ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

নতুন ধানে দাম পেয়ে খুশি কৃষক

উত্তরাঞ্চলের ৮ জেলায় রোপা আমনের বাম্পার ফলন

প্রকাশিত: ০৪:৫৩, ১১ নভেম্বর ২০১৪

উত্তরাঞ্চলের ৮ জেলায় রোপা আমনের বাম্পার ফলন

নিজস্ব সংবাদদাতা, লালমনিরহাট, ১০ নবেম্বর ॥ লালমনিরহাটসহ উত্তরাঞ্চলের ৮টি জেলায় রোপা আমনের বাম্পার ফলন হয়েছে। কৃষক ধানের ন্যায্যমূল্য পেয়ে খুশি। আবার শ্রমজীবী ও স্বল্প আয়ের মানুষ কম দামে চাল কিনতে পেরেও খুশি। বিদেশে চাল রফতানির সিদ্ধান্তের পরেও বাজারে চালের দাম স্থিতিশীল রয়েছে। লালমনিরহাটসহ উত্তরাঞ্চলের ৮টি জেলায় এবারের রোপা আমন মৌসুমে প্রাকৃতিক বিপর্যয় খরা ও বন্যার পরও রোপা আমন ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে। কৃষক প্রতিমণ নতুন মোটা ধান বাজারে বিক্রয় করছে সাড়ে ৭ শত টাকায়। তৃণমূল পর্যায়ের কৃষক ধানের ন্যায্যমূল্য পেয়ে দারুণ খুশি। তবে রোপা আমন ধান চাষে প্রাকৃতিক বিপর্যয় খরা ও বন্যা দুইটিই কৃষক মোকাবেলা করেছে। তাই উৎপাদন খরচ একটু বেশি হয়েছে। ধানের মৌসুমের শুরুতেই কৃষির ওপর নির্ভর কৃষক পরিবারগুলো ধানের দাম পেয়েছে। তাই উত্তরাঞ্চলের গ্রামে গ্রামে এবারে নবান্নের আনন্দ দ্বিগুণ বেড়ে গেছে। আবার বাজারে নতুন ও পুরাতন মোটা চালের সরবরাহ তুলনামূলক প্রচুর রয়েছে। তাই বাজারে চালের সরবরাহ বেশি বেশি থাকায় উন্নতমানের ভাল মোটা চাল ২৬ টাকা কেজিতে খুচরা দরে বিক্রি হচ্ছে। এতে করে শ্রমজীবী, দিনমজুর, নিম্নবিত্ত কৃষক ও স্বল্প আয়ের মানুষ কম দামে বাজার হতে তার পারিবারিক চাহিদা মতো চাল ক্রয় করতে পেরে দারুণ খুশি। এতেই বোঝা যায় দেশ অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। দেশের মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত হতে যাচ্ছে। সরকার দেশের মানুষের খাদ্য চাহিদা স্থিতিশীল রাখতে ও আপদকালীন মজুদ বাড়াতে প্রায় ৩ লাখ মেঃ টন মোটা চাল চলতি রোপা আমন মৌসুমে ক্রয় করবে। সরকারীভাবে মোটা চাল ক্রয়ে কেজি প্রতি দাম নির্ধারণ হয়েছে ৩২ টাকা দরে। সাধারণত বিগত দিনে দেখা গেছে। সরকার চাল ক্রয়ের ঘোষণা দিলে চালের বাজারে প্রভাব পড়ে। সঙ্গে সঙ্গে চালের দাম বৃদ্ধি পায়। এবারে তার উল্টোটা হয়েছে। চালের বাজার দর নিম্নমুখী ও স্থিতিশীল রয়েছে। ব্যবসায়ীরা বাজার হতে চাল কম দামে সংগ্রহ করে সরকারের কাছে বেশি দামে বিক্রয় করতে পারবে। এতে কয়েক বছরের তুলনায় মিলচাতাল মালিকগণ অল্পপুঁজি বিনিয়োগ করে ভাল লাভ করতে পারবে। এতে করে