ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

কাস্টমস ফাঁকি দিয়ে যে সব সোনা দেশে ঢোকে তার গন্তব্য কেউ জানে না বিভিন্ন সময়ে আটক সোনার ১২শ’ কেজি বাংলাদেশ ব্যাংকের ভল্টে

চোরাইপথে দেড় বছরে এসেছে ১৮ মণ ॥ সোনা কোথায় যায়

প্রকাশিত: ০৪:৫২, ১১ নভেম্বর ২০১৪

চোরাইপথে দেড় বছরে এসেছে ১৮ মণ ॥ সোনা কোথায় যায়

রহিম শেখ ॥ প্রতিদিনই দেশের বিমান ও স্থলবন্দর কিংবা বিভিন্ন চোরাইপথে আসা সোনা আটক হচ্ছে। সম্প্রতি তোলা বা কেজির হিসেবেও নয়, মণকে মণ সোনার চালান এসেছে বাংলাদেশে। গত দে’ড় বছরের বেশি সময়ে ১৮ মণেরও বেশি সোনা আটক করা হয়েছে। যে হারে সোনা আসছে, প্রায় সে হারে আটকও হচ্ছে। কিন্তু প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, আটকের পর সোনাগুলো যাচ্ছে কোথায়? উত্তর, আটক হওয়া স্বর্ণের গন্তব্য বাংলাদেশ ব্যাংকের ভল্ট। কিন্তু যেসব স্বর্ণ কাস্টমস কর্মকর্তাদের চোখ পাখি দিয়ে চলে যাচ্ছে, সেগুলোর গন্তব্য কোথায়? সম্প্রতি বড় বড় সোনার চোরাচালান আটকের পর এমনসব প্রশ্ন উঠেছে জনমনে। এদিকে স্বর্ণ আটক ও উদ্ধারের সংখ্যার ধারেকাছেও নেই মামলার সংখ্যা। সরকারী পুরস্কারের লোভে একশ্রেণীর কাস্টমস কর্মকর্তা মামলা করতে অনীহা প্রকাশ করেন বলে জানা গেছে। বিভিন্ন সময়ে সোনা পাচারের অর্ধশতাধিক মামলা প্রায় ধামাচাপা পড়ে গেছে। কোনটির অগ্রগতি শূন্যের কোঠায়। ফলে বরাবরের মতো আড়ালেই থাকছে চোরাচালান সিন্ডিকেটের সদস্যরা। জানা গেছে, গত বছরের ২৪ জুলাই দেশের বৃহত্তম স্বর্ণ চোরাচালানের ঘটনা ধরা পড়ে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে। কাঠমান্ডু থেকে আসা বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের একটি এয়ারক্রাফট থেকে দুপুর ২টার দিকে ১ হাজার ৬৫টি স্বর্ণের বার উদ্ধার করা হয়। কেজির হিসেবে এই স্বর্ণের ওজন দাঁড়ায় ১২৪ কেজি ২১৬ গ্রাম। তিন মণ চার কেজি পরিমাণের এ সোনার বাজারমূল্য ছিল প্রায় ৫৪ কোটি টাকা। তবে চলতি বছর সবচেয়ে বড় ও দেশের ইতিহাসে দ্বিতীয় বৃহত্তম স্বর্ণের চালান ধরা পড়ে গত এপ্রিলে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে। দুবাই থেকে আসা বাংলাদেশ বিমানের একটি ফ্লাইটে তল্লাশি চালিয়ে এর টয়লেটের ভেতর থেকে ১০৬ কেজি স্বর্ণ উদ্ধার করেন কাস্টমস গোয়েন্দারা। এই সোনার বাজারমূল্য প্রায় সাড়ে ৪৭ কোটি টাকা। একটি-দুটি বড় উদাহরণ ছাড়া প্রায় প্রতিদিনই ধরা পড়ছে স্বর্ণের চালান। এভাবে স্বর্ণ চোরাচালান অতীতের যেকোন সময়ের চেয়ে এখন বেড়েছে। শুল্ক গোয়েন্দা অধিদফতর সূত্রে জানা যায়, ২০১৩ সালের এপ্রিল থেকে ২০১৪ সালের ১৮ অক্টোবর পর্যন্ত ২২ মাসে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতরের হিসাবে