ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র ও আমাদের সংবিধান

প্রকাশিত: ০৪:১৬, ১২ নভেম্বর ২০১৪

স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র ও আমাদের সংবিধান

(১১ নবেম্বরের পর) তাই সরকারের কাছে বাংলার মানুষের সাংবিধানিক প্রত্যাশা আর এই সরকারের সাংবিধানিক প্রতীতির আন্তরিক বাস্তবায়ন এবং সে জন্য উপযুক্ত কৌশল রচনা সময়ের সবচেয়ে জরুরী দাবি আজ। এছাড়াও রয়েছে সংবিধানের স্খলন। পঞ্চম, সপ্তম ও অষ্টম সংশোধনীর মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় মূলনীতির পরিবর্তন, রাষ্ট্রধর্ম সৃষ্টির মাধ্যমে বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী মানুষের মাঝে অনৈক্য সৃষ্টি, অর্পিত ও শত্রু স¤পত্তি আইনকে অব্যাহত রাখার মাধ্যমে নাগরিকদের অধিকারের বৈষম্য সৃষ্টি, অবৈধ ক্ষমতা দখল ও অসাংবিধানিক সকল ক্রিয়া-কর্ম ও পরিবর্তনকে বৈধতা দান এসবই ঐরূপ স্খলনের উদাহরণ। সংবিধান রক্ষা করার অঙ্গীকার করে যারা শপথ নিয়েছিল তাদের স্খলন আর সেই সঙ্গে সংবিধানকে রক্ষা করতে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের ব্যর্থতা এক ধরনের হতাশায় রূপ নিয়েছিল। এই অন্ধকারের অমানিশা থেকে বেরিয়ে এসে সংবিধানের অঙ্গীকার বাস্তবায়নের জন্য দিনবদলের যে প্রত্যাশা সেই আহ্বানে সাড়া দিয়েছে এদেশের বীর জনগণ; বারবার ছিনিয়ে এনেছে নিরঙ্কুশ বিজয়। জনগণের এই বিজয় সংহত করে রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক স্তরে সাংবিধানিক প্রত্যাশার প্রতিফলন ঘটাতে হবে। সংবিধান রচনার ৪২ বছর পরও সাংবিধানিক প্রক্রিয়ায় একটি ন্যায়ানুগ ও নিরপেক্ষ প্রশাসন গড়ে তোলার লক্ষ্যে প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের জন্য সংবিধানের ১৩৩ অনুচ্ছেদে সংসদে যে আইন প্রণয়ন করার কথা ছিল তা আজও পর্যন্ত করা হয়নি। রাষ্ট্রপতি কর্তৃক রুলস ও রেগুলেশনের মাধ্যমে প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের চাকরি সংক্রান্ত নীতিমালা এখনও চালু রয়েছে। সংসদ এ পর্যন্ত এ বিষয়ে কোন আইন প্রণয়ন করেনি। সংবিধানে ন্যায়পাল সৃষ্টির বিধান অনুযায়ী আইন প্রণয়ন করা হয়েছে, কিন্তু বাস্তবে তা কার্যকর করা হয়নি। সর্বোচ্চ বিচারালয়ে বিচারক নিয়োগের ক্ষেত্রে অনুচ্ছেদ ৯৫ (২-এর গ) অনুযায়ী তাদের যোগ্যতার কোন মাপকাঠি ও নিয়োগের স্বচ্ছ কোন প্রক্রিয়া নিরূপণ করা হয়নি। অতীতে প্রধান বিচারপতির সঙ্গে উপযুক্ত পরামর্শ ছাড়া বিচারক নিয়োগ সবই ছিল সাংবিধানিক ও গণতান্ত্রিক রীতিনীতির বিরুদ্ধে। ঔঁফমবং ঈধংব-এর সর্বোচ্চ আদালতের রায়ে ও সাংবিধানিক মূল্যবোধ অনুযায়ী মেধা ও যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তিকে বিচারক নিয়োগ দানের যে দিক নির্দেশনা দেয়া হয়েছে তার আলোকে বিচারক নিয়োগের ক্ষেত্রে বিচারকদের আইন ও সংবিধানের আনুগত্য সমৃদ্ধ দৃঢ় প্রত্যয় বোধ, ন্যায়বিচার, মৌলিক অধিকারের বিষয়ে মূল্যবোধ নিরূপণ নির্ধারণ প্রক্রিয়া আজও অনুপস্থিত। কারণ, বিচারক হবার যোগ্যতার মাপকাঠি এখনও পর্যন্ত নিরূপণ করা হয়নি। সংসদকে কেন্দ্র করে জনগণের যে প্রত্যাশা অতীতে তার একটিও পূরণ হয়নি এবং সংসদকে কার্যকর করার জন্য যে ন্যূনতম সহনশীলতার প্রয়োজন এবং যে সমঝোতাপূর্ণ পরিবেশ অপরিহার্য তা ছিল চরমভাবে অনুপস্থিত। কার্যকর সংসদ, সরকারের জবাবদিহিতা, আইনের শাসন, প্রশাসনের নিরপেক্ষতা, মৌলিক মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা, রাজনৈতিক দলগুলোর জাতীয় উন্নয়নে পারস্পরিক শংকামুক্ত সহযোগিতা-এর