চাল ব্যবসায়ীরাও তাদের বিগত দিনের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পেরে দারুণ খুশি ও উজ্জীবিত। স্বাধীনতার ৪৩ বছর পর এবারেই ধানের ও চালের বাজার নিয়ে ব্যবসায়ী, কৃষক ও সাধারণ খেটে খাওয়া দেশের মানুষ খুশি। চাষী ধানের প্রকৃত মূল্য পেয়ে খুশি। স্বল্প আয়ের তৃণমূল পর্যায়ের মানুষ বাজারে কমমূল্যে চাল কিনতে পেয়ে খুশি। আবার চাল ব্যবসায়ীরা সরকারের কাছে ৩২ টাকা দরে চাল বিক্রি করে লাভের মুখ দেখতে পেয়ে খুশি। লালমনিরহাট জেলা কৃষি অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, এবারে রোপা বোরো মৌসুমের শুরুতে প্রথম পর্যায়ে তৃণমূল কৃষক ধানের চারা রোপণ করার সময় খরার কবলে পড়েছিল। আবার রোপা আমনের মৌসুমের একমাস অতিবাহিত হওয়ার পর ৩ দফা বন্যার কবলে রোপা আমন ধানের ক্ষেত তলিয়ে গিয়েছিল। এতে করে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে রোপা আমন ধানের উৎপাদন ঝুঁকির মধ্যে পড়ে। এই চিত্র গোটা উত্তরাঞ্চলের ৮টি জেলার। তাই রোপা আমন ধান চাষ করতে তৃণমূল পর্যায়ে কৃষকের কিছুটা উৎপাদন খরচ বেড়ে যায়। কিন্তু কৃষকের কঠোর পরিশ্রম, বুদ্ধিমত্তা, লাগসই প্রযুক্তি ও আধুনিক কৃষি প্রযুক্তি ব্যবহার করে ধান উৎপাদনে বিপর্যয় ঠেকিয়ে দিয়েছে। বন্যার পানি দ্রুত নেমে গেলে। ক্ষতিগ্রস্ত রোপা আমন ধানের চারা পুনরায় রোপণ করে কৃষক। ফলে ধান উৎপাদন শেষ পর্যন্ত বিপর্যয়ের হাত হতে রক্ষা পায়। ধান উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যাবে বলে আশা করা হচ্ছে। উত্তরাঞ্চলে ৮টি জেলায় রোপা আমনের বাম্পার ফলন হয়েছে। কৃষকের ঘরে ঘরে নবান্নের উৎসব শুরু হয়েছে। ঘুরে দাঁড়িয়েছে গ্রামীণ কৃষি অর্থনীতি। এবারে রোপা আমন মৌসুমে লালমনিরহাট জেলায় রোপা আমন ধান চাষের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৮০ হাজার পাঁচ শত তেশট্টি হেক্টর জমি। উৎপাদন ধরা হয়েছিল দুই লাখ কুড়ি হাজার একশত কুড়ি মেঃ টন চাল। কিন্তু এই জেলায় ধান চাষের লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। রোপা আমন ধানের চাষ হয়েছে ৮১ হাজার একশত পাঁচ হেক্টর জমি। মৌসুম শেষ না হওয়ায় এখনো চাল উৎপাদনের পরিমাণ নির্ণয় করা হয়নি। তবে চাল উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যাবে বলে কৃষি বিভাগ আশা করছে। ধান কাটা-মাড়াই শেষ হলে চাল উৎপাদনের পরিমাণ কৃষি বিভাগ নির্ণয় করবে। রোপা আমন মৌসুমের শেষে চাল উৎপাদনের তথ্য সংগ্রহ করা হবে বলে জানান। তবে এই জেলা হতে