ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

খতিয়ে দেখা দরকার কেন খেলাপী ঋণগ্রহীতারা পালাচ্ছেন

প্রকাশিত: ০৫:২৩, ৭ নভেম্বর ২০১৪

খতিয়ে দেখা দরকার কেন খেলাপী ঋণগ্রহীতারা পালাচ্ছেন

চট্টগ্রামের এক শ্রেণীর ব্যবসায়ীর কী হয়েছে জানি না, তাঁরা ব্যাংকের টাকা পয়সা মেরে দিয়ে বিদেশে পাড়ি দিচ্ছেন। দুই দিন পর পর এ ধরনের খবর দৈনিক পত্রিকাগুলোতে নিয়মিতভাবে ছাপা হচ্ছে। যদিও চট্টগ্রামের খবর বেশি তবু এ কথা বলা যায় না যে, অন্য অঞ্চলের ব্যবসায়ী এ ধরনের পলায়নবৃত্তিতে নেই। বড় পার্টি একটা ‘বিসমিল্লাহ’র খবর আমরা জানি। তিনি সম্ভবত চট্টগ্রামের লোক নন। এ ‘বিসমিল্লাহ’র মালিকরাও শুনছি বিদেশে গেছেন এবং সেখানে চুটিয়ে ব্যবসা করছেন। এই পার্টি ছাড়া চট্টগ্রামের অনেক খবর হয়। এক সময় ‘মাড়োয়ারি’ ব্যবসায়ীদের কথা শুনতাম। দুটো পরিবার দেশ ছেড়েছিল। এখন এদের খবর হয় না। এখন চট্টগ্রামের বড় বড় পার্টির খবর হচ্ছে। কিছু খবর শুধু ঋণখেলাপীর। অর্থাৎ ঋণ চুক্তি লঙ্ঘনের। অর্থাৎ ঋণের কিস্তি পরিশোধে ব্যর্থতার খবর। আবার কিছু খবর হচ্ছে ঋণখেলাপী এবং পলায়ন, পলায়ন মানে দেশ ত্যাগ। এমন একটা খবর ৪ নবেম্বর একটি দৈনিকে ছাপা হয়েছে। এটি সম্ভবত সর্বশেষ পালানোর খবর। খবরে জানা যাচ্ছে, দুই ভাই আট শিল্প প্রতিষ্ঠানের নামে সরকারী ও বেসরকারী উভয় ধরনের ব্যাংক থেকে ৭৫০ কোটি টাকা মেরে দিয়ে পালিয়েছেন। পত্রিকাতে দুই ভাইয়ের নাম ছাপা হয়েছে। আমি নামে উৎসাহিত নইÑ উৎসুক ঘটনায়। রিপোর্টটিতে বলা হয়েছে ‘দুদুক’ এ ব্যাপারে করণীয় ঠিক করতে বৈঠক ডেকেছে। দেখা যাচ্ছে দুই ভাইয়ের প্রতিষ্ঠানগুলো হচ্ছেÑ মিশম্যাপ শিপব্রেকিং, ফয়জুন শিপব্রেকিং, বিআর স্টিল মিলস, মুহিব স্টিল এ্যান্ড শিপ রি-সাইক্লিং, এমআরএম এন্টার প্রাইজ, এমআর শিপিং লাইন্স, আহমদ মোস্তাফা স্টিল ইন্ডাস্ট্রিজ ও সালমার হোটেলস লিমিটেড। জড়িত ব্যাংকগুলো হচ্ছেÑ মার্কেন্টাইল ব্যাংক, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক, ইস্টার্ন ব্যাংক, প্রিমিয়ার ব্যাংক, শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক ও যমুনা ব্যাংক। রিপোর্টে একটি সরকারী ব্যাংকের কথা বলা হলেও দেখা যাচ্ছে তাদের ঋণের পরিমাণ যৎসামান্য। বলাবাহুল্য, এসব ঋণের বেশিরভাগই খেলাপী বা শ্রেণীবিন্যাসিত ঋণ। কোন ব্যবসায়ীর একটা ঋণ ‘খেলাপী’ হলে তিনি আর কোন ঋণ পাওয়ার যোগ্যতা রাখেন না। রিপোর্টে আরও বলা হয়েছে, এক ভাই এখন আছেন কানাডায় এবং আরেকজন দুবাইতে। এই হচ্ছে খবরের সংক্ষিপ্ত সার। ঠিক কী কারণে দুই ভাই দেশ থেকে পালালেন তা আমি জানি না। দুদকের তদন্তে হয়ত তা পরিষ্কার হবে অথবা প্রকৃত ঘটনা বলতে পারেন চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীরা। রিপোর্ট পড়ে দেখলাম, দুই ভাইয়ের মূল ব্যবসা শিপব্রেকিং এবং স্টিল মিলস। এই দুটো খাতে এখন চলছে টালমাটাল অবস্থা। গত মাসখানেকের মধ্যে এই দুটো খাতের ওপর কয়েকটি স্টোরি ছাপা হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, বিদেশে জাহাজের দাম বেড়ে গেছে। এর কুপ্রভাব পড়েছে দেশীয় শিপব্রেকিং ব্যবসায়। এদিকে