ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

সিডনির মেলব্যাগ ॥ মোকাবেলা ও উত্তরণ

প্রকাশিত: ০৫:২৮, ৭ নভেম্বর ২০১৪

সিডনির মেলব্যাগ ॥ মোকাবেলা ও উত্তরণ

বিচিত্র দেশ আমাদের। অদ্ভুত সমাজ, এই দেশ, এই স্বাধীনতা, এই পতাকা, এই মুক্তি কোন কিছুই কিছু না। যাঁরা নিজেদের জীবন উৎসর্গ করে, ভালবেসে, ত্যাগে, মহিমায় আমাদের মুক্তি এনে দিয়েছিলেন তাঁদের কথা ভাবুন একবার। জেল হত্যা দিবস আমাদের জাতীয় জীবনের শোকাবহ এক অধ্যায়। বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারের অকাল মৃত্যুর চেয়ে কম কিছু নয় এই কালো দিন। বলব, মূলত সে রাতেই আমাদের রাজনৈতিক প্রত্যাশার সূর্য ডুবে গিয়েছিল। এসব কথা এতবার বলা হয়েছে এখন আর তা কাউকে তেমন উদ্দীপ্ত বা ভাবিয়ে তোলে বলেও মনে হয় না। অথচ তাজউদ্দীন, সৈয়দ নজরুল, কামরুজ্জামান, মনসুর আলীর মতো নেতৃত্ব এখনও পয়দা হয়নি। তাঁদের দলের মুখপাত্র ও বর্তমান নেতাদের দেখলেই তা বোঝা সম্ভব। অথচ এঁরা কেউ তেমন করে জানাযা পাননি। জানি প্রেক্ষাপট ও সময়ের কথা বলে পার পাবার চেষ্টা করব আমরা। আসলে কি তাই? যুদ্ধাপরাধীদের যখন বিচার ও শাস্তি দেয়ার ঘোষণা করা হচ্ছে তখন সময়টা কি তাদের অনুকূলে? জামায়াত কি এখন সুখের স্বর্গ বা নিরাপদ বেষ্টনীর ভেতরে আছে? কোন শত্রুও তা বলতে পারবে না। যদি তাই হয়, তারপরও তারা এমন মাতম বা দাপট করছে কিভাবে? কোন্ জোর কোন্ শক্তিতে? গোলাম আযমের মতো পাকিপ্রেমী, মূলত অন্তরে পাকিস্তানীর জানাযা নিয়ে এত তা-বের উৎস কোথায়? যদি এটি দুর্ভাগ্যজনক ভাবে কোন আঁতাতের অংশ হয়েও থাকে, আজ আমি আমার সমস্ত ঘৃণা ও ক্রোধ উৎসর্গ করি এই প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে। বিপরীতে আমার কষ্ট ও বেদনার জানাযাবিহীন মৃত্যুর পুনর্উত্থান কামনা করি রাষ্ট্র ও সরকারের কাছে। এটা নিশ্চিত, কোনদিন যদি বিরুদ্ধ শক্তি ক্ষমতায় আসতে পারে তারা তাই করবে। কোন সময় বা কোন কালই দীর্ঘ নয়। যদি তাকে পরিচর্যা করা হয়, আমাদের দুর্ভাগ্য স্বাধীনতার অব্যবহিত পর হলেও আমরা তখন দায়িত্ব পালন করতে পারিনি। সামরিক বাহিনীর সহায়তায় জাতীয় বীরদের হত্যার পর হতবিহ্বল জাতি ভয়ে হোক আর দোটানায় হোক শোককে শক্তিতে পরিণত করতে ব্যর্থ হয়েছিল। সে কারণেই আজ রাজাকারদের এই দৌরাত্ম্য। শুধু তাই নয়, বদলে যাওয়া মানুষদের ভিড়ে পরিচয় সঙ্কটও এখন তুঙ্গে। চারপাশে তাকিয়ে দেখুন সুশীলের আবরণে রাজাকারের সংখ্যা বাড়ছে। একদা প্রগতিশীল, একদা বাম, একদা গোলাপ প্রেমী, একদা ভ্যালেন্টাইন দিবসের প্রবক্তা, একদা মুক্তিযোদ্ধা এমনকি একদা সেনাপতির কণ্ঠেও এখন রাজাকারী সুর। এর রাজনৈতিক ব্যাখ্যা যাই হোক সামাজিক ব্যাখ্যা ধর্মের নামে উত্তেজনা আর অন্ধত্বের বিস্তার, অন্যদিকে পরকালের লোভ। একটা বিষয় মাথায় রাখা প্রয়োজন, ইংরেজীতে বলা হয়, “ঝববরহম রং ইবষরবারহম” চোখে দেখাই বিশ্বাসের ভিত্তি। সে