এবারে সরকারীভাবে প্রায় ৪ হাজার ৬ শত ৮৭ মেঃ টন চাল ক্রয় করা হবে বলে জানা গেছে। সরকার দেশের মানুষের খাদ্য নিশ্চয়তা নিশ্চিত ও আপদকালীন খাদ্য সরবরাহ স্থিতিশীল রাখতে ৩২ টাকা কেজি দরে সরকারী খাদ্য অধিদফতরের মাধ্যমে প্রায় ৩ লাখ মেঃ টন মোটা চাল সারাদেশের বাজার হতে ক্রয় করে গোডাউনে মজুদ করে রাখবে। এ ছাড়াও এবারেই প্রথম সরকার শ্রীলংকায় ৫০ হাজার মেঃ টন চাল রফতানি করার সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করেছে। এতে করে স্বাধীনতার ৪৩ বছর পর খাদ্য শস্য আমদানির দেশ হতে বেরিয়ে এসে খাদ্য শস্য রফতানির দেশে নাম লিখিয়েছে। খাদ্য শস্য চাল রফতানির সিদ্ধান্তে অর্থনীতিবিদগণ, খাদ্য শস্য নিয়ে গবেষণাকারী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানগুলো আশঙ্কায় ছিল। তারা অনুধাবন করে ছিল চাল রফতানির সিদ্ধান্তে দেশের স্থানীয় বাজারে চালের দাম বৃদ্ধি পেতে পারে। যার প্রভাব স্বল্প আয়ের মানুষের মধ্যে পড়তে পারে। কিন্তু সেই আশঙ্কা মুক্ত রয়েছে। দেশের সাধারণ মানুষের আয়ের ওপর নির্ভরশীল স্থানীয় বাজার ও তৃণমূল পর্যায়ের খুচরা বাজারে মোটা চালসহ সকল ধরনের চালের বাজার তুলনামূলকভাবে বিগত কয়েক বছরের তুলনায় অনেক কম রয়েছে। বিগত বিএনপি-জামায়াত সরকারের আমলে দেশের মানুষের আয়ের চেয়ে চালের দাম অনেক বেশি ছিল। সারা দেশে নীরব দুর্ভিক্ষাবস্থা চলছিল। সেই তুলনায় শ্রমজীবী, দিনমজুর ও নিম্নবিত্তরা অনেক ভাল আছে। সেই সময় সরকার বিদেশ হতে বেশিদামে চাল ক্রয় করে কমদামে খোলা বাজারে বিক্রয় করে মানুষকে সহায়তা করেছিল। তারপরেও দুর্ভিক্ষাবস্থা দূর করতে পারেনি। লালমনিরহাটের রাজপুরে না খেয়ে নিম্নবিত্ত কৃষক কান্দুরা (৪৫) মারা গেছে। এমনভাবে কুড়িগ্রামসহ উত্তরাঞ্চলে মানুষ না খেয়ে মারা গেছে। আশ্বিন-কার্তিক মাসে উত্তরাঞ্চলের মানুষকে মঙ্গায় পড়তে হতো। এখন আর সেই অবস্থা নেই। মঙ্গা নামের অভিশাপ উধাও হয়ে গেছে। অথচ দেশের জমি এক ইঞ্চিও বাড়েনি। বরং জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। খাদ্য চাহিদা বৃদ্ধি পেয়েছে। দেশ এখন খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়েছে। উত্তরাঞ্চলের প্রতিটি জেলায় খাদ্য উদ্বৃত রয়েছে। কৃষি বিভাগের এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে শুধুমাত্র লালমনিরহাট জেলায় প্রায় ১৬ লাখ মানুষের জন্য যে, পরিমাণ খাদ্য (চাল) প্রয়োজন। তার চেয়ে প্রায় ২ লাখ ৬ হাজার ২০৯ মেঃ টনঃ চাল উৎপাদন উদ্বৃত্ত রয়েছে।
×