ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

জন্মের পর ‘অপয়া’ আজ দুনিয়াজোড়া বাংলার মালালা

প্রকাশিত: ০৪:৫৮, ১১ নভেম্বর ২০১৪

জন্মের পর ‘অপয়া’ আজ দুনিয়াজোড়া বাংলার মালালা

শেখ আব্দুল আওয়াল, শ্রীপুর থেকে ফিরে অভাবগ্রস্ত সংসারে একটিমাত্র পুত্রের আশায় পর পর অনাকাক্সিক্ষত পাঁচ কন্যা সন্তান জন্ম নেয়। পুত্র সন্তান জন্ম দিতে ব্যর্থ হওয়ায় পাঁচ কন্যা সন্তানের মাকে ‘অপয়া’ আখ্যা দিয়ে বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করেন। কন্যাদের পড়ালেখার খরচ দিতে পারবেন না বলে বড় মেয়েকে বাল্যবিবাহ দেন। এরপর দ্বিতীয় ও তৃতীয় কন্যাকেও বাল্যবিবাহ দিয়ে বাবা চতুর্থ শিশু কন্যারও বিয়ের দিনক্ষণ ঠিক করেন। কিন্তু বাদ সাধে চতুর্থ কন্যা সাহিদা আক্তার স্বর্ণা। বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায় সে। এভাবে একবার নয়, দুইদফা নিজের বাল্যবিবাহ প- করে গ্রামে তুমুল আলোচিত হয়ে ওঠেছিল স্বর্ণা। শুধু নিজের নয়, গ্রামের যেখানেই বাল্যবিবাহ সেখানেই হানা দিত সাহিদা আক্তার স্বর্ণা। কখনও কন্যা শিশুর মা-বাবাকে বুঝিয়ে আর কখনও বা সে শিক্ষক, জনপ্রতিনিধি অথবা প্রশাসনের সহযোগিতায় প- করে দিত বাল্যবিবাহ। ৮ থেকে ১০ গ্রামের শিশুদের মধ্যে এখন সে অপার সম্ভাবনার প্রতীক। সাহিদা আক্তার স্বর্ণা গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার মাওনা ইউনিয়নের সিংদিঘী গ্রামের দরিদ্র তোতা মিয়ার কন্যা। নিজের অদম্য ইচ্ছার কাছে চরম দরিদ্রতাকেও হার মানিয়েছে স্বর্ণা। সে এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী। স্বর্ণার স্বপ্ন, গ্রামের গ-ি পেরিয়ে দেশের অবহেলিত শিশু ও নারীদের পাশে দাঁড়ানোর। সাহিদা আক্তার স্বর্ণা বর্তমানে প্ল্যান-বাংলাদেশ ইন্টারন্যাশনাল শিশু সুরক্ষা দলের সদস্য ও যুব নারী সংঘের উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করছে। গত ৭ অক্টোবর তিন দিনব্যাপী নরওয়ের রাজধানী অসলোতে অনুষ্ঠিত শিশু ও নারী বিষয়ক আন্তর্জাতিক সম্মেলনেও স্বর্ণা অংশ নেয়। সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন নরওয়ের প্রধানমন্ত্রী আর্না সোলবার্গ। সম্মেলনে স্বর্ণা তার জীবনের দুঃখগাঁথা তুলে ধরে। একই সঙ্গে তার মতোই নিপীড়িত শিশুদেরও সচেতন করে সংগ্রামী করার গল্প শুনে প্রধানমন্ত্রী আর্না সোলবার্গ তাকে বাংলার মালালা ইউসুফজাই বলে আখ্যা দেন। সাহিদা আক্তার স্বর্ণার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তার বাবা তোতা মিয়া স্রেফ সাক্ষরজ্ঞান সম্পন্ন মানুষ। মা শরিফুন নেছা পড়ালেখা করেননি। তার বাবা সব সময়ে একটি পুত্র সন্তান কামনা করেছেন। কন্যা সন্তান ছিল অনাকাক্সিক্ষত। পুত্র সন্তানের আশায় এক এক করে তারা পাঁচ বোন জন্ম নেয়। পুত্র সন্তান জন্ম দিতে ব্যর্থ হওয়ায় তার মাকে অবর্ণনীয় নির্যাতন করতেন বাবা তোতা মিয়া। বোনদের সঙ্গেও চরম দুর্ব্যবহার করতেন। পড়ালেখার খরচ দিতে পারবেন না বলে তাদের শিশু বয়সেই বিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেন তোতা। প্রথমে বড় বোন মোক্তারা আক্তারকে বাল্যবিবাহ দেন তার বাবা। এরপর মাত্র ১৪ বছর বয়সে তার ছোট বোন ইসমত