেন, মাসে যে পরিমাণ যন্ত্রাংশ চুরি হয়, তার দাম ১০ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। কখনও কখনও আস্ত গাড়িই হাপিস হয়ে যাচ্ছে। এক রাতে শেড থেকে ছয়টি গাড়ি চুরি হয়ে যাওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। গাড়ির মালিকপক্ষের আঙ্গুল এক্ষেত্রে বন্দরের নিরাপত্তা কর্মীদের দিকে। তাদের দাবি নিরাপত্তার নামে তারা চুরির সঙ্গে জড়িত হয়ে পড়ছে। অপর একটি অভিযোগ এলো গাড়ি আমদানিকারকদের পক্ষ থেকে। তারা বন্দরে গাড়ি রাখার ভাড়া বেশি বলে জানালেন। চট্টগ্রাম বন্দরে রো-রো জাহাজ থেকে নামানোর চার দিন পর প্রতি ইউনিট গাড়ির জন্য প্রতিদিনের ভাড়া ৫শ’ টাকা। আমদানিকারকদের মতে, চট্টগ্রাম বন্দরে ভাড়া বেশি। সেই তুলনায় মংলাবন্দরে ভাড়া কম। সেখানে প্রতিদিনের ভাড়া মাত্র ৩৫ টাকা। আর সে কারণে অনেক আমদানিকারকই চান, তাদের জাহাজটি চট্টগ্রাম না মংলাবন্দরে ভিড়ুক। ভাড়া বেশি হওয়ার বিষয়টি নির্দ্বিধায় অবশ্য স্বীকার করে নেয় বন্দর কর্তৃপক্ষ। এরপরও চট্টগ্রাম বন্দরে গাড়ি আসছে। পরিবহন সুবিধা, দীর্ঘদিন ধরে যারা আমদানি-রফতানি করছেন এই বন্দর থেকে তারা সহজেই অন্য বন্দরে যাবে না, এমনটাই মনে করে বন্দর কর্তৃপক্ষ। তবে যন্ত্রাংশ চুরির বিষয়ে অভিযোগ দিন দিনই বাড়ছে। দোষ নিরাপত্তা কর্মীদের ওপর পড়লেও তারা বলছে ভিন্ন কথা। এক নিরাপত্তাকর্মী নাম প্রকাশ না করে বলেন, বন্দরের ভিতরের ও বাইরের মিলিয়ে একটি চক্র রয়েছে। তারাই এই অপরাধের সঙ্গে জড়িত। চোরদের সবচেয়ে বেশি পছন্দ ইঞ্জিন কন্ট্রোলার। এর একেকটির দাম দেড় থেকে ২ লাখ টাকা পর্যন্ত। আর সচরাচরই চুরি যাচ্ছে টায়ার, ডিভিডি, ব্যাটারি, এসিসহ ছোট ছোট যন্ত্রাংশ। আর তেল চুরি একটি মামুলি ঘটনামাত্র। আরও একটি তথ্য জানা গেল, এই চোররাই আবার গাড়ির ক্রেতা বা বিক্রেতার কাছে ওই যন্ত্রাংশগুলো বিক্রি করেন। আর এসব কিছুই ঘটছে কর্তৃপক্ষের নাকের ডগায়। জানা গেছে, শুল্কায়ন জটিলতায় আমদানিকৃত প্রায় ৩০০ কোটি টাকার রিকন্ডিশন্ড গাড়ি চট্টগ্রাম ও মংলাবন্দরে আটকে আছে। এসব গাড়িতে নতুন শুল্কহার কার্যকর করা না হলে পরবর্তীতে আমদানি করা গাড়ির তুলনায় এগুলোর মূল্য অনেকগুণ বাড়বে এবং আমদানিকারকদের এসব গাড়িতে বিপুল অঙ্কের লোকসান গুনতে হবে। বিষয়টি নিয়ে আমদানিকারকরা এফবিসিসিআইর মাধ্যমে এনবিআরে অভিযোগ করা হয়েছে। যদিও গাড়ির মূল্য যৌক্তিকভাবে নির্ধারণের জন্য অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বাজেটে রিকন্ডিশন্ড গাড়ির শুল্কায়ন যৌক্তিক পর্যায়ে নির্ধারণ করেছেন। উদ্যোক্তারা জানান, রিকন্ডিশন্ড গাড়ির শুল্ক নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হয়নি বরং গাড়ির শুল্কায়ন মূল্য নির্ধারণ নিয়ে বিতর্ক হচ্ছে। বিষয়টি বাজেট সংশ্লিষ্ট ছিল না। অথচ বাজেটে অন্তর্ভুক্ত করায় ২০০৮ সালের তুলনায় ২০০৫-০৬ সালের গাড়ির শুল্কায়ন মূল্য অনেক বেশি দাঁড়িয়েছে। ইতোমধ্যে শুল্কায়ন জটিলতা নিরসনে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকেও অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের সচিবকে চিঠি দেয়া হয়।
×