ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

আইনী জটিলতায় ঝুলে গেছে ওষুধ নীতি, জনস্বাস্থ্য হুমকির মুখে

প্রকাশিত: ০৫:৫১, ১ নভেম্বর ২০১৪

আইনী জটিলতায় ঝুলে গেছে ওষুধ নীতি, জনস্বাস্থ্য হুমকির মুখে

নিখিল মানখিন ॥ আইনী জটিলতায় আটকে পড়েছে জাতীয় ওষুধ নীতি। উচ্চ আদালতে বিচারাধীন থাকায় নীতিমালা চূড়ান্ত করার বিষয়টি অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। ২০১২ সালের নবেম্বর মাসে নীতিমালা প্রণয়ন কমিটি খসড়া নীতিমালা তৈরি করে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে জমা দিয়েছিল। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় নীতিমালার ওপর স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের মতামত চাওয়া হয়। এরপর নীতিমালা প্রণয়ন কমিটির একজন সদস্যের আপত্তি ও আদালতে মামলা করার পর তা আর আলোর মুখ দেখেনি। নীতিমালা যুগোপযোগী না করায় ও ওষুধ বিক্রির গেজেট প্রকাশ না করায় এখন বাজারে নকল ও ভেজাল ওষুধের ছড়াছড়ি। ক্রেতারা প্রতিনিয়ত প্রতারিত হচ্ছে। এতে হুমকির মুখে পড়েছে জনস্বাস্থ্য। প্রস্তাবিত নীতিমালায় বলা হয়েছে, সব স্বীকৃত পদ্ধতির ওষুধের সর্বোত্তম তাত্ত্বিক পরিচয়কে চিকিৎসক ও ফার্মাসিস্ট উভয়ের কাছে সহজ করে তোলা হবে। এ লক্ষ্যে ওষুধের বাণিজ্যিক নামের পাশাপাশি স্পষ্টভাবে জিনেরিক নামে উৎপাদন ও বিপণন করতে হবে। তিন দশকের পুরনো ওষুধনীতি দিয়ে চলছে দেশের বিকাশমান ওষুধ শিল্প। গত কয়েক বছরে বাংলাদেশের ওষুধ শিল্প দ্রুত বিকাশ হলেও সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ওষুধনীতির আধুনিকায়ন করা হয়নি। এতে নকল, ভেজাল ও নিম্নমানের ওষুধ বাজারে সহজে জায়গা করে নিচ্ছে। রোধ করা যাচ্ছে না ওষুধের লাগামহীন উচ্চ মূল্য। পুরনো নীতিমালার বাধ্যবাধকতায় ওষুধের মান ও কার্যকারিতা নিয়েও ক্রেতারা কোন তথ্য জানতে পারছেন না। তাদের নির্ভর করতে হচ্ছে কমিশন আকাক্সক্ষী ডাক্তারদের ওপর, যারা অজ্ঞাত-অখ্যাত কোম্পানির মানহীন ওষুধ লিখে দিচ্ছেন ক্রেতাদের ব্যবস্থাপত্রে। সব মিলিয়ে যুগোপযোগী ওষুধনীতি না থাকায় দেশজুড়ে ওষুধ বাণিজ্যে চলছে সীমাহীন নৈরাজ্য। ওষুধ শিল্প নিয়ন্ত্রণে ১৯৮২ সালে সর্বশেষ আইন কার্যকর হয়। এরপর দীর্ঘ ৩২ বছরে বাংলাদেশের ওষুধ শিল্প আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত হয়েছে। এ দেশের তৈরি ওষুধ নিজেদের ৯৮ ভাগ চাহিদা মিটিয়ে বিশ্ব বাজারে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। কিন্তু একটি আধুনিক ওষুধনীতি বাস্তবায়নের কাজ তিন দশকেও শেষ হয়নি। ২০০৫ সালে সরকার জাতীয় ওষুধ নীতি তৈরির ঘোষণা