ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

চতুর্থ মৃত্যুবার্ষিকী আজ

মুক্তির মিছিলে নির্ভীক অভিযাত্রী কলিম শরাফী

প্রকাশিত: ০৪:১৯, ২ নভেম্বর ২০১৪

মুক্তির মিছিলে নির্ভীক অভিযাত্রী কলিম শরাফী

গৌতম পাণ্ডে ॥ সূর্য স্নান চলচ্চিত্রের গান ‘পথে পথে দিলাম ছড়াইয়া’ অথবা ‘আকাশ ভরা সূর্য তারা’ রবীন্দ্রসঙ্গীতের ভরাট কণ্ঠের সেই রেকর্ড আজও চিত্ত প্রসন্ন হয়। যার জাদুকরী কণ্ঠে অগণিত শ্রোতা সুরের স্বর্গলোকে পৌঁছে যায় তিনি হলেন সঙ্গীতজ্ঞ প্রয়াত কলিম শরাফী। আজ রবিবার সঙ্গীতাঙ্গনের এই দীপ্তিময় শিল্পীর চতুর্থ মৃত্যুবার্ষিকী। রাজধানীর বারিধারার নিজ বাসভবনে ৮৬ বছর বয়সে ২০১০ সালের এই দিনে বেলা ১১টা ৫৫ মিনিটে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। সঙ্গীতের শৈল্পিক সুরভী মানুষকে কতটা পরিচ্ছন্ন করে তা তিনি দেখিয়েছেন তাঁর শিল্পী সত্তা দিয়ে। তাঁর সঙ্গীত আজও বাঙালী চিত্তকে মহিত করে রেখেছে। মানুষকে বড় ভাল বেসেছিলেন তিনি, তাই হয়ত সঙ্গীত দিয়েই মানুষের চিত্তের শূন্যতাকে পূরণ করতে চয়েছিলেন আজীবন। মানুষের জীবনের ব্যথা-বেদনা, সুখ-দুঃখ, ক্ষোভ ও অধিকার আদায়ের উদ্দীপ্ত সেøাগানে সব সময় শামিল হতে চেয়েছেন এই নির্লোভ প্রতিবাদী মানুষটি। সে জন্যই হয়ত তিনি ভারতীয় গণনাট্য সঙ্ঘের মধ্য দিয়ে সেই গণজাগরণের গানই ধারণ করেছিলেন। মানব মুক্তির মিছিলে তিনি ছিলেন নির্ভীক অভিযাত্রী। গানই ছিল তাঁর জীবন সাধনা। উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর সভাপতি হয়ে গণমানুষকে সচেতন করে তোলার ব্রত নিয়েছিলেন তিনি। গণসঙ্গীত দিয়ে যাত্রা শুরু করে রবীন্দ্রনাথের গানই হয়ে ওঠে তাঁর জীবনের আরাধ্য সাধনার ধন। সঙ্গীতকে ঘিরে পথ চলতে চলতে কোন এক সময়ে প্রতিষ্ঠানে পরিণত হন শিল্পী কলিম শরাফী। রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী সংস্থার যে কোন অনুষ্ঠানে শুধুমাত্র সভাপতি হিসেবে নয়, তাঁর সরব উপস্থিতি ছিল সব সময় প্রাণোচ্ছল। এমনকি হুইল চেয়ারে করে পাবলিক লাইব্রেরী মিলনায়তনে যখন তিনি শেষবারের মতো উপস্থিত হলেন সংস্থা কর্তৃক তাঁর ৮৬তম জন্মদিন পালনে, তখনও তাঁর উপস্থিতি ছিল সবার জন্য অত্যন্ত আনন্দের ও বাড়তি পাওনা। কলিম শরাফী ১৯২৪ সালে ৮ মে বীরভুম জেলার খৈরাডিহি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম সমী আহমদ শরাফী। তিনি ১৯৪৭ সালে শুভ গুহঠাকুরতার প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠান ‘দক্ষিনী’তে রবীন্দ্রসঙ্গীত শেখা শুরু করেন। পরবর্তীতে সেখানে তিান শিক্ষকতাও করেছেন। ছাত্র থাকা কালীন প্রতিষ্ঠানটির অন্যান্য শিক্ষকদের পাশাপাশি শিল্পী সুবিনয় রায়ের সান্নিধ্যে রবীন্দ্রসঙ্গীতে তালিম নেন। ১৯৪৮ সালে তিনি মহর্ষী মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য, শম্ভু মিত্র, তৃপ্তি মিত্র, মোঃ ইসমাইল প্রমুূখের সঙ্গে মিলে ‘বহুরূপী নাট্য সংস্থা’ নামে একটি নাটকের সংগঠন গড়ে তোলেন। এ দলের হয়ে ‘নবান্ন’, ‘পথিক’, ‘ছেড়া তার’ ‘রক্ত করবী’সহ বহু নাটকে তিনি অভিনয় করেছেন। ১৯৫০ সালে তিন ঢাকায় চলে আসেন। ঢাকাতে তিনি বেতারে নবীন শিল্পী হিসেবে যোগ দেন। এবং বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গণসঙ্গীত পরিবেশন করতেন। তাঁর গাওয়া ‘অবাক পৃথিবী’ গানটির জন্য তিনি তৎকালীন পাকিস্তানী গোয়েন্দাদের কুনজরে পড়েন এবং ঢাকা ছেড়ে চট্টগ্রামে গিয়ে গড়ে তোলেন ‘প্রান্তিক’ নাট্যদল। ১৯৫৭ সালে পূর্ববাংলায় নির্মিত ‘আকাশ আর মাটি’ চলচ্চিত্রে রবীন্দ্রসঙ্গীত দিয়ে তার প্রথম প্লেব্যাক শুরু। ১৯৫৮ সালে তাঁর গান রেডিওতে সম্প্রচার নিষিদ্ধ করা হয়। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার আগে এ নিষেধাজ্ঞা আর তুলে নেয়া হয়নি। ১৯৬০ সালে তিনি এসএম মাসুদ প্রযোজিত ‘সোনার কাজল’ চলচ্চিত্রটি পরিচালনা করেন। ১৯৬৭ সালে তিনি উদীচীর উপদেষ্টা ছিলেন পরে সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৮৩ সালে তিনি ‘সঙ্গীত ভবন’ নামে একটি সঙ্গীত শিক্ষালয় প্রতিষ্ঠা করেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি এই প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষ ছিলেন। ১৯৮৬ সালে সংস্কৃতি অঙ্গনে বিশেষ অবদানের জন্য তিনি ‘একুশে পদক’ এ সম্মানিত হন। ১৯৯২ সালে তিনি বাংলা একাডেমি ফেলোশিপ অর্জন করেন। তিনি তাঁর সাফল্যের জন্য একুশে পদকসহ অনেক পুরস্কার অর্জন করেন। ১৯৯৮ সালে গণসাহায্য সংস্থা সম্মাননা, ২০০০ সালে মহান স্বাধীনতা পদক, ২০০২ সালে জনকণ্ঠ সম্মাননাসহ বহু পুরস্কার ও সম্মাননা অর্জন করেন তিনি। ২০১০ সালের ২ নভেম্বর তিনি পৃথিবী ছেড়ে চির বিদায় নেন।
×