ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

দুর্নীতি মামলায় হাজিরা দিলেন খালেদা, সাক্ষ্য গ্রহণ হয়নি

প্রকাশিত: ০৫:২৩, ১০ নভেম্বর ২০১৪

দুর্নীতি মামলায় হাজিরা দিলেন খালেদা, সাক্ষ্য গ্রহণ হয়নি

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ জিয়া দাতব্য ট্রাস্ট ও জিয়া এতিমখানা ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলার পরবর্তী তারিখ ২৪ নবেম্বর নির্ধারণ করলেন বিশেষ আদালত-৩ এর বিচারক বাসুদেব রায়। নির্ধারিত তারিখে এই দুই মামলার বাদী দুদকের উপপরিচালক হারুন অর রশিদের সাক্ষ্যগ্রহণ হবে বলে আশা করছেন রাষ্ট্রপক্ষের প্রধান কৌঁসুলি মোশাররফ হোসেন কাজল। রবিবার সকালে ঢাকার বকশীবাজার এলাকার ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারসংলগ্ন মাঠে নির্মিত অস্থায়ী আদালত ভবনে এ দু’টি মামলার ৪৭তম শুনানির দিনে আসামি বেগম খালেদা জিয়ার উপস্থিতিতে বিচারকাজ শুরু হয়। এ পর্যন্ত বিভিন্ন অজুহাতে খালেদা আদালতে অনুপস্থিত থাকলেও আদালতের কড়া নির্দেশনার কারণে সপ্তমবারের মতো আদালতে হাজিরা দিলেন দুই মামলার আসামি খালেদা। দু’টি মামলার বাদী হারুন অর রশিদ সাক্ষ্য দেয়ার জন্য আদালতে উপস্থিত থাকলেও খালেদার আইনজীবীরা উচ্চ আদালতে এ দুটি মামলার বিষয়ে ‘লিভ টু আপীল’ শুনানির অপেক্ষায় থাকার কথা বলে সাক্ষ্য পিছিয়ে দেয়ার আবেদন করেন। বিচারক খালেদার আবেদন মঞ্জুর করেন। সাক্ষীর জবানবন্দী পিছিয়ে যায়। শুনানি শেষে আদালত সাক্ষ্যগ্রহণের নতুন তারিখ ঠিক করে ২৪ নবেম্বর। প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বপালন কালে অনাথ শিশুদের নামে সোয়া পাঁচ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে অভিযুক্ত সাবেক প্রধানমন্ত্রী এবং বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া তার বিরুদ্ধে দায়ের করা দুই মামলায় হাজিরা দিতে বেলা ১১টায় পুরান ঢাকার বকশীবাজারের বিশেষ আদালতে পৌঁছান। গাড়ি থেকে নামার সময়ে খালেদার মাথায় ছাতা ধরে তাকে আদালত কক্ষে ঢুকিয়ে দেন বিএনপিকর্মীরা। ১১টা ৫ মিনিটে হাল্কা বেগুনী সিফন শাড়ির ওপর একই রঙের পাতলা চাদর গায়ে খালেদা আদালতে ঢুকলেন। দরজা থেকে ডান দিকে তাকিয়ে দেখলেন তাঁর বসার ব্যবস্থার দিকে। খালেদা আসার আগেই হাতল দেয়া একটি চেয়ারে সাদা তোয়ালে বিছিয়ে রেখেছিলেন তার নিরাপত্তায় নিয়োজিত এএসএফের বিশেষ বাহিনীর কর্মীরা। খালেদার হাজিরার দিন প্রতিবারই তার চেয়ারের জন্য বাড়ি থেকে একটি কুশান আনেন বিএনপিকর্মী এ্যাডভোকেট জেসমিন জাহান। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। বেশ খোশ মেজাজে আয়েশ করে পায়ের ওপর পা দিয়ে তার স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে চেয়ারে বসলেন খালেদা। এর পর মুহূর্তেই আদালতে প্রবেশ করলেন বিশেষ আদালত-৩-এর বিচারক বাসুদেব রায়। আদালত বসবার পরপরই শুনানি শুরু হবে কী হবে নাÑ সেই প্রশ্নে আত্মপক্ষ সমর্থন করে বক্তব্য উপস্থাপন করেন দুইপক্ষ। শুরুতেই আসামিপক্ষের বক্তব্য উপস্থাপন করতে গিয়ে লিভ টু আপীল শুনানির অপেক্ষায় থাকার পরও আসামিকে আদালতে হাজির হতে বলায় রাষ্ট্রপক্ষ এবং আদালতকে অভিযুক্ত করেন সুপ্রীমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউদ্দিন খোকন। তিনি সূচনা বক্তব্যে বলেন, লিভ টু আপীল শুনানির অপেক্ষায় থাকার পর ও আদালতের নির্দেশের প্রতি সম্মান দেখিয়ে আমরা আজ হাজির হয়েছি। এ মামলার সাক্ষীর হাজিরা আদালতকে অবগত করতে গিয়ে রাষ্ট্রপক্ষের সূচনা বক্তব্য দেন দুর্নীতি দমন কমিশনের আইনজীবী মোশাররফ হোসেন কাজল। এ সময়ে তিনি আসামিপক্ষকে ইঙ্গিত করে বলেন, ‘মাননীয় আদালত, আসামিপক্ষ শুরু করলেন অভিযোগ দিয়ে। এটা চরম বাড়াবাড়ি। জবাব দিতে গেলে অনেক কথা হয়। তবে বিষয়টি খুবই দুঃখজনক। সুপ্রীমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি খন্দকার মাহবুব হোসেনকে উদ্দেশ করে মোশাররফ হোসেন কাজল বলেন, এ অভিযোগের জবাব দিতে গেলে অনেক কথা হয়, তবে আপনার উপস্থিতিতে এটা হলো, স্যার, এটা সত্যিই দুর্ভাগ্যজনক।’ সুপ্রীমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি খন্দকার মাহবুব হোসেন মৃদু হেসে তাঁর বক্তব্য উপস্থাপন করতে ডকে দাঁড়ান। তিনি আদালতকে বলেন, ‘মামলা তো মামলাই, ১৭ হাজার মামলা আদালতে জট বেঁধে আছে, এই মামলায় এমন কী মধু আছে, যে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী অস্থির এত? ‘একই সঙ্গে বিচারককে উদ্দেশ করে খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, ‘একজন মাত্র সৎ বিচারক আছেন, সেটা আপনি। ন্যায়বিচারের স্বার্থে আমরা সবাই এখানে উপস্থিত আছি। উচ্চ আদালতে যে আবেদন আমরা করেছি, সেই পর্যন্ত আপনি অপেক্ষা করবেন আশা করি।’ এর জবাবে রাষ্ট্রপক্ষের প্রধান কৌঁসুলি মোশাররফ হোসেন কাজল বলেন, বেগম জিয়া উপস্থিত এখানে। আপনি দীর্ঘক্ষণ আপনার আইনজীবীদের স্ববিরোধী বক্তব্য শুনছেন। তাঁরা আদালতে শুনানির আবেদনও করেছেন আবার মামলা মুলতবিরও আবেদন করেছেন।’ মোশাররফ হোসেন কাজল আসামিপক্ষের আইনজীবীদের প্রশ্ন করেন, ‘আপনাদের এমন স্ববিরোধী কাজের কথা আদালতে বলেছেন কি আপনারা? আপনারা বার বার রাজনৈতিক বক্তব্য দিচ্ছেন। আদালত রাজনৈতিক বক্তব্যের জায়গা নয়। আদালতে আইনের কথা বলুন। দুর্নীতি দমন কমিশন থেকে সাক্ষী হাজির আছেন। আসামির উপস্থিতিতে কার বক্তব্য শোনার জন্য আমার আবেদন জানাচ্ছি ।’ এ সময়ে সাবেক এ্যাটর্নি জেনারেল এজে মোহাম্মদ আলী উঠে আদালতে তাঁর বক্তব্য উপস্থাপনের জন্য ডকে দাঁড়ান। একইভাবে তিনি দাবি করেন, শুনানি শুরু হলে উচ্চআদালতের নির্দেশনার স্পষ্ট লঙ্ঘন হবে। এর জবাবে আবার রাষ্ট্রপক্ষের প্রধান কৌঁসুলি আদালতকে রেফারেন্স তুলে ধরে বলেন, উচ্চ আদালতে এখনও কোন নির্দেশনাই দেয়নি, যা লঙ্ঘনের প্রশ্ন আসে। মোশাররফ হোসেন কাজল ১৯৫৮ সালের ক্রিমিনাল ল’ র রেফারেন্স এনে বলেন বিশেষ আদালত বিশেষ আইনানুযায়ী চলবে। সেই অনুযায়ী এ মামলার শুনানি শুরু হতে পারে। এই পর্যায়ে বিচারক বাসুদেব রায় বেগম জিয়াকে উদ্দেশ করে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, ‘ম্যাডাম, আপনি আদালতে এসেছেন. আপনার উপস্থিতির কারণে আজ আদালতে শান্ত পরিবেশ বিরাজ করছে। এ জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।’ বিচারকের এই বক্তব্য দেয়ার সঙ্গে সঙ্গেই মাহবুবউদ্দিন খোকন ডকে এসে রাষ্ট্রপক্ষকে অভিযুক্ত করে বক্তব্য দিতে থাকেন। এর প্রতিবাদ করেন রাষ্ট্রপক্ষের প্রধান কৌঁসুলি। ১১টা ৫৫ মিনিটে আদালতে দুইপক্ষের চরম হট্টগোল শুরু হয়ে যায়। এ অবস্থায় মৃদুভাষী বিচারক বাসুদেব রায় দুইপক্ষকে থামানোর চেষ্টা করে একপর্যায়ে সমর্থ হন। এ সময়ে বিচারক দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, আপনারা চারদিক থেকে কথা বলছেন, এটা খুবই দুঃখজনক। ‘বিচারক উপস্থিত আইনজীবীদের আইনের ধারাবাহিকতা বজায় রাখার নির্দেশ দেন। আসামিপক্ষকে উচ্চ আদালতের নির্দেশনা নিয়ে আগামী ২৪ নবেম্বর হাজির হওয়ার নির্দেশ দেন বিচারক। সেই পর্যন্ত আদালত মুলতবি ঘোষণা করে বেলা ১১টা ৫৮ মিনিটে আদালত ত্যাগ করেন বিশেষ আদালতের বিচারক বাসুদেব রায়। খালেদার পক্ষে শুনানিতে অংশ নেন সুপ্রীমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি খন্দকার মাহবুব হোসেন, সুপ্রীম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সম্পাদক মাহবুবউদ্দিন খোকন, সাবেক এ্যাটর্নি জেনারেল এজে মোহাম্মদ আলী, এ্যাডভোকেট জয়নাল আবেদীন ও সানাউল্লাহ মিয়া। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, মহানগর আহবায়ক মির্জা আব্বাস, যুগ্ম মহাসচিব আমান উল্লাহ আমান, বরকত উল্লাহ বুলুসহ কেন্দ্রীয় নেতারা এ সময় আদালতে উপস্থিত ছিলেন। এর আগে গত ৩ সেপ্টেম্বর এ দুটি মামলায় আদালতে হাজিরা দেন খালেদা জিয়া। এরপর কয়েক দফা তারিখ পড়লেও নিরাপত্তার কথা বলে এবং উচ্চ আদালতে ‘লিভ টু আপীল’ শুনানির অপেক্ষায় থাকার কারণ দেখিয়ে তিনি শুনানিতে অনুপস্থিত থাকেন।
×