ছোট ও মাঝারি স্টিল মিলগুলো বড়দের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে বাজারে টিকতে পারছে না। বাজারের খবর পাঁচ সাতটা খুবই বড় স্টিল মিলের সঙ্গে। যুদ্ধে ছোটরা হেরে যাচ্ছে। এটাই বাজার অর্থনীতি। ছোটরা বড়দের সঙ্গে পারে না। পরিণামে ছোটরা ব্যবসা থেকে উৎখাত হচ্ছে। আমি নিশ্চিত নই, এই দুই ভাই এসব কারণে ক্ষতিগ্রস্ত কিনা। এটা হতেও পারে নাও হতে পারে। না জেনে কিছু বলা ঠিক নয়। আবার এমনও হতে পারে দু’জনই ‘জাতখেলাপী’। দু’জনই বদমতলবী ব্যবসায়ী। ঘটনা হচ্ছে ‘জাতখেলাপী’ই হোক আর ‘একদা ভাল ব্যবসায়ী ছিলুম’ই হোক ব্যাংকের তো মরণ। ব্যবসায় মন্দা মানে ব্যাংকের বারোটা, ব্যাংকের বারোটা মানে কর্মকর্তাদেরও বারোটা। খোঁজা হবে তাদের, ধরা হবে তাদের। যতক্ষণ ব্যবসা ভাল ছিল, ব্যবসায়ী টাকা ঠিকমতো দিত, ততক্ষণ ব্যাংকাররা ভালই থাকেন। একটু সমস্যা হলেই ‘ভাল-মন্দ’ ব্যাংকার নির্বিশেষে ‘ধরা খান’। দ্বিতীয় কথা, উল্লিখিত ঘটনায় দেখা যাচ্ছে, জড়িত ব্যাংকগুলোর প্রায় সবই বেসরকারী ব্যাংক। এটা সমস্যার আরেক দিক। মিডিয়া এতদিন সরকারী ব্যাংকের সমস্যা নিয়েই ব্যস্ত ছিল। ক্যাশ চুরি, ‘আইবিজি’ মারফত টাকা মারা, ঋণের নানা অনিময় মানেই সরকারী ব্যাংকÑ এমন একটা ধারণাই জনমনে সৃষ্টি হয়েছে। আমি এই ধারণা সম্পর্কে অনেক লিখেছি এবং সঙ্গে সঙ্গে সকলকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছি বেসরকারী ব্যাংকের কথাও। শতভাগ ব্যাংক ব্যবসার মধ্যে সরকারী ব্যাংকের ব্যবসা অর্থাৎ আমানত, ঋণ ও বৈদেশিক বাণিজ্য ব্যবসা মাত্র কুড়ি ভাগ। বাকি আশিভাগ বেসরকারী ব্যাংকের ব্যবসা। অতএব, আমি বরাবর বলেছি, আরও বলছি নিয়ন্ত্রণ, মনিটরিং তদারকি, বিচার-আচার যতটুকু দরকার সরকারী ব্যাংকের ক্ষেত্রে তার চেয়ে বেশি দরকার বেসরকারী ব্যাংকের জন্য। এই নির্মম সত্যটি সরকারের অলিগলিতে বসে যাঁরা সরকার ‘চালাচ্ছেন’ বলে মনে করেন তাঁরা মনে রাখলে ভাল হবে। পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে বেসরকারী ব্যাংকের মধ্যে একটা না একটা প্রায় সপ্তাহেই খবরের কাগজের প্রতিপাদ্য হচ্ছে। আমি ধরে এই আলোচনা করতে চাই না। যে কোন পাঠক যাঁরা একটু খবর রাখেন তাঁরাই জানেন কোন বেসরকারী ব্যাংকে কী হচ্ছে। বেসরকারী ব্যাংক চালায় ব্যবসায়ীরা, সরকারী ব্যাংক চালায় সরকারের মনোনীত পরিচালকরা যাঁরা সাধারণভাবে ব্যবসায়ী নন। আমাদের দেশের ব্যবসায়ী ব্যাংক চালাতে গিয়ে ‘কী কী’ করতে পারেন সেই আলোচনায় আমি যাব না। শুধু অতীতের তিন-চারটা ঘটনার উল্লেখ করতে চাই। বেসরকারী খাতে ব্যাংক দেয়ার পর অল্পদিনের মধ্যেই ‘কী কী’ ঘটনা ঘটেছিল। তা উৎসাহী পাঠকরা সিনিয়র ব্যাংকারদের কাছ থেকে জেনে নেবেন। সংক্ষেপে বলি, মালিকরা সব টাকা নামে-বেনামে নিয়ে নিয়েছিলেন। মালিকদের বেপরোয়া কা--কারখানার কারণে নিকট অতীতে ‘আল বারাকা ব্যাংক’, ‘ওরিয়েন্টাল ব্যাংক’ হয়েছে এবং পরে তা হয়েছে আইসিবি ইসলামী ব্যাংক। এই ব্যাংক আমানতকারীদের টাকা এখনও দিতে পারেনি। ইস্টার্ন ব্যাংকটি ছিল ‘ব্যাংক অব ক্রেডিট এ্যান্ড কমার্স ইন্টারন্যাশনাল’ (বিসিসিআই)। মালিকদের জালিয়াতির কারণে তা