ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

এক পাকি দ-িত লক্ষ পাকি বর্তমান

প্রকাশিত: ০৬:০৩, ১ নভেম্বর ২০১৪

এক পাকি দ-িত লক্ষ পাকি বর্তমান

(৩১ অক্টোবরের পর) ॥ দুই ॥ সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার আগে দ্বিতীয়বার ১৯৭৩ সালের ১৬ মে দালাল আইন সংশোধন করা হয়। যাঁরা বলেন, বঙ্গবন্ধু আলবদর ও খুনীদের ক্ষমা করেছেন তাঁরা যে কত বড় নির্জলা মিথ্যা বলেন তার প্রমাণ দ্বিতীয় সংশোধনী। ১৯৭৩ সালের ১৬ মে বাংলাদেশ দালাল (বিশেষ ট্রাইব্যুনাল) আদেশের ৪ অনুচ্ছেদে বলা হয়, ‘অত্র আদেশে বর্ণিত অনুকম্পা ব্যক্তিদের প্রতি এবং অপরাধসমূহের প্রতি প্রযোজ্য হবে না, যা এই অনুচ্ছেদের ৯টি দফায় উল্লেখ করা হয়। সেগুলোর কয়েকটি- ‘ঙ. আলবদর বা আলশামস সংগঠনের সদস্য হইয়া যাহারা দখলদার বাহিনীর সহিত সহযোগিতার অপরাধ করিয়াছেন বলিয়া যাহারা সাজাপ্রাপ্ত বা অভিযুক্ত বলিয়া কথিত। চ. রাজাকার কমান্ডার হইয়া দখলদার বাহিনীর সহযোগিতার অপরাধ করিয়াছেন বলিয়া যাহারা সাজাপ্রাপ্ত বা কথিত। জ. দখলি আমলে সাবেক পূর্ব পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় শান্তি কমিটির কর্মকর্তা হইয়া যাহারা দখলদার বাহিনীর সহিত সহযোগিতার অপরাধ করিয়াছেন বলিয়া সাজাপ্রাপ্ত বা অভিযুক্ত বা কথিত। ঝ. মুক্তিযোদ্ধাদের তৎপরতা ও সংগঠন দমন যা পার্থিব সুবিধা আদায়ের মানসে দখলদার বাহিনীর সহিত সহযোগিতার অপরাধ করিয়াছেন বলিয়া যাহারা সাজাপ্রাপ্ত বা অভিযুক্ত বা কথিত।’ এছাড়া বলা হয়েছিল, ‘অবশ্য মুক্তির শর্ত হইতেছে যে, তাহারা উপরোক্ত আদেশের বাহিরে বিচারযোগ্য ও শাস্তিযোগ্য অন্য কোনো অপরাধের সহিত সংশ্লিষ্ট নহে।’ [ দেখুন, বিচারপতি মোহাম্মদ গোলাম রাব্বানী, ‘যুদ্ধাপরাধীদের বিচার : কুযুক্তি বনাম সুযুক্তি, ৭৩-এর আইনের সহজ পাঠ এবং ‘৭১-এর গণহত্যা,’ মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ ও যুদ্ধাপরাধের বিচার : দেশে-বিদেশে প্রশ্ন : নির্মূল কমিটি, ২০১০] মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচারের জন্য ও ভষ্যিতে তাদের উত্থান রোধে বঙ্গবন্ধুর সরকার যে সব আইন করেছিল তার একটি সংক্ষিপ্তসার দেয়া যেতে পারে- ১. ১৯৭২ সালের ২৪ শে জানুয়ারি বাংলাদেশ দালাল আইন জারি করা হয়, যা পরিচিত চ.ড়.ঘড়.ঠওও ড়ভ ১৯৭২. ২. ১৯৭২ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি স্ব স্ব জেলা কোর্টে অধ্যাপক গোলাম আযম গংদের হাজির হওয়ার নির্দেশ। ৩. ১৯৭২ সালের ১৫ই ডিসেম্বর বাংলাদেশ নাগরিকত্ব আইন জারী যা পরিচিত চ.ড়.ঘড়. ১৪৯ ড়ভ ১৯৭২. ৪. ১৯৭৩ সালের ১৮ই এপ্রিল গেজেট বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে গোলাম আযম গংদের নাগরিকত্ব বাতিল। ৫. ১৯৭২ সালের ৪ঠা নভেম্বর বাংলাদেশের সংবিধানের ১২ ও ৩৮ অনুচ্ছেদ মোতাবেক ধর্ম নিয়ে রাজনীতি করা রহিত। ৬. ৬৬ ও ১২২ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী দালালদের ভোটাধিকার ও সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণের অধিকার বাতিল। [জাতীয় সংসদে শেখ হাসিনা ভাষণ, ১৬.৪.