সবগুলোই শুধু বাঙালী জাতির বহুদিনের প্রতীক্ষিত প্রত্যাশাই রয়ে গেল। জাতির প্রত্যাশা ও অঙ্গীকারের দ্যোতনায় জাতীয় নেতৃবৃন্দকে দীপ্তমান হতে হবে। রাজনীতিতে প্রচলিত সীমাবদ্ধতাকে জয় করে সংবিধান ও গণতন্ত্রকে উর্ধে তুলে ধরতে হবে। মানবাধিকার ও মানবসত্তার মর্যাদা রক্ষিত হয় গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর ওপর ভিত্তি করে। সেই কাঠামো যখন ভেঙে পড়তে থাকে তখন মানবাধিকার হয় বিপন্ন। জনগণকে আবার আন্দোলন সংগ্রাম করে সেই মানবাধিকার, গণতন্ত্র ও আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে হয়। বাংলাদেশের জনগণ বারবার এমনি করে রক্ত দিয়ে, জীবন দিয়ে, ত্যাগ-তিতিক্ষা ও সংগ্রাম করে তার অধিকার অর্জন করেছে। সেই অধিকার জনগণ তুলে দেয় নির্বাচিত প্রতিনিধির কাছে; তা যখন জনগণ গচ্ছিত রাখে রাষ্ট্রপতি, মন্ত্রিপরিষদ ও নির্বাচিত সংসদে বা বিশ্বাস স্থাপন করে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানে যেমন বিচারালয়ে, নির্বাচন কমিশনে, জাতীয় কর্মকমিশনে, মহা-হিসাব নিরীক্ষকের নিয়ন্ত্রণে, অথবা রাজনৈতিকভাবে নির্ভর করে নেতা-নেত্রী ও তাদের দলীয় প্রতিশ্রুতিতে। তখন জনগণের ন্যূনতম প্রত্যাশা যে, সৃষ্টিকর্তার নামে জনগণের পক্ষে এই আমানত যারা গ্রহণ করেন তারা সেই ক্ষমতার প্রয়োগ শুধুমাত্র জনগণের পক্ষে এবং তা কেবলমাত্র জনগণের স্বার্থে এবং সংবিধানের কর্তৃত্বে কার্যকর করবেন। জনগণকে তারা সিদ্ধান্ত গ্রহণে সম্পৃক্ত ও ওয়াকিবহাল রাখবেন। স্বচ্ছ জবাবদিহিতার মাধ্যমে তারা এ গচ্ছিত আমানতের ব্যবহার করবেন। অথচ, যারা পবিত্র সংবিধানের নামে বা জনগণের পক্ষে এই শপথ নেন তাদের স্খলন গণতন্ত্র ও মানবাধিকার রক্ষণের পরিবর্তে এক নির্মম বিশ্বাসঘাতকতায় পর্যবসিত হয়। বাংলাদেশ তার সৃষ্টির ঊষালগ্নে আত্মনিয়ন্ত্রণ, মানবিক মর্যাদা ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার ও বাস্তবায়নের সংগ্রামের মহান ব্রত, আদর্শ ও লক্ষ্য নিয়ে যাত্রা শুরু করেছে। কারণ বাংলাদেশ মানবাধিকার সংগ্রামেরই ফসল। বাংলাদেশের আদর্শ, উদ্দেশ্য, স্থিতি, সমৃদ্ধি ও প্রগতি এদেশের জনগণের মানবাধিকার বাস্তবায়নের মাধ্যমে কার্যকর করা সম্ভব। এদেশের গণতন্ত্রকে স্থিতিশীল করার জন্য সংবিধানের আলোকে প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোকে একদিকে যেমন শক্তিশালী করা প্রয়োজন; অপরদিকে জনগণের জাগ্রত ও সজাগ দৃষ্টি এবং প্রশাসনের সকল পর্যায়ে জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণের মাধ্যমে উন্নয়ন সাধন ও অধিকার বাস্তবায়ন করা ছাড়া কোন বিকল্প নেই। সংবাদপত্র ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা, সঠিক তথ্য জানবার অধিকার এবং তথ্য ও যুক্তির ভিত্তিতে মতামত গঠনের পরিবেশ সৃষ্টি-জনগণের এই অধিকার প্রতিষ্ঠার পূর্বশর্ত। সন্ত্রাস, ভয়, মিথ্যা প্রচার ও ইতিহাস বিকৃত সকল প্রকার অসত্য আশ্রয়ী প্রচারমুক্ত বৈষম্যহীন সমাজ, দুর্নীতি এবং দলীয় বা ব্যক্তির প্রভাবমুক্ত আইনানুগ দক্ষ প্রশাসন, আইনের নিজস্ব গতি সৃষ্টির মাধ্যমে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার শক্তি বৃদ্ধি এবং একটি সৎ, স্বাধীন, মেধা ও মেরুদ-স¤পন্ন বিচার ব্যবস্থার মাধ্যমে জনগণের মৌলিক মানবাধিকারকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়া সম্ভব। এসব প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোকে সঠিক রূপায়ণ করার জন্য সকল স্তরের জনগণ-পেশাজীবী, বুদ্ধিজীবী ও বিশেষ করে নতুন প্রজন্মের সংঘবদ্ধ সামাজিক ঐকতান