দেয়। সেই অনুযায়ী ২০১২ সালে একটি খসড়া তৈরি করে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে ফাইলবন্দী রয়েছে। জাতীয় ওষুধ নীতি যুগোপযোগী করার জন্য ওই বছর স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের একজন অতিরিক্ত সচিবকে প্রধান করে ৮ সদস্যবিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন করা হয়েছিল। কমিটিতে ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের কর্মকর্তা ও ওষুধ বিশেষজ্ঞ রয়েছেন। ওষুধ প্রশাসন সূত্র জানায়, বাংলাদেশ ফার্মাসিউটিক্যাল সোসাইটির সংশ্লিষ্টতা ছাড়া খসড়া নীতিমালা প্রণয়ন করায় আদালতে মামলা দায়ের করা হয়। আদালত শুনানি শেষে বাদীর পক্ষে রায় দেয়। পরে এই ঘটনা উচ্চ আদালত পর্যন্ত গড়ায়। সেখানে শুনানি শেষে আদালত বাদীর পক্ষে রায় দেয়। পরবর্তীতে উচ্চ আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে রিট করেন বাংলাদেশ ফার্মাসিউটিক্যাল সোসাইটির আরেক নেতা। এরপর ওষুধ নীতিমালা প্রণয়নের কার্যক্রম স্থগিত হয়ে যায়। সেই কার্যক্রম নতুন করে আর চালু করা হয়নি। ওষুধ প্রশাসন অধিদফতর আরও জানায়, ২০০৫ সালের পরে প্রথম ওষুধ নীতিকে যুগোপযোগী করে খসড়া তৈরি করা হয়েছে। এই নীতিমালা হালনাগাদ করার জন্য সব ধরনের তথ্য সংযুক্ত করার টার্গেট নেয়া হয়েছিল। এর মধ্যে অত্যাবশ্যকীয় ওষুধের তালিকা ছাড়াও ইউনানি, আয়ুর্বেদিক, হোমিওপ্যাথিক ওষুধের তালিকার ওপর জোর দেয়া হয়েছে। আরও জানা গেছে, ওষুধের দোকানগুলোতে দেশী-বিদেশী বিভিন্ন ধরনের ফুড সাপ্লিমেন্ট বিক্রি হচ্ছে। রোগীরা চিকিৎসকের পরামর্শক্রমে এসব ওষুধ হিসেবে কিনে খাচ্ছে। কিন্তু এসব ফুড সাপ্লিমেন্ট বিক্রির কোন গাইডলাইন নেই। ওষুধ দোকানের অসাধু মালিকরা নিজেদের খুশিমতো বাড়তি দামে বিক্রি করছে। ফুড সাপ্লিমেন্ট ওষুধের দোকানে রাখার কোন নিয়মকানুন নেই। নতুন ওষুধ নীতিমালায় এই সম্পর্কে নির্দিষ্ট গাইডলাইনসহ নতুন নতুন অনেক বিষয় সংযুক্ত করা হয়েছে । আরও জানা গেছে, ওষুধ আমদানি, ওষুধ তৈরি, কারখানা তৈরির নিয়ম ও শর্ত, ওষুধ কেনা ও বিক্রি, রফতানি, মার্কেটিং নীতিমালা, ওষুধের মূল্য নির্ধারণ, ওষুধ বিক্রির গাইডলাইন তৈরি, গেজেট প্রকাশসহ ওষুধ সংক্রান্ত সব ধরনের নিয়ম ওষুধ নীতিতে অন্তর্ভুক্ত থাকবে। চিকিৎসা ছাড়পত্র ছাড়াও যেসব ওষুধ (ওটিসি) খুচরা দোকানে বিক্রি করা হয় তার তালিকা তৈরি করে নিয়ম নির্ধারণ করা হবে। এছাড়াও ডাক্তার প্রেসক্রিপশন (চিকিৎসা ব্যবস্থাপত্র) দেখে ওষুধ বিক্রির বিভিন্ন শর্ত তুলে ধরা হবে। ওষুধ প্রশাসন অধিদফতর আরও জানায়, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের প্রণয়ন