আটক সোনার পরিমাণ সর্বমোট ৬৩০ কেজি ৮৭৪ গ্রাম বা ১৮ মণ ২ কেজি ৮৭৪ গ্রাম। এটা গত পাঁচ বছরে জব্দ করা স্বর্ণের চেয়ে ২০ কেজি বেশি। এই সময়ে আটককৃত স্বর্ণের বাজারমূল্য প্রায় ৩শ’ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, বিভিন্ন সময়ে দেশের বাইরে থেকে চোরাইপথে আসা আটক প্রায় ১২শ’ কেজি সোনা এখন বাংলাদেশ ব্যাংকে জমা রয়েছে । এর মধ্যে নিলাম হওয়া প্রায় ২৫৯ কেজি সোনা আন্তর্জাতিক বাজারমূল্যে ক্রয় করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক; যা তাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে যোগ হয়েছে। বাকি প্রায় ৭৯০ কেজি সোনা ব্যাংকের ভল্টে অস্থায়ী খাতে জমা আছে। সূত্রে জানা যায়, যে কোন সংস্থার হাতে সোনা আটক হলে সেটি সরাসরি দ্রুততম সময়ের মধ্যেই জমা করতে হয় বাংলাদেশ ব্যাংকে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর), বাংলাদেশ ব্যাংক ও শুল্ক গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তারা বলেছেন, সোনা আটক ও সংরক্ষণ এমন এক কঠোর প্রক্রিয়ায় হয় যে, পরিমাণ ও গুণগত মানে সামান্যও কমবেশি হওয়ার সুযোগ নেই। কারণ কাস্টমস, শুল্ক গোয়েন্দা বা পুলিশ-বিজিবি যারাই সোনা আটক করুক; সেটি একাধিক সংস্থার উপস্থিতি, প্রমাণপত্র ও স্বচ্ছতাসাপেক্ষে দ্রুততম সময়ের মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকে জমা দিতে হয়। পরে পাঠানো হয় বাংলাদেশ ব্যাংকের ভল্টে। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের ফরেক্স রিজার্ভ এ্যান্ড ট্রেজারি ম্যানেজমেন্ট বিভাগের মহাব্যবস্থাপক কাজী ছাইদুর রহমান জনকণ্ঠকে জানান, আটক করা গোল্ড কেন্দ্রীয় ব্যাংকে আসার পর সঙ্গে সঙ্গে তা ভল্টে ঢোকানো হয়। এর পর আটক করা গোল্ডের মামলা নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত তা ভল্টেই থাকে। মামলা শেষ হলে সরকার এই সোনা বাজেয়াপ্ত করে। এর পর দুটি প্রক্রিয়ায় এর ভাগ্য নির্ধারণ হয়। প্রথমটি হচ্ছে, বাজেয়াপ্ত করা সোনা নিলামে তোলা হয়। বিক্রি করা টাকা সরকারের কোষাগারে জমা হয়। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক যদি মনে করে, তার রিজার্ভে সোনা যোগ করবে, আর সেই সোনার গ্রেড যদি আন্তর্জাাতিক মানের হয়, তাহলে তা আন্তর্জাতিক বাজারদরে কেন্দ্রীয় ব্যাংক কিনে নেয়। সেই সোনা তখন রিজার্ভে জমা হয়। সম্প্রতি মালিকানা না থাকা আন্তর্জাতিকমানের ২৫৯ কেজি সোনা বাংলাদেশ ব্যাংক কিনে রিজার্ভে রেখেছে বলে জানা গেছে। এছাড়া সোনা নিলাম কমিটিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক, অর্থ মন্ত্রণালয়, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও এনবিআর থেকে একজন করে প্রতিনিধি থাকেন। মামলা নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত আটক সোনা বাংলাদেশ ব্যাংকের কারেন্সি শাখার অধীনে ভল্টে অস্থায়ী খাতে জমা থাকে। নিলাম কমিটি বিক্রীত টাকা নিয়ে সরকারী কোষাগারে জমা দেয়। