ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

শান্তি বা সংঘাত একটি ভবিষ্যত বিশ্লেষণ

প্রকাশিত: ০৫:২৪, ১১ নভেম্বর ২০১৪

শান্তি বা সংঘাত একটি ভবিষ্যত বিশ্লেষণ

মাসুদা ভাট্টি ॥ শান্তি ও সংঘাত নিয়ে বেশ পড়াশোনা করতে হচ্ছে, বিশেষ করে যেসব দেশে সংঘাত রয়েছে সেই সংঘাতকে কেন্দ্র করে সে দেশে যে ‘সংঘাতের অর্থনীতি’ (কনফ্লিক্ট ইকোনমি) গড়ে উঠছে সে বিষয়টি নিয়ে বিস্তারিত জানার চেষ্টা করছি। কিন্তু যতই বিষয়টি নিয়ে গভীরে যাবার চেষ্টা করছি, ততই বুঝতে পারছি যে, সংঘাতের শুরু, বিস্তার এবং স্থায়ী হওয়ার মধ্যে যোগসূত্র থাকলেও সংঘাত থেকে বেরিয়ে আসার একমাত্র পথ সদিচ্ছা। এই সদিচ্ছা ব্যক্তির, সমাজের এবং রাষ্ট্রের, সর্বোপরি জাতিগতও। আমরা ভেবে দেখতে পারি যে, যে সংঘাতের ভেতর দিয়ে ভারতবর্ষ খ--বিখ- হয়েছিল, তা অন্য কারও দ্বারা সৃষ্ট নয়, এদেশেরই ব্যক্তি মানুষ, সমাজ-মানুষ এবং রাষ্ট্র-মানুষের দ্বারাই হয়েছিল। আজকের পাকিস্তানে যে সংঘাত রাষ্ট্রটিকে গিলে খেতে বসেছে, তাও সে দেশের মানুষেরই সৃষ্ট। কিংবা কোস্টারিকা বা মধ্য আমেরিকার দেশগুলো, যারা কয়েক দশক ধরে চলা গৃহযুদ্ধ থেকে বেরিয়ে এখন ‘শান্তির ললিত বাণী’ শোনাচ্ছে পৃথিবীকে, সেখানেও মানুষের দ্বারাই শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, সংঘাতকে বাদ দিয়ে। সুতরাং, মানুষের এই অসীম ক্ষমতার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েই আজকের লেখাটি শুরু করতে চাইছি, কারণ তাতে বাংলাদেশের শান্তি ও সংঘাত বিষয়ক সমস্ত প্রশ্নের উত্তরও যে এদেশেরই মানুষ, সে কথাটি বোঝানো সহজ হবে। ১৯৪৭-এ ভারত ভাগকে যদি আমরা এই বিশাল ভারতবর্ষের মানুষের সবচেয়ে বড় ভুল হিসেবে ধরি তাহলে তার চেয়েও বড় ভুল হলো পূর্ববাংলাকে পাকিস্তানের অধীনে ছেড়ে দেয়ার কাজটি। কোনভাবেই এই ভুলকে বিশ্লেষণ করা যায় না এবং যাবেও না। জিন্নাহ্্ সাহেবের পূর্ববাংলা নিয়ে খুব বেশি আগ্রহ ছিল বলেও মনে হয় না, তবুও সংঘাতপূর্ণ রাজনীতির প্রতি তার ক্রমশ আগ্রহ তৈরি হওয়াটা প্রমাণ করে যে, পূর্ববাংলাকে পাকিস্তানের অন্তর্গত করাটা তার এক ধরনের কৌশল ছিল। নইলে ‘স্টেইটস’ থেকে ‘স্টেইট’-এ ফিরে যাওয়ার কোন ঐতিহাসিক ব্যাখ্যা জিন্নাহ্ আমাদের দেননি। অনেক বিশ্লেষকই এখন মনে করেন যে, ভারতের মানচিত্রের ভেতর পূর্ববাংলাকে পাকিস্তানের অন্তর্গত রাখতে পারলে ভারতকে দমিয়ে রাখা সহজ হবে, জিন্নাহ্কে এরকমটি হয়ত বোঝানো হয়েছিল বা তিনি বুঝেও ছিলেন। ভারত ভাগ পরবর্তী পাকিস্তানী সামরিক শাসকবর্গ এবং ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধকালে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর কর্তাব্যক্তিরা এই