ধ্বংস হয়। ওই ধ্বংসপ্রাপ্ত ব্যাংকের ‘ব্যাড এ্যাসেটস’ সুচতুরভাবে ট্রান্সফার করেই সৃষ্ট হয় ‘বিসিসিআই ফাউন্ডেশন’ এখন যা বেসিক ব্যাংক লি.। বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক লিমিটেড ছিল একটা বিনিয়োগ কোম্পানি। মালিকদের জালিয়াতির কারণে কোম্পানিটি বন্ধ হয়। সরকার পরে একে ব্যাংক বানিয়ে দেয়। ‘এনসিসিবি’র ঘটনাও একই। এগুলো সব আগের ঘটনা। এই মুহূর্তে খবরের কাগজকে যদি বিশ্বাস করতে হয় তাহলে কমপক্ষে চারটি বেসরকারী ব্যাংক ভীষণ বিপদের মধ্যে। আমি কথা আর বাড়াতে চাই না। ব্যবসা মন্দা, ঋণখেলাপ, ‘জাতঋণ খেলাপীদের’ কা-, ব্যাংক মামলায় স্থবিরতা, স্পেশাল ডিভিশনে দীর্ঘদিন বিচারকের অনুপস্থিতি, টাকা মেরে ব্যাংক গ্রাহকদের বিদেশে পলায়ন, আন্ডার ইনভয়েসিং এবং ওভার ইনভয়েসিং করে বিদেশে টাকা পাচার, প্রকৃত দোষীদের বিচারের অনুপস্থিতি, এমডি নির্বাচনে মালিকদের দক্ষতাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখানো, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দায়িত্ব এড়ানো, ব্যাংকিং বিভাগের কর্মকর্তাদের আইন-বিধিবহির্ভূত কর্মকা- ইত্যাদি কিন্তু ব্যাংকিং খাতকে নাজুক অবস্থার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। বড় সমস্যা, খুবই বড় সমস্যা খেলাপী ঋণের ব্যাপারে কেউ সঠিক পদক্ষেপ নিচ্ছেন না। সম্প্রতি ভারতের একটি বাণিজ্যিক ব্যাংক কেন্দ্রীয় ব্যাংকের জোর সমর্থনে একজন খুবই বড় ব্যবসায়ীর গোয়ার অট্টালিকা বিক্রির ব্যবস্থা করছে। ব্যবসায়ী ছিলেন এয়ারলাইনসের মালিক। ‘কিং ফিশার’ তার নাম। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলছে : ব্যবসায়ীরা ব্যাংকগুলোকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখাচ্ছে। এটা হতে দেয়া যাবে না। আমরা কিন্তু এই জায়গাতেই। সকল দোষ ব্যাংক এবং ব্যাংকারদের, পরিচালকদের, বোর্ডের। আর সবাই সাধু। তাদের কোন দায়-দায়িত্ব নেই। বড় বড় ব্যবসায়ী আরও বড় হচ্ছে। তারাই সংসদে, তারাই সরকারে। তাদের কথাতেই সরকারী ব্যাংকে ঋণ হয়। আবার দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংকও তাদের ‘সালাম’ দিয়ে চলে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য দূর করতে হবে। এর অন্যতম অস্ত্র হচ্ছে ব্যাংক ঋণ। ব্যাংক ঋণ সব নিয়ে নিচ্ছে বড়রা। তাদের তোয়াজ করে ব্যাংকাররা, কেন্দ্রীয় ব্যাংকাররা, সরকারী আমলারা। ব্যবসা-রাজনীতি ব্যাংকিং প্রশাসন এই আঁতাত বন্ধ করতে না পারলে, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনার ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য দূর করার স্বপ্ন বাস্তবায়িত হবে না। অবিলম্বে সরকারের উচিত ব্যাংকিং খাতের খোলনলচে পাল্টে ফেলা। সাবধান হওয়া দরকার এবং তা এক্ষুণি। বিশ্বমন্দা সত্ত্বেও আমরা এখনও টিকে আছি। কিন্তু বাস্তব সত্য হচ্ছে, মন্দা অব্যাহত। এর ছোঁয়া কিন্তু এবার লাগতে পারে এবং তা ব্যাংক ব্যবসাকে ছেড়ে কথা বলবে না। ব্যাংকিং খাতের কার্পেট তুলে ফেলুন। আবর্জনা দূর করুন। বড় বড় ব্যবসায়ীকে নিয়ন্ত্রণ করুন। আদরও করুন। লেখক : সাবেক প্রফেসর, বিআইবিএম
×