জায়গাটায় তারুণ্য বা নতুন প্রজন্ম কি দেখছে? মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়া পরবর্তীতে রাজাকার পুনর্বাসনের হোতা জিয়ার জানাযায় মানুষের ঢল। মোশতাকের মতো বেঈমান, মীরজাফর মরেছে স্বাভাবিক নিয়মে। এত বছর পর রাজাকার শিরোমণি গোলাম আযমের জানাযায়ও মানুষ কম হয়নি। লক্ষণীয়, সরকারী দলের ইমেডিয়েট বা আশু টার্গেট বিএনপি এ নিয়ে কথা বলেনি, নীরব থেকে বাড়িতে বসে চোখের পানি ফেললেও মাঠে নামেনি তারা। এ নিয়ে গোলাম আযমপুত্রের উদ্বেগ, বিতৃষ্ণাও দেখলাম মিডিয়ায়। তারপরও এই জাতীয় শোডাউনের মানে মানুষের মনে ভয় ও পুনর্বার চিন্তার বীজ ঢুকিয়ে দেয়া। এটা জানি জামায়াতের সমর্থক মানেই কর্মী। অন্যদলের বেলায তা নয়। অন্যদের কর্মী যত সমর্থক তার অধিক এবং এরা কখনও এ্যাকশন বা মাঠে নামে না, বড় ধরনের কোন পরিবর্তন বা রাষ্ট্রীয় প্রয়োজনেই এদের পাওয়া যায়। জামায়াতের মতো ক্যাডার ভিত্তিক দলের বেলায় এ কথা প্রযোজ্য নয়। ফলে ভীত হবার কিছু দেখি না। সরকার যদি অন্ধ না হয় এবং তাদের দ্বৈত বা ত্রিবিধ নীতি পরিত্যাগ করে এ সত্য বোঝা কঠিন হতে পারে না। গণজাগরণ মঞ্চের আহ্বানে সমবেত মানুষের কথাও অতীতের দৃশ্য মনে জাগিয়ে দেখলেই হয়, স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীও সেদিন মোমবাতি প্রজ্ব¡লনে অধীর ও আগ্রহী হয়ে পড়েছিলেন। সে জায়গাটা নষ্ট করা কিছুতেই ঠিক হয়নি। এখনও সময় আছে। যে কথা বলছিলাম, জাতীয় বীর ও শহীদদের জানাযা ঠিকমতো হয়নি বলে তাদের জন্য রাষ্ট্রীয়ভাবে পুনর্বার শোক করা যাবে না। এটা কোন নিয়মে পড়ে না। অবশ্যই প্রথাগত গৃহবন্দী বা হল বন্দী শোকসভার কথা বলছি না। রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগ তা করতেই পারে। তাদের সে শক্তি পরীক্ষিত, তেসরা নবেম্বরের বীরদের ভেতর তাজউদ্দীনের ইমেজ একেবারেই ভিন্ন। ঘোর বিরোধীও তাঁর প্রতি শ্রদ্ধায় অবনত হতে বাধ্য। মৃত্যু ও জীবনে আদর্শনিষ্ঠ তাজউদ্দীনের বেলায় মানুষের স্রোত স্বয়ং শয়তানও ঠেকাতে পারবে না, তাছাড়া করুণভাবে বিদায় নেয়া এই বীরদের প্রতি জাতীয় সম্মান ও শ্রদ্ধা প্রদর্শনের মাধ্যমে অতীতের প্রায়শ্চিতও সম্ভব হতে পারে। সবচেয়ে বড় কথা, মিথ্যা ও অন্যায় দেখতে দেখতে ক্লান্ত প্রজন্মের জন্য এই চাক্ষুস উদাহরণ জরুরী। আমাদের নষ্ট সমাজে বুদ্ধিবৃত্তিও এখন পচনশীল। ক্রমাগত মিথ্যাচার, ধর্ম-অধর্মের নানাবিধ জটিলতা আর মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তির দুর্বলতায় মানুষ কোণঠাসা। এদের জীবন ও আদর্শের দ্বন্দ্ব ঘোচাতে হলে তাজউদ্দীনের মতো নেতার বিকল্প নেই। গোলাম আযমের পুত্র বিএনপিকে চ্যালেঞ্জ দিয়ে বলেছে, জামায়াত ছাড়া বিএনপি কখনই গদিতে যেতে পারবে না। শক্তির এই উত্থান ও আক্রোশকে কি আমরা দুরভিসন্ধি আর আপোস দিয়ে মোকাবেলা করব? না তাজউদ্দীনের মতো নেতাদের দেখানো পথ বেছে নেব?
×