ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

জাতীয় স্মৃতিসৌধের রূপকার

প্রকাশিত: ০৪:২৫, ১২ নভেম্বর ২০১৪

জাতীয় স্মৃতিসৌধের রূপকার

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণের পর নিরঙ্কুশ হয় আমাদের স্বাধীনতা। মুক্তিযুদ্ধের শহীদের স্মৃতিকে ধরে রাখতে নির্মাণ করা হয় জাতীয় স্মৃতিসৌধ। স্বাধীনতা দিবস ও বিজয় দিবসের প্রভাতে আমরা এই স্মৃতিসৌধে ছুটে যাই, ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করি ’৭১-এর শহীদদের উদ্দেশে। লাখ লাখ মানুষ একত্রিত হই, আবেগতাড়িত হই, স্মরণ করি, দেশপ্রেমে নতুন করে উদ্বুদ্ধ হই এই স্মৃতির মিনারের কাছে এসে। সবচেয়ে আনন্দের বিষয়, এই স্মৃতিসৌধে এসে নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার ইতিহাস জানার অনুপ্রেরণা পায়। তাই এই স্মৃতিসৌধ আমাদের জাতীয় জীবনে এক অনন্য প্রতীক হিসেবে চিহ্নিত। জাতীয় জীবনে এর আবেদন, গুরুত্ব, উপলব্ধির প্রেক্ষাপট এতটুকু ম্লান হবে না। এই স্মৃতিসৌধের স্থপতি তথা রূপকার সৈয়দ মাইনুল হোসেন আর নেই, সোমবার দুপুরে তিনি রাজধানীর একটি হাসপাতালে ইন্তেকাল করেছেন। তাঁর বয়স হয়েছিল ৬২ বছর। একুশের পদকপ্রাপ্ত এই স্থপতি দুই মেয়ে ও বোনসহ অসংখ্য গুণগ্রাহী রেখে গেছেন। তাঁর নকশায় তৈরি এই স্মৃতিসৌধটি অবিনাশী সৃষ্টি, জাতীয় জীবনের গৌরবের প্রতীক, এক পরম শ্রদ্ধার স্মৃতিকেন্দ্র। যতদিন বাংলাদেশ থাকবে ততদিন এই স্মৃতিসৌধ আমাদের হৃদয়ে স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিকে অনুরণিত করবে। ১৫০ ফুট উঁচু এই স্তম্ভটি একটি প্রতীকী স্মৃতির মিনার। কিন্তু আমাদের হৃদয়ে এতটাই বিশাল স্থান জুড়ে অবস্থান করে যা আকাশ স্পর্শ করে। স্পর্শ করে আমাদের হৃদয় উজাড় করা ভালবাসা, শ্রদ্ধা। ১৯৭২ সালে ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকা থেকে ২৫ কিলোমিটার দূরে ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের পাশে এই স্মৃতিসৌধ নির্মাণের পরিকল্পনার কথা জানান। ১৯৭৮ সালে সরকারীভাবে স্মৃতিসৌধ নির্মাণের পরিকল্পনার পরিপ্রেক্ষিতে নক্সা আহ্বান করা হয়। এ ব্যাপারে ব্যাপক আগ্রহ লক্ষ্য করা যায়। নক্সা আহ্বানের পরিপ্রেক্ষিতে স্থপতি ও শিল্পীদের অনেকে আগ্রহ প্রকাশ করেন। সেই আহ্বানে সাড়া দিয়ে ৫৭টি ডিজাইন জমা পড়ে। যাচাই ও বাছাই কমিটি সৈয়দ মাইনুল হোসেনের নক্সাটি নির্বাচন করে। তাঁর সেই নক্সা অনুসারে স্মৃতিসৌধের বেদীমূল থেকে উঠে দাঁড়িয়েছে সাতটি ত্রিকোণ কলাম। সবচেয়ে বড়টি ১৫০ ফুট উঁচু। এই সাতটি কলামের মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাস ও সংগ্রামের সাতটি পর্যায় সূচিত করেছেন তিনি। এই স্মৃতিসৌধের নক্সা সম্পর্কে স্থপতি মাইনুল হোসেন সাতটি কলামের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বলেছিলেন ‘চারদিকে প্রচ- চাপ। সেই চাপে কিছু একটা উঠে যাচ্ছে। বায়ান্ন থেকে একাত্তর পর্যন্ত সাতটা বড় বড় আন্দোলন হয়েছিল। নিচের খাঁজটা বায়ান্ন, সবচেয়ে উঁচুটি একাত্তর। এর মাঝখানের স্থানগুলোতে চুয়ান্ন, ছাপ্পান্ন, বাষট্টি, ছেষট্টি ও ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান কলামগুলো স্থান পেয়েছে। এই স্মৃতিসৌধকে ঘিরে আছে কৃত্রিম একটি হ্রদ এবং মনোরম এক উদ্যান। স্মৃতিসৌধ চত্বরেও আছে মাতৃভূমির জন্য আত্মোৎসর্গকারী অজ্ঞাতনামা শহীদের দশটি গণসমাধি। স্মৃতিসৌধ প্রাঙ্গণে আরও রয়েছে উন্মুক্ত মঞ্চ, অভ্যর্থনা কক্ষ, মসজিদ, হেলিপ্যাড ও কাফেটারিয়া। স্থপতি সৈয়দ মাইনুল হোসেন ১৯৫২ সালের ৫ মে মুন্সীগঞ্জ জেলার টঙ্গীবাড়ির দামপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৭৬ সালে তিনি স্থাপত্যবিদ্যায় প্রথম শ্রেণী পেয়ে স্নাতক হন। তিনি ১৯৭৮ থেকে ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত ৩৮টি বড় স্থাপনার নক্সা করেন। স্মৃতিসৌধের এই রূপকারকে জাতি শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করবে।
×