১৯৯২] একটি বিষয় লক্ষণীয়। মওলানা ভাসানী, মোজাফফর আহমদ বা অলি আহাদ মুক্তিযুদ্ধ দেখেছিলেন, আলবদর ও অন্য স্বাধীনতাবিরোধীদের নৃশংসতা দেখেছেন বা তার কথা শুনেছেন। প্রথমোক্ত দু’জন মুজিবনগর সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্যও ছিলেন। অথচ তাঁরা আল বদর, আল শামস, রাজাকারদের বিচারের বিরোধিতা করেছেন। বঙ্গবন্ধু ১৯৭১ সাল দেখেননি। মুক্তির পূর্ব পর্যন্ত এর বীভৎসতা, নির্দয়তা সম্পর্কে সম্যক অবহিতও ছিলেন না। কিন্তু, অপরাধীদের বিচারে সর্বতোভাবে ব্যবস্থা নিয়েছিলেন। দালাল আইন শুধু নয়, তিনি আরেকটি আইনও করেছিলেন। ওয়ালিউর রহমান লিখেছেন, ‘১৯৭২ সালের ৩ জুলাই ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সরকারপ্রধান পর্যায়ে সিমলা চুক্তি হওয়ার পরই বঙ্গবন্ধু অনুধাবন করেছিলেন যে, যুদ্ধাপরাধীরা হয়ত আইনের ফাঁক দিয়ে বের হয়ে যেতে পারে। তাছাড়া দালাল আইনে ’৭১-এর গণহত্যা, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ ও যুদ্ধাপরাধ বিচারের কতগুলো বাস্তব সমস্যা ছিল।’ এ পরিপ্রেক্ষিতে তিনি পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুস সামাদ আজাদ ও আইনমন্ত্রী কামাল হোসেনকে নির্দেশ দেন যুদ্ধাপরাধ বিচারের জন্য সময়োপযোগী একটি আইনের খসড়া করতে। তাঁদের তিনি বলেছিলেন- ‘পাকিস্তানী যুদ্ধাপরাধী এবং তাদের সহায়ক শক্তি যারা পাকিস্তানী আর্মিকে সহযোগিতা করেছিল তাদের প্রত্যেককেই বিচারের আওতায় আনতে হবে।’ এ জন্য একটি কমিটি করা হয় যার প্রধান ছিলেন ড. কামাল হোসেন। অন্য সদস্যরা ছিলেন বিচারপতি এফ কে এম এ মুনএম এ [পরবর্তীকালে প্রধান বিচারপতি], ফকির শাহাবুদ্দীন আহমদ [এ্যাটর্নি জেনারেল]. ব্যারিস্টার সৈয়দ ইশতিয়াক আহমেদ, আইন মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব, নাসিমউদ্দিন আহমদ, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আইন উপদেষ্টা ব্যারিস্টার হারুনুর রশীদ, এ্যাডভোকেট মাহমুদুল ইসলাম [পরবর্তীকালে এ্যাটর্নি জেনারেল] ও জেনেভা মিশনপ্রধান ওয়ালিউর রহমান [পরবর্তীকালে সরকারের সচিব], কলকাতা থেকে দু’জন প্রখ্যাত ব্যারিস্টারও এসেছিলেন সহায়তার জন্য। তাঁরা হলেন সুব্রত রায় চৌধুরী ও দীপঙ্কর ঘোষ। নুরেমবার্গ ট্রায়ালের সঙ্গে জড়িত ছিলেন এমন দু’জন প্রখ্যাত আইনজ্ঞের সাহায্যও কমিটি নিয়েছিল। তাঁরা হলেন অধ্যাপক জেসচেক ও অধ্যাপক অটো ভন ট্রিফটারার। [ দেখুন ওয়ালিউর রহমান, ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন : সংক্ষিপ্ত ইতিহাস’, পূর্বোক্ত] এভাবে ১৯৭৩ সালের ১৯ নং আইনটি প্রণীত হয়। ‘উক্ত আইনটি ‘গণহত্যা জনিত অপরাধ,’ ‘মানবতা বিরোধী অপরাধ’ বা ‘যুদ্ধাপরাধ’ এবং আন্তর্জাতিক আইনের অধীন অন্যান্য অপরাধের জন্য কোন সশস্ত্র বাহিনী বা প্রতিরক্ষাবাহিনী বা সহায়ক বাহিনীর সদস্য কিংবা যুদ্ধাপরাধীকে আটক, ফৌজদারী আইনে সোপর্দ, কিংবা দ-দান করার অভিপ্রায় আইন সভা কর্তৃক প্রণীত হয়, যা স্থানীয়ভাবে ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন’ ১৯৭৩ [ ওহঃবৎহধঃরড়হধষ ঈৎরসবং (ঃৎরনঁহধষং) ধপঃ. ১৯৭৩] নামে অভিহিত।’ এই আইনের প্রয়োগের ক্ষেত্রে সংবিধানের ৩নং অনুচ্ছেদ অর্থাৎ মৌলিক অধিকার সংক্রান্ত অনুচ্ছেদ প্রযোজ্য হবে না। [দেখুন বিচারপতি সৈয়দ আমিরুল ইসলাম, ‘৭৩-এর আইন ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, পূর্বোক্ত] ১৯৭৩ সালের ২০ জুলাই এই আইনটি পাস হয় এবং সংবিধান কর্র্র্তৃক সুরক্ষিত হয়। এ কারণে পরবর্তীকালে জেনারেল জিয়া আইনটি বাতিল করতে পারেনি। বা হয়ত ভুলে গিয়েছিলেন। কারণ এর আগে বন্দুকের সাহায্যে তিনি সব তছনছ করে দিয়েছিলেন। এই আইনে ১৯৭১ সালের অপরাধীদের আরও ব্যাপক ও সুনির্দিষ্টভাবে বিচার করতে পারেনি। কিন্তু ঐ আইনটি অগোচরে সুরক্ষিত হয়।
×