করা এ নীতিমালা অনুযায়ী একটি মূল্যনির্ধারণী কমিটির মাধ্যমে সরকার ওষুধের দাম নির্ধারণ করে দেবে। সরকারী-বেসরকারী হাসপাতালে গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্টদের তত্ত্বাবধানে গঠন করা হবে ‘হসপিটাল ফার্মেসি’ এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে হবে ‘কমিউনিটি ফার্মেসি’ শক্তিশালী করা হবে । আদায়কৃত রাজস্বের ১৫ শতাংশের অংশিদার হবেন এ প্রতিষ্ঠানের কর্মীরা। এ ছাড়া সব বিভাগীয় শহরে ওষুধ পরীক্ষাগার স্থাপন করা হবে। খসড়া নীতিমালায় আরও বলা হয় ১শ’ বা তার বেশি শয্যাবিশিষ্ট দেশের সব সরকারী ও বেসরকারী হাসপাতালের ফার্মাকোলজি বিভাগে ওষুধের বিরূপ প্রতিক্রিয়া তদারকির জন্য ‘ফোকাল পয়েন্ট’ নির্ধারণ করা হবে। কোন একটি মেডিক্যাল কলেজকে এ বিষয়ে জাতীয় কেন্দ্র ঘোষণা করে এ কার্যক্রম শক্তিশালী করা হবে। সব স্বীকৃত পদ্ধতির ওষুধের সর্বোত্তম তাত্ত্বিক পরিচয়কে চিকিৎসক ও ফার্মাসিস্ট উভয়ের কাছে সহজ করার লক্ষ্যে ওষুধের বাণিজ্যিক নামের পাশাপাশি স্পষ্টভাবে জিনেরিক নামে উৎপাদন ও বিপণন করতে হবে বলেও প্রস্তাবিত নীতিমালায় উল্লেখ করা হয়েছে। ওষুধের সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য নির্ধারণ করবে এবং প্রতি বছর এ মূল্য পর্যালোচনা করা হবে। এ মূল্য নির্ধারণী কমিটিতে সরকার, উৎপাদক কোম্পানি ও ভোক্তার যথাযথ প্রতিনিধিত্ব থাকবে। কোম্পানির অজান্তে বাজারে ওষুধের দামের ওঠানামা প্রতিরোধে জাতীয় ওষুধ নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষের অধিবীক্ষণ কার্যকরভাবে বাড়ানো হবে এবং এতে ভোক্তার প্রতিনিধি অন্তর্ভুক্ত করা হবে। কোন ভোক্তা নি¤œমানের নকল ভেজাল চোরাচালান করা ওষুধ ব্যবহারে ক্ষতিগ্রস্ত তিনি যাতে উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ পেতে পারেন তা নিশ্চিত করার জন্য বিদ্যমান আইন সংশোধন করা হবে বলে খসড়া নীতিমালায় উল্লেখ করা হয়েছে। বিএমএ মহাসচিব অধ্যাপক ইকবাল আর্সলান জানান, বর্তমানে যে ওষুধ নীতিমালা আছে তা শিল্পবান্ধব, রোগীবান্ধব নয়। এখন দেশে রোগীবান্ধব ওষুধ নীতি হওয়া উচিত বলে তিনি মনে করেন। ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের একজন পরিচালক বলেন, খসড়া ওষুধ নীতিমালায় অত্যাবশ্যকীয় ওষুধের তালিকা নতুন করে তৈরি করা হয়েছে। আগে অত্যাবশ্যকীয় তালিকায় ২০৯টি থাকলেও এখন তা সংযোজন ও বিয়োজন করে ২৫৪টি করা হয়েছে। ব্যবস্থাপত্র ছাড়া (ওটিসি) যেসব ফুড আইটেম বিক্রি করা হচ্ছে তা আইনী প্রক্রিয়ায় নিয়ন্ত্রণ করার জন্য সুপারিশ করা হয়েছে। নকল ঠেকাতে বিভিন্ন সুপারিশ প্রণয় করা হয়েছে বলে জানা গেছে।
×