ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

স্বামীকে গুলি আর আমার ইজ্জত নষ্ট করেছিল আলবদর রাজাকাররা

প্রকাশিত: ০৪:৩৬, ৪ নভেম্বর ২০১৪

স্বামীকে গুলি আর আমার ইজ্জত নষ্ট করেছিল আলবদর রাজাকাররা

সোহাগপুর বিধবা পল্লীর তিন নারীর জবানবন্দী জনকণ্ঠ রিপোর্ট ॥ মুক্তিযুদ্ধের সময় শ্রাবণ মাসের ১০ তারিখে সকাল সাতটার সময় পাঞ্জাবীরা আলবদর, রাজাকার আর শেরপুরের আলবদরদের বড় নেতা কামারুজ্জামান আমার স্বামীকে সোহাগপুর গ্রামে আমাদের বাড়িতে হত্যা করে। সে সময় কাদির ডাক্তার, বগাবুড়া পাকবাহিনীর সঙ্গে ছিল। পাকবাহিনী আমাদের বাড়িতে ঢুকে বন্দুক দিয়ে আমাকে আঘাত দিয়ে মাটিতে ফেলে দিয়ে আমার ইজ্জত নষ্ট করে (এ সময় সাক্ষী অঝোর ধারায় কাঁদছিলেন)। সেদিন তারা করফুলী বেওয়া, সমলা বেওয়াসহ অনেক মহিলার ইজ্জত নষ্ট করেছিল। কাদির ডাক্তার, বকাবুড়া অনেকের ইজ্জত নষ্ট করে। শেরপুরের কামারুজ্জামানও নাকি এদের সঙ্গে ছিল।’ এভাবেই আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে সোহাগপুরের গণহত্যা ও ধর্ষণের বর্ণনা দেন কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের ১২ নম্বর সাক্ষী হাফিজা বেওয়া। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ এ ২০১২ সালের ১১ অক্টোবর ক্যামেরা ট্রায়ালে এ লোমহর্ষক বর্ণনা দেন তিনি। একই দিন সোহাগপুরে নির্যাতনের শিকার আরও দুই নারী ট্রাইব্যুনালে ক্যামেরা ট্রায়ালের মাধ্যমে সাক্ষ্য দেন কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে। একাত্তর সালে কামারুজ্জামানের নেতৃত্বে সোহাগপুরে যে গণহত্যা ও নারী নির্যাতন হয়, এই তিন নারীর সাক্ষ্যে তার ভয়াল চিত্র ফুটে উঠেছে। সোহাগপুরে গণহত্যার বিষয়টি কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে তিন নম্বর অভিযোগ। এ অভিযোগে ট্রাইব্যুনাল তাকে মৃত্যুদ- দিয়েছিল। সোমবার সুপ্রীমকোর্টও সোহাগপুরে গণহত্যার ও ধর্ষণের অভিযোগে কামারুজ্জামানকে ট্রাইব্যুনালের দেয়া মৃত্যুদ-ের রায়ই বহাল রেখেছেন। জনকণ্ঠের পাঠকদের সুবিধার্থে ওই তিন নারীর ক্যামেরা ট্রায়ালে দেয়া জবানবন্দী মামলার নথি বই থেকে হুবহু তুলে দেয়া হলো। হাসেন বানু (রাষ্ট্রপক্ষের ১১ নম্বর সাক্ষী) ॥ আমার নাম হাসেন বানু। বয়স ৫৮ বছর। আমার স্বামী শহীদ আব্দুল লতিফ। মুক্তিযুদ্ধের সময় শ্রাবণ মাসের ১০ তারিখ সকাল বেলা আমার স্বামী সোহাগপুর গ্রামে গিয়েছিল হাল চাষ করতে। আমি তখন বাড়িতে রান্না করতে যাচ্ছিলাম। সকাল নয়টার দিকে গোলাগুলির শব্দ পেলাম। আমি তখন আমার বাচ্চা কোলে নিয়ে শ্বশুর-শাশুড়িসহ বাড়ির পশ্চিম দিকে পালিয়ে যাই। এর পর বিকেল চারটায় আমি বাড়িতে ফিরে এসে দেখি উঠানে আমার স্বামীর লাশ পড়ে আছে, তার সঙ্গে আরও দুই জনের লাশ পড়ে ছিল। তখন স্বামীর লাশের কাছে গিয়ে দেখি নাভির দিকে গুলি ঢুকে পিঠ দিয়ে বেরিয়ে গেছে। বাড়িতে আমার চাচাত ভাইয়রা ছিল। ঐখানে আরও যাদের লাশ পড়ে ছিল তাদের মধ্যে একজন আমার ভাতিজা আনসার আলীর লাশ ছিল। আরেকটি ছিল জহুরুল হকের। পরবর্তীতে সন্ধ্যার দিকে লাশগুলো মাটিচাপা দেয়া হয়। আলবদর কামারুজ্জামান, রাজাকার নসা, বকাবুড়া, মোজাফ্ফ এরা আমার স্বামীকে হত্যা করেছে। কামারুজ্জামান বড় নেতা আছিল। সেই ষড়যন্ত্র করে আমার স্বামীসহ অনেকের মঙ্গলবার দিন শ্রাবণ মাসের ১০ তারিখে হত্যা করেছে। আগের দিন ৯ শ্রাবণ অনুমান দশটার দিকে তিনজন আর্মি এবং আলবদর একটি মেয়েকে ধাওয়াইয়া আমার ঘরের ভেতরে ঢোকায় এবং একজন পাক সেনা ঐ মেয়েটার ইজ্জত নষ্ট করে। বাকি দু’জন ঘরের দুয়ারে দাঁড়িয়ে আমাকে বন্ধুক দেখায়। আমি তখন ঘরের ভেতর দাঁড়িয়ে ছিলাম। পরে তারা ঘরের ভেতর ঢোকে। এই দু’জন লোক আমার ইজ্জত নষ্ট করে। আমি অনেক অনুণয় বিনয় করেও তাদের হাত থেকে রক্ষা পাইনি। যুদ্ধের সময় আমার বয়স ছিল আনুমানিক ১৮ বছর। আমি আমার সম্ভ্রমহানি ও স্বামী হত্যার বিচার চাই। আসামি কামারুজ্জামান ডকে শনাক্ত। হাফিজা বেওয়া (রাষ্ট্রপক্ষের ১২ নম্বর সাক্ষী) ॥ আমার নাম হাফিজা বেওয়া। স্বামী- শহিদ ইব্রাহিম। আমার বয়স যুদ্ধের সময় ছিল ১৫/১৬ বছর। এখন ৫৬ বছর। একাত্তরে শ্রাবণ মাসের ১০ তারিখে সকাল সাতটার সময় পাঞ্জাবীরা আলবদর, রাজাকারসহ শেরপুরের কামারুজ্জামান আলবদরের বড় নেতা আমার স্বামীকে সোহাগপুর গ্রামে আমাদের বাড়িতে হত্যা করে। কামারুজ্জামানের নামে মুরব্বিদের কাছ থেকে শুনেছি। কাদির ডাক্তার, বগাবুড়া এরা পাকবাহিনীর সঙ্গে ছিল। এর পর পাকবাহিনী বাড়িতে ঢুকে বন্দুক দিয়ে আমাকে আঘাত দিয়ে মাটিতে ফেলে দিয়ে আমার ইজ্জত নষ্ট করে (এ সময় সাক্ষী অঝোর ধারায় কাঁদছিলেন)। সেদিন করফুলী বেওয়া, সমলা বেওয়াসহ অনেক মহিলার ইজ্জত নষ্ট করেছিল তারা। কাদির ডাক্তার, বকাবুড়া এরা ইজ্জত নষ্ট করে শেরপুরের কামারুজ্জামানও নাকি এদের সঙ্গে ছিল। আমার স্বামী ছাড়াও ঐ গ্রামে আমার চাচা সিরাজ আলী. খেজুর আলী, আমার ভাই আবুল হোসেনসহ অনেককে হত্যা করে। জালাল উদ্দিন ও অন্যান্য লোকেরা এই লাশগুলো মাটি চাপা দেয়। কষ্টে আমার বুক ফেটে যাচ্ছে। আসামি কামারুজ্জামান ডকে শনাক্ত। আমি স্বামী হত্যার এবং আমার ইজ্জতহানির বিচার চাই। করফুলী বেওয়া (রাষ্ট্রপক্ষের ১৩ নম্বর সাক্ষী) ॥ আমার নাম করফুলী বেওয়া। আমার স্বামী শহীদ রহিমুদ্দিন। ঘটনার সময় আমার বয়স ছিল আনুমানিক ২৫ বছর। ১৯৭১ সালে আমার স্বামী শ্রাবণ মাসের দশ তারিখে মঙ্গলবার দিন বন্দে (মাঠে) হালচাষ করতে গেছিল। তখন বন্দের মধ্যে গোলাগুলির শব্দ শুনতে পাই। যারা হালচাষ করতেছিল তাদের ঐখানেই মারছে। যারা জালা (ধানের চারা) ভাঙ্গতে ছিল তাদের সেখানেই গুলি করে মারছিল। এই ঘটনাটি ঘটে সেদিন (বর্তমানে) সোহাগপুর বিধবা পল্লীতে। আমার স্বামী হাল ছেড়ে দিয়ে বাড়িতে চলে এসে হায় হায় করছিল। তারপর পাঞ্জাবী দুইটা ঘরে আইল, তাদের সঙ্গে আসলো নসা, বগাবুড়া, কামারুজ্জামান। পাকিস্তানী সেনা তখন আমার স্বামীকে বল্্ল, তুম মুক্তি হে। যখন আমার স্বামী চৌকির উপর বসে ছিল তখন বলছিল বন্ধু এধার আসো। আমার স্বামী ওদের কাছে গেলে আমার স্বামীকে ওরা গলায় গুলি করে। পরে আরেকটা গুলি করে পেটে, এতে নাড়িভুঁড়ি সব বেরিয়ে যায়। আমার স্বামীর বোন জামাইকেও মেরে ফেলে। আমরা লাশ গোয়াল ঘরে ঢেকে রেখে নকলা চলে যাই। তিনদিন পরে ফিরে দেখি আমার স্বামীর লাশ শিয়াল-কুকুরে খেয়ে ফেলেছিল। তখন মাথার খুলি, হাতের হাড় মাটি চাপা দিয়ে থুয়ে নকলা চলে যাই। পরে আবার যখন আসলাম তখনও এই বদর ও পাঞ্জাবীরা আবার অত্যাচার শুরু করে। তিন দিন পর আমি যখন বাড়িতে আসি তখন আমি গোয়াল ঘরে দাঁড়িয়েছিলাম। তখন পাঞ্জাবীরা এসে আমার ইজ্জত নষ্ট করে। তখন কামারুজ্জামানের সঙ্গে ছিল নসা, বগাবুড়া এবং কামারুজ্জামান। আসামি ডকে শনাক্ত। আমি আমার স্বামী হত্যা ও ইজ্জতহানির বিচার চাই।
×