বিশ্লেষণকে প্রমাণ করেছেন এবং তারও পরে বাংলাদেশে পাকিস্তানী শাসকদের অনুগামী সেনা শাসক বা তদীয় গণতান্ত্রিক (!) আত্মীয়দের আমলেও আমরা প্রমাণ পেয়েছি যে, বাংলাদেশের মাটিকে ব্যবহার করে ভারতকে অস্থিতিশীল করার লক্ষ্যটি একেবারেই মিথ্যে নয়। দুঃখজনক সত্য হচ্ছে, বিংশ শতাব্দীর এই সংঘাতময় সময়ে এ দেশের নেতৃত্ব সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে ব্যর্থ হয়েছে বলেই আজকে উপমহাদেশজুড়ে সংঘাতের রাজনীতি ক্রমশ শক্তিময়তা লাভ করছে। ধর্মীয় সংঘাতকে কেন্দ্র করে উপমহাদেশ বিখ-িত হয়েও এখানে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়নি। অতীত পাপের ভারে ন্যুয়ে পড়া উপমহাদেশবাসী এখনও অশান্তির সাগরেই খাবি খাচ্ছে। পাকিস্তান বা ভারতের অশান্তি নিয়ে আলোচনা আজকের লেখার উদ্দেশ্য নয়। কথা বাংলাদেশকে নিয়েই, কিন্তু সে কথাগুলো বলতে উপরের এই কথাগুলো বলতেই হলো। বাংলাদেশে অশান্তির বিস্তৃতির সঙ্গে ভারত ভাগের প্রসঙ্গ জড়িতই শুধু নয়, বরং আমরা সেই লিগেসি থেকে এখনও বেরিয়ে আসতে পারছি না। ধর্মের ভিত্তিতে ভারত ভাগের আন্দোলনে বাঙালী রাজনৈতিক নেতৃত্ব বা সাধারণ বাঙালীদের অংশগ্রহণ বেশ ভালভাবেই ছিল। বিশেষ করে বাঙালী মুসলমান নিজেদের ভারতীয় মনে করার চেয়ে পাকিস্তানী মনে করার মধ্যে বেশি সুখ পেয়েছে। কিন্তু সে সুখ স্থায়ী হয়নি। যদিও সুখ স্থায়ী হওয়া না হওয়ার চেয়ে এদেশ থেকে পাকিস্তান আমলেই বিরাট সংখ্যক হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের উচ্ছেদ করা সম্ভব হয়েছে, সেই আনন্দে কিন্তু যথেষ্ট আনন্দিত বাঙালী মুসলমানের একটি বড় অংশ। পাকিস্তান রাষ্ট্রের সতীনপুত্র হিসেবে এদেশে হিন্দুরা টিকে থাকতে চেয়েও পারেনি, তাদের অনিশ্চিত জীবনের দিকে হাঁটতে হয়েছে কেবলমাত্র বেঁচে থাকার তাগিদে। এই তাগিদকে ভুল বুঝবার অবকাশ নেই, বিতর্ক তোলা যেতে পারে যে, তারা যদি সে সময় পাকিস্তানের মাটি আঁকড়েই পড়ে থাকত তাহলে কী হতো? উত্তরে একটি ছোট্ট গল্প শোনাই। গল্পটি সম্প্রতি শোনা। মুক্তিযুদ্ধের পর ভারতে আশ্রয় নেয়া বাঙালী হিন্দুদের মধ্যে প্রায় ২ লাখ হিন্দু পরিবার এদেশে তাদের ভিটেমাটির দখল পায়নি। ফিরে এসে দেখেছে যে, তাদের বাপ-দাদার ভিটে দখল হয়ে গেছে। তারা তখন কার কাছে আবেদন জানাবে? তারা ভারতীয় কর্তৃপক্ষের কাছেই আবেদন জানিয়েছিল যে, তাদের বাড়িঘর যেন ফিরিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করা হয়। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে ভারত থেকে আশ্রয় নেয়া বাঙালীদের ফিরিয়ে আনার জন্য একটি কমিশন গঠন করা হয়েছিল ১৯৭২ সালেই। সেই কমিশনের কাছে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ যখন সেই আবেদনগুলো দেন তখন কমিশনের একজন কর্তাব্যক্তির ভেতর জাতীয়তাবোধ (?) তীব্রভাবে জেগে উঠেছিল। তিনি স্পষ্ট করে বলেছিলেন যে, কেন এই আবেদনগুলো আপনাদের কাছে করা হলো? বাংলাদেশ একটি স্বাধীন রাষ্ট্র, এ দেশের থানা পুলিশ রয়েছে, তাদের দখল হয়ে যাওয়া ঘরবাড়ি ফিরে পেতে বাংলাদেশের থানা পুলিশের কাছে আবেদন করুক, আমরা দেখব। ১৯৭২ সালের থানা পুলিশের কথা বলছি আমরা, যখন স্বাধীন দেশটি মাত্র দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে। সেই সময় দখল হয়ে যাওয়া ঘরবাড়ি ফিরে পেতে তাদের কাছে আবেদন করার মতো মানসিক অবস্থা বোধ করি ভারত-ফেরত অধিকাংশ বাঙালী হিন্দুর ছিল না। ফল যা হবার তাই হয়েছে, স্বাধীনতার জন্য যাঁরা বাস্তুচ্যুত হয়েছিলেন, স্বাধীনতার পরেও তাঁরা বাস্তুচ্যুতই থেকে গেলেন। এরপর ’৭৫-পরবর্তী বাংলাদেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ইতিহাস আসলে বিস্তারিত বলার কিছুই নেই, সে বড় কলঙ্কময় ও পাপের ইতিহাস। আগেই বলেছি যে, সংঘাত আসলে ইতিহাসের সঙ্গে পায়ে পায়ে হাঁটে। ইতিহাস তার চলার পথে মানুষের জন্য শিক্ষণীয় অনেক কিছুই রেখে যায়, মানুষ সেগুলো ইচ্ছাকৃতভাবেই এড়িয়ে যায়। ফলে সংঘাত থেকে বেরুনো খুব সহজ হয় না। আবারও পাকিস্তানের কথা বলি। পাকিস্তান থেকে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ক্রমশ বিতাড়িত করতে করতে এখন সেখানে ধর্মীয় সংখ্যালঘু নেই বললেই চলে। কিন্তু তাতে কি পাকিস্তানের সংঘাত বন্ধ হয়েছে? বরং পাকিস্তানে এখন নতুন নতুন সংঘাতের সূচনা হয়েছে, এখন শিয়া-সুন্নি দ্বন্দ্ব এবং জঙ্গীবাদ রাষ্ট্রটিকেই বিপন্ন করে তুলেছে। অথচ সেখানে সংখ্যালঘু-নিধন যদি প্রাথমিকভাবেই থামানো যেত তাহলে আজকে হয়ত সেখানেও শান্তি প্রতিষ্ঠিত হতো, কিংবা কে জানে, হয়ত ভারতবর্ষও বিভক্ত হতো না। কিন্তু কী হলে কী হতো বা কী হতো না, তা নিয়ে এখন আর কথা বলার কিছু নেই। তবে অশান্তি আর সংঘাতের উদাহরণ হিসেবে আজ পৃথিবীব্যাপী পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের নাম বহুল ব্যবহৃত। আমার নিজের লেখাতেই আমি বহুবার বাংলাদেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার কথা বলেছি, বলেছি এভাবে তাদের এদেশ থেকে নিশ্চিহ্ন হতে বাধ্য করা হলে পাকিস্তানের মতোই বাংলাদেশেও সংখ্যাগুরু ধর্মবিশ্বাসীদের ভেতর নতুনতর সংঘাত দানা বাঁধবে। কারণ, প্রবাদে রয়েছে, কচু গাছ কাটতে কাটতে নাকি মানুষ ডাকাত হয়, তেমনই সংখ্যালঘু ধর্মবিশ্বাসীদের আঘাত করতে করতে যখন আর তাদের হাতের কাছে পাওয়া যাবে না তখন স্বধর্মে বিশ্বাসীদের ওপর আঘাত হানতেও আর দ্বিধা করবে না কেউ। এসব কথা কিন্তু নতুন কিছু নয়, বরং বহু পুরনো এবং