ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

বাঙালী সংস্কৃতির আড়াই হাজার বছরের ঐতিহ্য নিয়ে রেপ্লিকা হচ্ছে

প্রকাশিত: ০৫:৪৭, ১ নভেম্বর ২০১৪

বাঙালী সংস্কৃতির আড়াই হাজার বছরের ঐতিহ্য নিয়ে রেপ্লিকা হচ্ছে

সমুদ্র হক ॥ বাঙালীর সংস্কৃতির আড়াই হাজার বছরের ঐতিহ্যের বিশাল ভা-ারের গভীরতা বিশ্বকে জানাতে দেশে এই প্রথম ইতিহাসের বিষয়বস্তু নিয়ে রেপ্লিকা (অনুকৃতি) তৈরি হচ্ছে বগুড়ায়। প্রাচীন পুন্ড্রবর্ধন ভুক্তির রাজধানী পুন্ড্রনগর মহাস্থানগড়ের কাছেই শেখেরকোলা পালপাড়া গ্রামের যে কুমোররা বগুড়ার দইয়ের সরা ও খুঁটি বানাত তাদেরই প্রশিক্ষণ দিয়ে বানানো হচ্ছে রেপ্লিকা। প্রতœতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলো থেকে টেরাকোটার ছবি তুলে কম্পিউটারের মাধ্যমে প্রিন্ট করে তা দেখে ডাইস (ছাঁচ) বানানোর পর জলাশয়ের নিচের আঠালো মাটি দিয়ে রেপ্লিকা তৈরি করা হয়। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতœতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক সুফি মোস্তাফিজুর রহমানের নেতৃত্বে ‘ঐতিহ্য অšে¦ষণ’ (আরকিওলজি রিসার্চ সেন্টারে) নামের প্রতিষ্ঠানের আয়োজনে এই কাজ শুরু হয়েছে বগুড়ায়। পর্যায়ক্রমে নওগাঁর পাহাড়পুর, দিনাজপুরের কান্তজীর মন্দির, বাগেরহাটের ষাটগম্বুজ মসজিদ এলাকায় সম্প্রসারিত হবে। যাঁরা প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন তাঁরাই পরবর্তীদের রেপ্লিকা বানানো শেখাবেন। অধ্যাপক সুফি মোস্তাফিজুর রহমান বললেন “আমরা আর এখন হাজার বছরের বাঙালী নই। উয়ারি বটেশ্বর ও মহাস্থানগড়ের মাটির নিচের ইতিহাস প্রমাণ করে সাক্ষ্য দিচ্ছে বাঙালীরা আড়াই হাজার বছরের। ইতিহাসের এই ধারাবাহিকতার হার্ডকোর প্রমান স্থান পেয়েছে অক্সফোর্ড ও কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে। এর সঙ্গেই যোগ হচ্ছে মিক্স ও নতুন অনুষঙ্গ। আড়াই হাজার বছর আগের বাঙালীর ইতিহাস, প্রাণী জগত উদ্ভিদ জগতের পরিচয়সহ সেদিনের প্রকৃতির সবই টেরাকোটায় অঙ্কিত আছে। কান্তজীর মন্দিরের প্রায় সাড়ে তিন হাজার টেরাকোটা এতটাই সমৃদ্ধ যে, ওই সময়ের বাঙালী জাতির প্রাত্যহিক জীবনের সব মৃৎশিল্পের কারুকার্যে তুলে ধরা হয়েছে। এমন টেরাকোটা মহাস্থানগড়, ভাসু বিহার, উয়ারি বটেশ্বর, পাহাড়পুরসহ প্রতœতাত্ত্বিক সকল জায়গাতেই আছে। যেমন ষাঁড়ের লড়াই, গরুর গাড়ি, হাঁস পাখি ময়ূর, হাতি শিকার ফুল গাছগাছালি