সৃষ্টিতে তাদের সক্রিয় ও সচেতন ভূমিকা অপরিহার্য। আমাদের রাষ্ট্রের অন্যতম মৌলিক দায়িত্ব পরিকল্পিত অর্থনৈতিক বিকাশের মাধ্যমে উৎপাদন শক্তির ক্রমবৃদ্ধিসাধন এবং জনগণের জীবনযাত্রার বস্তুগত ও সাংস্কৃতিক মানের দৃঢ় উন্নতিসাধন; অন্ন, বস্ত্র, আশ্রয়, শিক্ষা ও চিকিৎসাসহ জীবন ধারণের মৌলিক উপকরণের ব্যবস্থা; কর্মের অধিকার অর্থাৎ কর্মের গুণ ও পরিমাণ বিবেচনায় যুক্তিসঙ্গত মজুরি ও কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তা ঘটানো এবং বাংলাদেশের উপযুক্ত নাগরিক সৃষ্টির জন্য একই পদ্ধতির গণমুখী ও সার্বজনীন শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সমাজের প্রয়োজনের সঙ্গে শিক্ষাকে সঙ্গতিপূর্ণ করার জন্য যথাযথ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ও সদিচ্ছা প্রণোদিত নাগরিক সৃষ্টির নির্দেশ রয়েছে আমাদের সংবিধানে। আজও পর্যন্ত আমরা যথাযথ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ও সদিচ্ছা প্রণোদিত নাগরিক সৃষ্টির কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করতে ব্যর্থ হয়েছি। একবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকের মাঝপথে দাঁড়িয়ে বাঙালী জাতি এদেশের ষোল কোটি মানুষের প্রগতিশীল আশা আকাক্সক্ষা যদি বাস্তবায়ন করতে চায় তাহলে এদেশে শান্তি ও সমৃদ্ধি লাভের যে নতুন সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে তার সার্বিক সদ্ব্যবহার করতে হবে। এর জন্য প্রয়োজন অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্রিয়াকর্মে জনগণের সক্রিয় স¤পৃক্তি। গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের পূর্ণ বাস্তবায়ন এ দেশের উন্নয়নের সঠিক মাপকাঠি। প্রতিটি নাগরিকের মৌলিক অধিকার নিশ্চিতকরণ ও সব নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, সন্ত্রাস ও অপরাধমুক্ত সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবেশ সৃষ্টি অপরিহার্য। যার মাধ্যমে মৌলিক মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক ন্যায়বিচার, এ দেশের মানুষের প্রজন্ম-পর¤পরায় সাংবিধানিক প্রাপ্তিকে নিরঙ্কুশভাবে বিপন্মুক্ত রাখা সম্ভব। সাম্য, স্বাধীনতা, মানবিক মর্যাদা ও সুবিচার আমাদের স্বাধীনতার অঙ্গীকার। এসবের সঠিক অর্জন বাংলাদেশের উন্নয়নের মূল লক্ষ্য। জনগণের ক্ষমতায়নের মাধ্যমেই এই লক্ষ্য বাস্তবায়ন সম্ভব। এই ক্ষমতায়নের মূল চাবিকাঠি হলো আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা। পরিবার থেকে শুরু করে প্রাথমিক বিদ্যালয় হতে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত শিক্ষা ব্যবস্থায় নাগরিক দায়িত্ববোধ গড়ে তোলার জন্য সাংবিধানিক মূল্যবোধ সমৃদ্ধ গণতান্ত্রিক মন-মানসিকতার বিকাশ সাধনের পাশাপাশি সবার মানবিক মর্যাদার প্রতি শ্রদ্ধাবোধ সৃষ্টির জন্য উপযুক্ত সামাজিক পরিবেশ গঠন একটি অপরিহার্য কর্মসূচী হিসেবে গ্রহণ করা প্রয়োজন। মানবাধিকার বিকাশের মাঝেই বাংলাদেশের সৃষ্টি, মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেই বাংলাদেশের স্থিতি এবং মানবাধিকারের প্রকৃত বাস্তবায়নের মাধ্যমেই বাংলাদেশের সমৃদ্ধি ও প্রগতি। বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তির সনদ স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র ও বাংলাদেশের সংবিধানের প্রতি আন্তরিক ও অকৃত্রিম আনুগত্যই শুধু পারে এ দেশবাসীকে ঐক্যবদ্ধ করতে। এমন একটি ঐক্যই শুধু পারে সম্ভাবনাময় বাংলাদেশকে উন্নয়নের শিখরে পৌঁছাতে। (সমাপ্ত)
×