আরাকেও জোরপূর্বক বিয়ে দেয়া হয়। জোরপূর্বক বিয়ে দেয়ায় ইসমত আরা স্বামীর বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়ে মাওনা চৌরাস্তা এলাকায় পোশাক কারখানায় চাকরি নিয়ে স্বাবলম্বী হন। দ্বিতীয় কন্যা রাশিদা আক্তারকেও বাল্যবিবাহ দেন তোতা মিয়া। একপর্যায়ে ২০০৫ সালে তার মা শরিফুন নেছাকে ‘অপয়া’ আখ্যা দিয়ে দ্বিতীয় বিয়ে করেন তোতা মিয়া। তখন সে মাওনা ইউনিয়নের বারোতোপা আফসার উদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণীর ছাত্রী। সাহিদা আক্তার স্বর্ণা জানায়, নবম শ্রেণীর ছাত্রী থাকাকালে পাশের চকপাড়া গ্রামের এক নির্মাণ শ্রমিকের সঙ্গে তাকে না জানিয়ে তার বিয়ের দিনক্ষণ ঠিক করে তার বাবা। সে জানতে পেরে প্রথমে তার অস্বীকৃতির কথা জানায়। তাতে কাজ না হলে সিংদিঘী সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি রেজাউল করিম রুবেল, স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) সদস্যসহ গ্রামের শিক্ষকদের ঘটনা জানায়। তার বাবা সিদ্ধান্ত না বদলালে সে তার নানা বাড়ি গিয়ে বাবার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার আকুতি জানায়। এতে তার বাল্যবিবাহ প- হয়ে যায়। এরপর তার পড়ালেখার খরচ দিতে না চাইলে সে প্রতিবেশীদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে শিশুদের পড়িয়ে তার পড়ালেখার খরচ জোগাতে থাকে। ২০১০ সালে কৃতিত্বের সঙ্গে এসএসসি পাস করে স্বর্ণা। এরপর আবারও তাকে বিয়ে দিতে উঠেপড়ে লাগে তার বাবা। পোশাক কারখানার এক শ্রমিকের সঙ্গে তার বিয়ের দিন-ক্ষণও ঠিক করা হয়। এবার তার বাবার সঙ্গে যোগ দেয় তার বড় ভগ্নিপতি। সে রাজি না হওয়ায় তার বাবা তাকে মারধরও করেন। কিন্তু তার অমতে বিয়ে দিলে সে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের হুমকি দেয়। এতে পিছু হটে তার বাবা ও ভগ্নিপতি। সাহিদা আক্তার স্বর্ণা আরও জানায়, দুইদফা সে নিজের বিয়ে প- করায় গ্রামে নানা কথা রটে। কেউ বলেন, ‘মেয়ের অন্য কারও সঙ্গে গভীর প্রেম রয়েছে’। কেউ-বা বলেন, ‘এ কেমন জাতের মেয়ে!’ এরই মধ্যে প্রতিবেশী এক শিশুর বাল্যবিবাহের খবর জেনে সে ছুটে গিয়ে অভিভাবকদের বিয়ে বন্ধ করার আহ্বান জানায়। সে ব্যর্থ হওয়ার পর শ্রীপুর উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তাকে ঘটনা জানায়। পরে উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা বিলকিস নাহার পুলিশসহ ঘটনাস্থলে গিয়ে বাল্যবিবাহ প- করে দেন। স্বর্ণা জানায়, এভাবে গ্রামে একের পর এক বাল্যবিবাহ প- করে দেয় সে। কিন্তু গ্রামে সচেতনতা সৃষ্টির জন্য সিংদিঘী গ্রামে শিশুদের নিয়ে গড়ে তোলে ‘সূর্যমুখী শিশু ক্লাব’। পাশাপাশি সে অন্তর্ভুক্ত হয় প্ল্যান বাংলাদেশ ইন্টারন্যাশনালের শিশু সুরক্ষা প্রকল্পে। প্ল্যান বাংলাদেশ ইন্টারন্যাশনালের উদ্যোগে গত ২০১২ সালে মাওনা ইউনিয়ন শিশু ফোরামের সভাপতি নির্বাচিত হয় সে। স্বর্ণা জানায়, শিশুদের ছয়টি মৌলিক অধিকার খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা ও বিনোদন বিষয়ে সচেতন করে তুলতে সে তার সংগঠনের শিশুদের নিয়ে ইউনিয়নের প্রতিটি গ্রামের ঘরে ঘরে গিয়েছে। বাড়িয়েছে