ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

রাজনৈতিক সন্ত্রাস

প্রকাশিত: ০৪:৫৮, ৭ নভেম্বর ২০১৪

রাজনৈতিক সন্ত্রাস

বিভাষ বাড়ৈ ॥ আভিধানিক অর্থ দোকানপাট ও দরজা বন্ধ রাখা হলেও গুজরাটি ভাষার ‘হরতাল’ দেশের মানুষের কাছে এখন ক্ষয়-ক্ষতি আর আতঙ্কের নাম। এক সময় সাধারণ মানুষের কল্যাণে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের অস্ত্র হিসাবে ব্যবহৃত হলেও এখন হরতালের নামে ঘটছে নাশকতা, তা-ব, সহিংসতা, নিরীহ মানুষকে পুড়িয়ে মারাসহ ধ্বংসযজ্ঞ। মানুষের সমর্থন নেই তবু কারণে অকারণে একের পর এক হরতাল ডেকে জোরপূর্বক তা পালন করতে বাধ্য করা হচ্ছে। আদালতকে বৃদ্ধাঙ্গুল দেখিয়ে আদালতের বিরুদ্ধেই হরতাল দিচ্ছে যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত সংগঠন জামায়াত-শিবির। যেখানে দেশ, দেশের মানুষের স্বার্থের কোন স্থান নেই। সহিংসতার হরতাল ধ্বংস করছে অর্থনীতি, শিক্ষা থেকে শুরু করে সব অর্জন। ব্যবসায়ী সমাজসহ দেশী-বিদেশী গবেষণা প্রতিষ্ঠান বলছে, একদিনের হরতালে ক্ষতি হচ্ছে দেড় হাজার কোটি টাকা। সে হিসাবে তিন যুদ্ধাপরাধীর জন্য জামায়াতের ডাকা গত পাঁচদিনের হরতালেই দেশের আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ আট হাজার কোটি টাকা। হরতালে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হচ্ছে অর্থনীতির। হরতাল ও রাজনৈতিক সহিংসতার কারণে অর্থনীতির ক্ষতি নিয়ে অন্তত ২৩ বছর ধরে নানা ধরনের গবেষণা করছে বিভিন্ন দেশীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থা। ব্যবসায়ীরাও নানাভাবে রাজনৈতিক সঙ্কট নিরসনে নানা ধরনের চেষ্টা করেছেন। কিন্তু কোন উদ্যোগই সফল হয়নি। বরং রাজনৈতিক সহিংসতা ও হরতাল বেড়েই চলেছে। এর ফলে সমস্যার কোন সমাধান কখনও হচ্ছে না। এখন আদালতের বিরুদ্ধে হরতাল দেয়ার সাহস পাচ্ছে স্বাধীনতা বিরোধীরাও। হরতালের নামে ধ্বংস করা হচ্ছে অর্থনীতি ॥ ‘২০২১’ সাল নিয়ে বাংলাদেশের একটি স্বপ্ন আছে। ওই সময়ের মধ্যে এমন একটি বাংলাদেশ গড়ে তোলা হবে যেখানে দারিদ্র্য ও ক্ষুধা থাকবে না। দুর্নীতি, দুঃশাসন ও অশিক্ষার অন্ধকার থাকবে না। মানুষ তার সম্মান ও মর্যাদা নিয়ে সমৃদ্ধ জীবন গড়ে তুলবে। এমন একটি বাংলাদেশ গড়ে তোলা হবে যেখানে শিক্ষা-সংস্কৃতি, জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে অগ্রসর একটি সুখী সমৃদ্ধ জাতির ইতিহাস তৈরি হবে। এটি শুধু নিছক স্বপ্নের হাতছানি নয়। বাংলাদেশের জন্য এটিই সত্যি, এটিই চরম বাস্তবতা! কারণ ইতোমধ্যে অনেক স্বপ্ন পূরণ হওয়ার পথে। গত কয়েক বছরে দারিদ্র্য কমেছে, বেড়েছে মাথাপিছু আয়। রফতানি, রেমিটেন্স, রিজার্ভ ও খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনে ঈর্ষণীয় সাফল্যে পৌঁছে গেছে বাংলাদেশ। উন্নয়নশীল নয়, একটি মধ্যআয়ের দেশের দিকে বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু বাংলাদেশের এই যে অর্জন, তা এখন আবার চরমভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। ধ্বংস হওয়ার দ্বারপ্রান্তে সব ভাল অর্জনগুলো। রাজনৈতিক অস্থিরতা ও ঘন ঘন হরতালের কারণে আজ সব স্বপ্ন ধূলিসাত হওয়ার পথে। ফিকে হয়ে আসছে আলো। হরতালের কারণে কালো ছায়া ভর করছে দেশের অর্থনীতির উপর। হরতাল হচ্ছে অর্থনীতির ঘাতক। রাজনৈতিক