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে আরও জানা গেছে, আটক সোনা বাংলাদেশ ব্যাংকের কারেন্সি ও ফরেন রিজার্ভ এ্যান্ড ট্রেজারি ম্যানেজমেন্ট বিভাগের ভল্টে পাঁচ-ছয় স্তরে নিরাপত্তা বেষ্টনী থাকে। সিসিটিভি ক্যামেরায় সর্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণ, স্বয়ংক্রিয় স্ক্যানার, নিরাপত্তারক্ষীসহ কিছু কঠোর নিয়ম রয়েছে সেখানে। ওই ভল্টের কাছে ইচ্ছা করলেই কেউ যেতে পারবে না। এমনকি বাংলাদেশ ব্যাংকের গবর্নরকেও সেখানে যেতে গেলে কিছু নিয়ম নেমে যেতে হবে। যে বিভাগের আওতায় এটি রয়েছে সে বিভাগের প্রধানের ক্ষেত্রেও একই নিয়ম। আরও কঠোর ব্যবস্থাপনা হচ্ছেÑ ওই বিভাগের ভেতরে ভল্টের কোন কাজেই সংশ্লিষ্ট বিভাগের কোন কর্মকর্তা-কর্মচারী গেলেও নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই তাকে আবার বের হয়ে আসতে হবে। অন্যথায় স্বয়ংক্রিয়ভাবে কয়েক স্তরের দরজা বন্ধ হয়ে যাবে। ভেতরে ওই ব্যক্তি মারা গেলেও সেটি আর খোলা হবে না। ঠিক পরবর্তী সময়ে যখন ভল্ট এলাকার দরজা খোলার সময় হবে তখনই খুলবে। শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, বেশিরভাগ সোনারই চোরাচালান আসছে দুবাই থেকে। এছাড়া আসছে সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, ব্যাঙ্ককসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশ থেকে। বাংলাদেশ-ভারতসহ অনেক দেশেই সোনা আমদানিতে শুল্কহার অনেক বেশি হওয়ায় চোরাইপথে বেশি সোনা আনা হচ্ছে। যে পরিমাণ সোনা আসছে সে পরিমাণ চাহিদা নেই বাংলাদেশে। চোরাচালানের বেশিরভাগ সোনা পাচার হচ্ছে ভারতসহ অন্যান্য দেশে। আকাশপথে যে সোনা দেশে আসছে, তা আবার স্থলপথ হয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। চাঁপাইনবাবগঞ্জের সোনামসজিদ বন্দর, যশোরের বেনাপোল, আখাউড়া ও হিলি স্থলবন্দর দিয়ে সবচেয়ে বেশি সোনার চালান পাচার হচ্ছে বলে তথ্য রয়েছে। সোনা চোরাকারবারিরা বাংলাদেশকে পাচারের ট্রানজিট রুট হিসেবে ব্যবহার করছে। অনুসন্ধানে জানা গেছে, এই সোনা চোরাচালানে দেশী-বিদেশী শক্তিশালী চক্র জড়িত। এমনকি বাংলাদেশ বিমান, সিভিল এ্যাভিয়েশনসহ বিভিন্ন সংস্থার লোকজনও জড়িত বলে জানা গেছে। এর আগে এমন কেউ কেউ গ্রেফতারও হয়েছে। বতর্মানে সোনা চোরাকারবারিরা নতুন নতুন কৌশলে তাদের তৎপরতা চালাচ্ছে। এয়ারপোর্ট আর্মড পুলিশসহ বিমানবন্দরের অন্য সংস্থাগুলোও চোরাচালান আটকে সক্রিয়। এদিকে সোনা চোরাচালানের