সচেতনতা। স্বর্ণা দৃঢ় আশা প্রকাশ করে জানায়, সে শুধু তার ইউনিয়নেই নয়, সারাদেশে ঘরে ঘরে শিশুদের সচেতনতা বাড়াতে কাজ করতে চায়। বাল্যবিবাহসহ নারী নির্যাতন প্রতিরোধে সারাদেশে বিপ্লব ঘটাতে চায় সে। প্ল্যান বাংলাদেশ ইন্টারন্যাশনালের উদ্যোগে গত ৭ অক্টোবর সাহিদা আক্তার স্বর্ণা নরওয়ের অসলোতে অনুষ্ঠিত শিশু ও নারীবিষয়ক সম্মেলনে যোগ দেয়। ওই সম্মেলনে ১৩টি দেশের ৩২ জন শিশু ও নারী প্রতিনিধি অংশ নিয়েছিল। সম্মেলনে নরওয়ের প্রধানমন্ত্রী আর্না সোলবার্গও উপস্থিত ছিলেন। প্ল্যান বাংলাদেশ ইন্টারন্যাশনালের মিডিয়া অফিসার বিপ্লবী রায় জানায়, দিনভর উপোস দিয়ে বিদ্যালয়ে যাওয়াসহ নিজের পড়ালেখার খরচ জোগানোর সংগ্রামী জীবন বেছে নিয়েছে স্বর্ণা। দরিদ্রতা আর ঘরের নিপীড়ন তাকে সংগ্রামী হিসেবে গড়ে তুলেছে বলেও সম্মেলনে জানায় সে। স্বর্ণার দুঃখগাঁথা শুনে সম্মেলনে যোগ দেয়া সব শিশু ও নারী আবেগআপ্লুত হয়ে পড়েন। সম্মেলনে সাহিদা আক্তার স্বর্ণাকে বিশ্বের সবচেয়ে কনিষ্ঠ নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী মালালা ইউসুফজাইয়ের সঙ্গে তুলনা করে নরওয়ের প্রধানমন্ত্রী আর্না সোলবার্গ বলেন, ‘স্বর্ণা হলো বাংলার মালালা ইউসুফজাই।’ নরওয়ের অসলোতে অনুষ্ঠিত স্বর্ণার সফরসঙ্গী ছিলেন প্ল্যান বাংলাদেশ ইন্টারন্যাশনালের শিশু সুরক্ষা প্রকল্পের সমন্বয়কারী নার্গিস বেগম। নার্গিস বেগম জানান, ইবপধঁংব ও ধস ধ মরৎষ এবং ঙংষড় ঋৎববফড়স ভড়ৎঁস ঈড়হভবৎবহপব এ বাংলাদেশের প্রতিনিধি হিসেবে সাহিদা আক্তার স্বর্ণা বক্তব্য দেয়। গত ২৪ অক্টোবর নরওয়ে থেকে তারা দেশে ফেরেন। সাহিদা আক্তার স্বর্ণা জানায়, দারিদ্র্য, কুসংস্কার আর শিক্ষার অভাবে অনেক অভিভাবক শিশুদের পীড়নের কারণ। ওই সব ঘরে নিগৃহীত শিশুদের সচেতন হতে হবে। প্রত্যেক শিশুকেই মনে রাখতে হবে, ‘আমার ভেতর রয়েছে অপার সম্ভাবনা। নিজের উদাহরণ টেনে সাহিদা আক্তার স্বর্ণা জানায়, পারিবারিক বাধা উপেক্ষা করে সে এখন গাজীপুরের চান্দনা ভাওয়াল বদরে আলম বিশ্বদ্যিালয় কলেজ থেকে প্রাণিবিদ্যা বিভাগের সম্মান প্রথম বর্ষের ছাত্রী। পাঁচটি টিউশনি করে সে তার নিজের পড়ালেখার খরচ জোগায়। সাহিদা আক্তার স্বর্ণার মা শরিফুন নেছা জানান, কয়েক বছর আগেও স্বর্ণাকে নিয়ে আশঙ্কা ছিল। তাঁর ভাষায়, ‘ভাইব্যা ভাইব্যা আমার ডর করতো। ভাইবতাম আমার মাইয়াডা অত সাহসী অইলো ক্যামনে! অহন আমিও তার লগে সাহসী অইয়া গেছি। আমার মতনই আরও ৮-১০টা গ্রামের শিশু পোলাপাইনও সাহসী অইয়া গেছে। আমরা সবাই আমগর অধিকার জানি। পতিরবাদ করতারি।’ সাহিদা আক্তার স্বর্ণার বাবা তোতা দ্বিতীয় স্ত্রীর বাড়ি ঘরজামাই হিসেবে থাকেন। স্বর্ণা প্রসঙ্গে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘আমি স্বর্ণার জন্য দোয়া করি, ও-একদিন অনেক বড় অইব। অহন আমি আমার ভুল বোঝবার পারি।’ মাওনা ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা ফজলুল হক জানান, সমাজ উন্নয়নে অসামান্য অবদান রেখেছেন যে নারী ক্যাটাগরিতে ২০১৩ সালে সাহিদা আক্তার স্বর্ণা শ্রীপুর উপজেলার সেরা নারী নির্বাচিত হয়। তিনি আশা প্রকাশ করে বলেন, ‘স্বর্ণা একদিন আমাদের সমাজ বদলে দেবে। সে অসংখ্য শিশুর অপার সম্ভাবনা।
×