এই কর্মসূচী চলাকালে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির সম্মুখীন হয় দেশের অর্থনীতি। আর তাই অর্থনীতি ধ্বংসকারী হরতাল নিয়ে দেশ ও দেশের বাইরে সর্বত্র সমালোচনার ঝড় বইছে। দেশের রফতানি, রেমিটেন্স, উৎপাদন, কর্মসংস্থান, প্রবৃদ্ধি, দারিদ্র্য হ্রাস এবং এমডিজি অর্জনের টার্গেটগুলো যখন ইতিবাচক ধারায় রয়েছে তখন ঘন ঘন হরতালের কারণে তা নেগেটিভ ধারায় ফিরে যাওয়ার শঙ্কা তৈরি হয়েছে। অর্থনীতিতে এশিয়ান টাইগার হওয়ার যে স্বপ্ন নিয়ে বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছিল তা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। ঘন ঘন কারণে অকারণে হচ্ছে হরতাল। এ অবস্থার পরিবর্তন না হলে অর্থনীতির ভবিষ্যত অন্ধকার। হরতাল হলেই এখন একটি প্রশ্ন সর্বত্র উঠে আসে, আর তা হলো-একদিনের হরতালে দেশের কি পরিমাণ ক্ষতি হয়? অর্থনীতি নিয়ে কাজ করেন এমন কয়েকটি দেশী-বিদেশী গবেষণা প্রতিষ্ঠান বলছে, একদিনের হরতালে কমপক্ষে দেড় হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হচ্ছে। কেউ বলছেন হাজার কোটি টাকা। কোন কোন অর্থনৈতিক বিশ্লেষক বলছেন ৫৫০ কোটি টাকার ক্ষতি হচ্ছে। ঢাকা চেম্বারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, একদিনের হরতালে ক্ষতি হচ্ছে ১৬শ’ কোটি টাকা। বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি সংগঠন (এফবিসিসিআই) বলছে, এই ক্ষতি দুই হাজার কোটি টাকা। বিশ্ব ব্যাংকের এক সার্ভে রিপোর্টে দেখা যায়, একটি পূর্ণ দিবস হরতালে বর্তমানে বাংরাদেশের অর্থনীতির প্রায় ৬০ মিলিয়ন ডলার ক্ষতি হয়। দীর্ঘমেয়াদী ক্ষতি অনেক বেশি। তবে অনুসন্ধানে হরতালের ক্ষয়-ক্ষতির বেশ কিছু তথ্য পাওয়া গেছে। আর তা হলো, একদিনের হরতালে মোট দেশজ উৎপাদনের বা জিডিপির ৮০ শতাংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। টাকার অঙ্কে যার পরিমাণ ১ হাজার ৭২৫ কোটি টাকা। অর্থাৎ প্রায় ২ হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হচ্ছে একদিনের হরতালে। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল গত বছর এক প্রতিবেদনে বলেছিল, হরতাল বাংলাদেশের জন্য এক বিরাট সমস্যা। এ নিয়ে অনেক দিন ধরেই ধুঁকছে বাংলাদেশ। পোশাক কারখানা ধসের ঘটনায় অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জের মুখে পড়া বাংলাদেশের সামনে লাগাতার হরতাল ডাকার সংস্কৃতি নতুন হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের দেয়া হিসাবে, হরতালের কারণে গত বছর প্রায় ৫৩ হাজার ৯০০ কোটি টাকার (৭০০ কোটি ডলার) ক্ষতি হয়েছে বাংলাদেশের। তৈরি পোশাক খাতের তিন সংগঠন বিজিএমইএ, বিকেএমইএ এবং বিটিএমএ গত গত বছর এক যৌথ সংবাদ সম্মেলন করে বলেছিল, একদিনের হরতালে পোশাক খাতেই ২০০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়। বিজিএমইএর সভাপতি আতিকুল ইসলাম বলেছেন, হরতালে ব্যবসায়ীদের যেমন ক্ষতি হচ্ছে, তেমনি সারাবিশ্বে দেশের ভাবমূর্তিও প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। এখন বড়দিনের পণ্য পাঠানোর সময়। এ সময় হরতাল আমাদের সঙ্কটে ফেলে দিয়েছে।’ মালিক সমিতির দাবি, হরতালে দেশের ২০ লাখ দোকানে প্রতিদিন ক্ষতি হয় ৪০০ থেকে ৫০০ কোটি টাকা। ঢাকা সড়ক পরিবহন সমিতির হিসাবে, হরতালের দিন দিনের বেলায় সারাদেশে গড়ে কমপক্ষে সাড়ে তিন লাখ বাস-মিনিবাস ও ট্রাক চলাচল বন্ধ থাকে। এ কারণে ওইসব দিন অন্তত ২৫০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়। কয়েক দিনে জামায়াতের হরতাল রাজধানীসহ সারাদেশে উত্তাপ ছড়াতে না পারলেও জীবিকা হুমকির মুখে ফেলেছে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ও ফুটপাথকেন্দ্রিক হকারদের। টানা হরতালে প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখা ও ক্রেতা না থাকায় পুঁজি হারাতে হচ্ছে তাদের। অন্যদিকে নারীসমাজের কর্মজীবনেও সমস্যার সৃষ্টি করছে এ হরতাল। এফবিসিসিআই হরতাল প্রসঙ্গে বলেছে, দেশের সার্বিক উন্নয়নের ধারা সমুন্নত রাখার স্বার্থেই এই হরতাল প্রত্যাহার করা উচিত। দেশে বর্তমানে ব্যবসা ও বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ বিরাজ করছে। এ অবস্থায় হরতালসহ যে কোন নেতিবাচক কার্যক্রম দেশের ভাবমূর্তির ওপর প্রভাব ফেলবে। এতে বিনিয়োগকারীরা নিরুৎসাহিত হবেন। বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স এ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট ও বাংলাদেশ প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি এ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি শেখ কবির হোসেন বলেছেন, হরতাল গণতান্ত্রিক অধিকার। কিন্তু গণতান্ত্রিক এ অধিকারের নামে দিনের পর দিন হরতাল উদ্দেশ্যমূলকভাবে দেশের অর্থনীতি ও মানবসম্পদ উন্নয়নে বাধা প্রদান এবং সম্পত্তি ও জানমালের ক্ষয়ক্ষতির একটি পন্থা। হরতাল লাগাতার না দিয়ে প্রতিবাদ একঘণ্টা বা আধাবেলা হলেও গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠা করা এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্য মানুষের মধ্যে প্রচার করা সম্ভব। এছাড়া বিকল্প রাজনৈতিক কর্মসূচীর মাধ্যমেও প্রতিবাদ করা সম্ভব। তা না করে এভাবে নিয়মিত হরতালের কারণে দেশের ব্যবসার ব্যাপক ক্ষয়-ক্ষতি হয়। তিনি আরও বলেন, কোর্টের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে হরতাল ডেকে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেয়ার যে চেষ্টা চলছে তার ফলে দেশের ব্যবসায়ী মহলে আবারও বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হচ্ছে। হরতালের কারণে অন্যান্য ব্যবসার পাশাপাশি বীমা ব্যবসাও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ২০১৩ সালের দীর্ঘদিন লাগাতার হরতালের কারণে দেশের অর্থনীতিতে যে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছিল এখনও তা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়নি উল্লেখ করে তিনি বলেন, দেশের ব্যবসায়ী মহল যে মুহূর্তে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে সেই মুহূর্তেই আইন অবমাননা করে কোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে জামায়াতের ডাকা হরতালের কোন ভিত্তি নেই। এছাড়া হরতালের কারণে স্কুল-কলেজে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের পরীক্ষাসহ নানা ধরনের অতীব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। দেশে চলমান সঙ্কট উত্তরণে প্রতিটি রাজনৈতিক দলের উচিত যুক্তি ও আইনের মধ্যে থেকে হরতালকে পরিত্যাগ করে তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়া। আদালতের বিরুদ্ধেই হরতাল দিচ্ছে স্বাধীনতাবিরোধী গোষ্ঠী ॥ দেশের স্বাধিকার ও স্বাধীনতা সংগ্রামের অনেকটা অংশ জুড়ে ছিল হরতাল-ধর্মঘট। নব্বইয়ের আন্দোলনে হরতালই কাজ করেছে গণতন্ত্রের মুক্তির অস্ত্র হিসেবে। দেশে গণতন্ত্র ফিরে আসার পরও বহু হরতাল হয়েছে। স্বাধীনতার আগে হরতাল হতো পাকিস্তানী শাসকদের মোকাবেলার জন্য। তখন হরতাল ছিল জনমুখী ও স্বতঃস্ফূর্ত। অর্থাৎ জনগণ নিজেরাই হরতাল পালন করত, কাউকে বাধ্য করা হতো না হরতাল পালনে। সে হিসেবে হরতালকে বলা হয় গণতান্ত্রিক অধিকার। কিন্তু হরতালের নামে এখন কি হচ্ছে? ২০১৩ সালের জানুয়ারি মাসের শেষ দিন থেকে এ পর্যন্ত দলটি ৩৩ দিন হরতাল পালন করেছে জামায়াত-শিবির। যার মধ্যে ২৬ দিনই আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় যারা মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছিল তাদের দ-ের বিরুদ্ধে জামায়াতে ইসলামী যে হরতালের ডাক দিয়েছে তা আদালত অবমাননার শামিল। আলবদর প্রতিষ্ঠাতা মতিউর রহমান নিজামীর বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালের দেয়া রায়ের পর থেকেই জামায়াত একটানা হরতাল শুরু করেছে। সর্বশেষ জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মোহাম্মদ কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে আপীল বিভাগে চূড়ান্ত রায় ঘোষণায় জামায়াত আবারও নতুন করে হরতালের কর্মসূচী পালন করে। মানবতাবিরোধী অপরাধের রায়ের পর জামায়াত হরতাল দেয়া বিষয়ে দেশের সর্বোচ্চ আইনকর্মকর্তা মাহবুবে আলম বলেছেন, এটা আদালত অবমাননার শামিল। পাশাপাশি দেশের আইনবিশেষজ্ঞগণও একই অভিমত ব্যক্ত করে বলেছেন, মামলায় আসামি পক্ষ শুনানি করেছেন, যুক্তিতর্কে অংশগ্রহণ করেছেন। আবার রায় ঘোষণার পর হরতালের ডাক দিচ্ছেন, যা আদালত অবমাননার শামিলই নয়, এটা রাষ্ট্রদ্রোহিতারও শামিল। রাজনৈতিক কারণে হরতাল হতে পারে। রায়ের বিষয়ে হরতাল ডাকাটা আইনের শাসনের প্রতি শ্রদ্ধা নেই। হরতাল ডাকার বিরুদ্ধে যে কেউ আদালতের আশ্রয় নিতে পারেন এমনকি আদালতও স্বপ্রণোদিত হয়ে আদেশ দিতে পারেন। সুপীমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সম্পাদক সিনিয়র আইনজীবী শ ম রেজাউল করিম জনকণ্ঠকে বলেছেন, আমার কাছে প্রতীয়মান হচ্ছে রাষ্ট্রের তিনটি অঙ্গÑ বিচার বিভাগ, নির্বাহী বিভাগ ও আইন বিভাগ। আইন বিভাগের স্বাধীন বিচার কার্যের এবং রায়ের বিরুদ্ধে হরতাল আহ্বান করা বা আইনী প্রক্রিয়ার বাইরে গিয়ে প্রতিবাদ করা শুধু আদালত অবমাননাই নয় রাষ্ট্রদ্রোহিতাও বটে। সে কারণে হরতাল আহ্বানকারীদের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার অভিযোগ ছাড়াও রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে মামলা দায়ের হতে পারে। হরতালে মহাসঙ্কটে শিক্ষা, পরীক্ষা ॥ হরতালের কারণে দেশের সর্ববৃহত দুই পাবলিক পরীক্ষা পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণীর সমাপনী, এসএসসি, এইচএসসির নির্বাচনীসহ বিদ্যালয়ের বার্ষিক পরীক্ষা নিয়ে মহাসঙ্কটের মুখে কোটি কোটি শিক্ষার্থী ও অভিভাবক। শিক্ষার্থী ও তাদের উদ্বিগ্ন অভিভাবকদের আকুল আবেদন ও বিশিষ্ট নাগরিকদের অনুরোধের পরেও হচ্ছে একের পর এক হরতাল। আর স্থগিত হচ্ছে একের পর এক জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট (জেএসসি) ও জুনিয়র দাখিল সার্টিফিকেট (জেডিসি) পরীক্ষা। প্রথম দু’দিনের হরতালে জেএসসি ও জেডিসির ২১ লাখ শিক্ষার্থীর প্রথম দুই পরীক্ষার সঙ্কট কাটতে না কাটতেই বৃহস্পতিবারের হরতালে পুরোপুরি অনিশ্চিত হয়ে পড়ল পরীক্ষাটি। পিছিয়ে যাচ্ছে সারাদেশে চলমান এসএসসি ও এইচএসসির নির্বাচনী পরীক্ষা। যেখানে অংশ নিচ্ছেন প্রায় ২৫ লাখ শিক্ষার্থী। পরীক্ষা পিছিয়ে যেতে থাকায় ২৩ নবেম্বর থেকে শুরু হতে যাওয়া ৩০ লাখ শিক্ষার্থীর প্রাথমিক সমাপনী ও সকল শ্রেণীর বার্ষিক পরীক্ষা নিয়েও ছড়িয়ে পড়ছে উদ্বেগ। প্রথম দুই দিনের পাঁচটি পরীক্ষা হরতালের কারণে পিছিয়ে যাওয়ায় ইতোমধ্যেই বিপর্যয়ে পড়েছে জেএসসি ও জেডিসি পরীক্ষা। একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে জামায়াত নেতা কামারুজ্জামানের মামলার রায়ের দিন সোমববার ধার্য হওয়ায় উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় রয়েছে পরীক্ষার্থী-অভিভাবকরা। এরই মধ্যেই মীর কাশেম আলীর ফাঁসির রায়ের প্রতিবাদে বৃহস্পতিবার পরীক্ষার মাঝে হরতাল দেয়া হয়। রবি ও সোমবারের পরীক্ষা আজ ও ১৪ নম্বেবর শুক্রবার নির্ধারণ করা হলেও আগের পরীক্ষার ভবিষ্যতই এখন অনিশ্চিত। গত এক সপ্তাহে হরতালের কারণে কমপক্ষে চারটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার সূচী পরিবর্তন করতে হয়েছে। সবমিলিয়ে টানা হরতালে পরীক্ষার সূচী বিপর্যয়ে আতঙ্কের মধ্যে আছে লাখ লাখ শিক্ষার্থী। জামায়াতের চেহারা, হরতাল ও আইন ॥ মার্কিন দূতাবাসের একটি গাড়ি ভাংচুর করে গত বছর জামায়াত-শিবির ক্ষতিপূরণ দিয়েছে। হামলা করার অপরাধে ক্ষমাও চেয়েছে। ওই ঘটনার পর থেকে জাতির কাছে একটি প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে তা হলো-মজেনা ক্ষতিপূরণ পেলে দেশের সাধারণ মানুষ নয় কেন? দেশের ১৬ কোটি মানুষ তো হরতালের কাছে জিম্মি এবং কোন না কোনভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে শুধু আর্থিক ক্ষতি নয়, জীবনহানি ঘটলেও হরতাল আহ্বানকারীদের কোন ক্ষতিপূরণ দিতে হচ্ছে না। অথচ বাংলাদেশের সংবিধানে ধ্বংসাত্মক, সহিংস ও জ্বালাও-পোড়াও হরতালের বিরুদ্ধে কঠোর বিধিনিষেধ রয়েছে। হরতালের এসব নেতিবাচক দিক সংবিধানে প্রদত্ত ৩৬, ৪০, ৪২ অনুচ্ছেদের সরাসরি লঙ্ঘন বলে মত দিয়েছেন সংবিধান বিশেষজ্ঞরা। তবে হরতাল সাংবিধানিক অধিকার হলেও জানমালের ক্ষতিসাধন কখনও সমর্থন করা হয়নি। সংবিধানের উপরোক্ত অনুচ্ছেদগুলো পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, হরতাল সমর্থনকারীরা সংবিধানের এ তিনটি অনুচ্ছেদের দোহাই দিলেও বর্তমানে প্রচলিত জ্বালাও-পোড়াও ধারার হরতাল সংবিধান সমর্থন করে না। বরং জালাও-পোড়াও কর্মসূচীর হরতালের কারণে সংবিধানের ৩৬ (চলাফেরার স্বাধীনতা), ৪০ (পেশা ও বৃত্তির স্বাধীনতা, ও ৪২ (সম্পত্তির অধিকার) অনুচ্ছেদ সরাসরি লঙ্ঘন করা হচ্ছে। হরতালের কারণে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস চলছে না। দেশের অর্থনীতি হয়ে পড়ছে স্থবির। সংবিধানের ২১ অনুচ্ছেদে প্রত্যেক নাগরিকের সংবিধান ও দেশের প্রচলিত আইন মানা কর্তব্য বলা হয়েছে। কিন্তু হরতালকে কেন্দ্র করে প্রতিনিয়ত মানুষের মৌলিক অধিকার লঙ্ঘন হচ্ছে।
×