সঙ্গে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বাহকরা ধরা পড়ছেন। মূল হোতারা বরাবরই থেকে যাচ্ছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। তারা বিদেশে বসেই তাদের এজেন্ট দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করছে সোনা চোরাকারবার। সংশ্লিষ্টরা জানান, সোনা পাচারের অর্ধশতাধিক মামলা প্রায় ধামাচাপা পড়ে গেছে। তদন্তের তেমন কোন অগ্রগতি নেই। সোনা চোরাচালানের সর্বোচ্চ শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদ-। কিন্তু এমন শাস্তি প্রায় কাউকেই ভোগ করতে হয় না। কাস্টমস বিভাগের তথ্যমতে, গত এক বছরে স্বর্ণ আটকের শতাধিক ঘটনায় মামলা হয়েছে মাত্র ৫৮টি। বাকিগুলোর কোন হিসাব থানায় নেই। বড় বড় চালানের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা ধরা পড়লেও তারা পার পেয়ে যাচ্ছে সহজেই। অনুসন্ধান বলছে, চোরাচালান আটকের জন্য সরকার ঘোষিত পুরস্কারের লোভেই একশ্রেণির কাস্টমস কর্মকর্তা কোন মামলায় যাচ্ছেন না। এতে তারা অল্প সময়ের মধ্যেই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কোষাগার থেকে ১০ শতাংশ পুরস্কারের হিস্যা পেয়ে যাচ্ছেন। জানা যায়, স্বর্ণ চোরাচালান অতীতের যেকোন সময়ের চেয়ে এখন বেড়েছে। এভাবে স্বর্ণ চোরাচালান বেড়ে যাওয়ায় এপ্রিলের শেষদিকে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড স্বর্ণ আমদানির শুল্ক ৬০ গুণ বাড়িয়েছে। এনবিআর বৈধপথে আমদানি করা প্রতিভরি (১১ দশমিক ৬৬ গ্রাম) স্বর্ণ আমদানিতে শুল্ক বাড়িয়ে ৯ হাজার টাকা নির্ধারণ করেছে, যা আগে ছিল মাত্র ১৫০ টাকা। প্রতিবেশী ভারত সরকার সম্প্রতি স্বর্ণ আমদানিতে উচ্চ শুল্কহার আরোপ করেছে। এরপর থেকেই বাংলাদেশ দিয়ে স্বর্ণ চোরাচালান বেড়ে যায়। কারণ বাংলাদেশে স্বর্ণ আমদানি শুল্ক অনেক কম। এ সুযোগ গ্রহণ করতে ভারতীয় ব্যবসায়ীরা বাংলাদেশের রুট ব্যবহার করে অবৈধভাবে সেদেশে স্বর্ণ নিয়ে যাচ্ছেন। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতির (বাজুস) সাধারণ সম্পাদক ডাঃ দেওয়ান আমিনুল ইসলাম শাহীন জনকণ্ঠকে বলেন, এটা ঠিক, ভারতের চেয়ে আমাদের দেশে স্বর্ণ আমদানি শুল্ক অনেক কম। আর এ সুযোগ নিচ্ছেন পার্শ্ববর্তী দেশের ব্যবসায়ীরা। বাংলাদেশ সরকার সম্প্রতি আমদানি শুল্ক বাড়িয়েছে। কিন্তু এখনও তা কার্যকর হয়নি। কেবল শুল্ক বাড়ালেই হবে না, স্বর্ণ চোরাচালান রোধে দরকার একটি পূর্ণাঙ্গ স্বর্ণ নীতিমালা। আমরা দীর্ঘদিন ধরে এই নীতিমালা বাস্তবায়নের দাবি জানিয়ে আসছি। অসংখ্যবার আবেদনপত্র দিয়েছি শিল্প মন্ত্রণালয়ে, কিন্তু আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় তা আজও বাস্তবায়ন হয়নি। আমরা দ্রুত এই নীতিমালা ও তার বাস্তবায়ন চাই।
×