বহুজনে বহুবার বলেছেন। কিন্তু কাজের কাজ কিছু হয়েছে বলে প্রমাণ নেই। বাংলাদেশ ক্রমশ ধর্মীয় সংখ্যালঘু-শূন্য হচ্ছে আর সংখ্যাগুরু ধর্মসম্প্রদায়ের নিজেদের ভেতর দ্বন্দ্ব-সংঘাতও সেই একই প্রক্রিয়ায় বেড়েই চলেছে। কে কার চেয়ে বড় মুসলমান, কে সঠিক কে ভুল তা নিয়ে ধর্মবাদীদের ভেতর সংঘাত ধীরে ধীরে ছড়াচ্ছে সাধারণ্যে এবং তা রাষ্ট্রের দিকে ধাবমান। শুরুতেই যে সংঘাতের অর্থনীতির কথা বলেছিলাম, আজকের বাংলাদেশে আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, একটি বিশাল অর্থনীতি সক্রিয় রয়েছে সর্বত্র, যা দিয়ে এদেশে সংঘাতকে লালন-পালন এবং বংশবৃদ্ধির সুযোগ করে দেয়া হয়। অর্থনীতিবিদ আবুল বারাকাত একে ‘মৌলবাদী অর্থনীতি’ বলেছেন, কিন্তু আমার মনে হয়; এই অর্থনীতি মূলত সংঘাতের ভেতর দিয়ে বেড়েছে এবং সংঘাতের কারণে টিকে আছে ও বৃদ্ধি পাচ্ছে। একটু তলিয়ে দেখলেই আমরা দেখতে পাই যে, আজকে যাদেরই যুদ্ধাপরাধের দায়ে বিচার করা হচ্ছে তাদের অর্থনৈতিক উত্থান মূলত স্বাধীন বাংলাদেশে। চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীদের সম্পদ খতিয়ে দেখলেই বোঝা যাবে যে, ১৯৭১ সালে দখল করা সম্পদ থেকে ক্রমশ তারা ফুলে-ফেঁপে বেড়েছে এবং তারপর রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় কেবলই তাদের বৃদ্ধি ঘটেছে। চট্টগ্রামের সাকা চৌধুরীদেরও বিপুল সম্পত্তির অনেকটাই দখল করা সম্পদ। শান্তি ও সংঘাতের সূত্র বলে যে, সংঘাতের ফলে যে অর্থনীতি তৈরি হয়, তা মূলত ব্যয়ও হয় সংঘাতকে জিইয়ে রাখতে। এর প্রমাণ আমরা দেখতে পাই যে, যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচানোর জন্য যে অর্থ খরচ করা হচ্ছে দেশে-বিদেশে তা ওই সংঘাত-অর্থনীতি থেকেই আসা। যে রাজনৈতিক দলগুলো সংঘাত সৃষ্টি করে ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য এখন কাজ করে যাচ্ছে, তাদের প্রত্যেকটিই যে সম্পদের পাহাড় তৈরি করেছে তার অনেকটাই এখন ব্যয় হচ্ছে এদেশে নতুন সংঘাত সৃষ্টির লক্ষ্যে। জঙ্গীবাদকে অনেকেই ধর্মীয় আদর্শের তকমায় মুড়ে ব্যাখ্যা করতে চান, কিন্তু ওসামা বিন লাদেনের আল কায়েদা কিংবা আইএসএসের জঙ্গীদের হাতে যে পরিমাণ অর্থ রয়েছে তা চিন্তারও অতীত। আদর্শ এখানে সেকেন্ডারি বা দ্বিতীয় স্তরে থাকলেও থাকতে পারে; কিন্তু সবার আগে এখানে সন্ত্রাসী-অর্থনীতি কাজ করছে বলে অর্থনীতিবিদরা প্রমাণও করেছেন। বাংলাদেশেও একটি জঙ্গীবাদী অর্থনীতি কাজ করছে, কাজ করছে সংঘাতের অর্থনীতি। এই অর্থনৈতিক বলয়কে ভাঙ্গা না গেলে এদেশ থেকে সংঘাত তাড়ানো সম্ভবপর হবে বলে মনে হয় না। আগামী কিস্তিতে এ বিষয়টি নিয়েই আলোচনা করার ইচ্ছে রইল। ১০ নবেম্বর, ২০১৪ [email protected]
×