কৃষি সভ্যতাসহ এমন কিছু নেই যা টেরাকোটায় শিল্পের চেতনায় পরিচয় বহন করেনি। ইতিহাসের এই বিষয়বস্তু ধরে রাখার তাড়না থেকেই রেপ্লিকা বানানোর উদ্যোগ নেয়া হয়। যাতে দেশের মানুষ ও পর্যটক এই রেপ্লিকা কিনে ঘরে ইতিহাস সংরক্ষণ করতে পারেন। বিদেশী পর্যটকরা রেপ্লিকা কিনে দেশে দেশে বাঙালীর ইতিহাস ছড়িয়ে দিতে পারেন। গিফট বা উপহার সামগ্রীতে প্রেস্টিজিয়াস হতে পারে রেপ্লিকা। প্রশিক্ষকগণ জানালেন মৃৎশিল্পের এই রেপ্লিকা দূর দূরান্তে স্থলপথ রেলপথ নৌপথ বিমানপথে বহনের সুবিধার জন্য ভাল শোলা, পিস বোর্ড হার্ড বোর্ড দিয়ে প্যাকিংয়ের ব্যবস্থা করা হবে। বগুড়া শহর থেকে প্রায় ১১ কিলোমিটার দূরে শেখেরকোলা গ্রামের পালপাড়ায় রেপ্লিকা বানানোর প্রশিক্ষণ দেয়া শুরু হয়েছে। প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন মদন পাল, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতœতত্ত্ব বিভাগের প্রভাষক সোহরাব উদ্দিন সৌরভ। বাগেরহাটের শিবা রানী পাল, শংকর কুমার পাল, দিনাজপুরের রঞ্জন কুমার রায় উৎসব চন্দ্র রায়, পাহারপুরের মিন্টু কুমার মালাকার রিন্টু কুমার মালাকার ও মহাস্থানের সুভাষ চন্দ্র পাল ও মিলন রানী প্রশিক্ষণ পেয়ে তারাই রেপ্লিকা বানাচ্ছে। নদী খাল বিল জলাশয়ের তলদেশের বিশেষ ধরনের চিটকা মাটি দিয়ে রেপ্লিকা তৈরির আগে ডাইস বানাতে হয়। এই কাজের ধারাবাহিকতা এ রকম- প্রথমে টেরাকোটার একটি রঙিন ছবি তুলে তা কম্পিউটারে স্ক্যান করে নেয়া হয়। এইসব ছবি অন্তত দশটি এ্যাঙ্গেলে তুলে মৃৎশিল্পীদের দেখানো হয়। এরপর তারা মাটিতে ডিজাইন (নক্সা) করে। ডিজাইনটি হওয়ার পর কাজের খুঁটিনাটি বুঝে কোন গরমিল দেখা দিলে শিল্পীদের প্রতœ নিদর্শন সাইটে নিয়ে গিয়ে ভালভাবে দেখানো হয়। ভুলত্রুটি শুধরে নিয়ে প্লাস্টার অব প্যারিসে ডাইস বানানো হয়। এই ডাইসেই (ছাঁচ) আঠালো মাটি ভরে চারদিকে সাইজ করে প্রথমে রোদে শুকানোর পর চুল্লিতে পোড়ানো হয়। আপাতত এইসব চুল্লি ট্রাডিশনাল। তুষ ও কাঠের আগুনে রেপ্লিকা পোড়ানো হয়। একবার ৩শ’ থেকে ৪শ’ রেপ্লিকা চুিল্লতে তুলে দিলে পুড়তে সময় নেয় অন্তত ১৮ ঘণ্টা। তারপর বিপণন প্রক্রিয়া। প্রতিটি ধাপ অতিক্রম করতে শিল্পের ভাবনা নিয়ে এগোতে হয়। অধ্যাপক সুফি মোস্তাফিজুর রহমান বললেন, ডাইস বানাতে আপাতত ব্যবহার করা হচ্ছে প্লাস্টার অব প্যারিস (হাঁড় ভেঙ্গে গেলে যা দিয়ে প্লাস্টার করা হয়)। এর চেয়ে ভাল প্লাস্টিসিন নামে এক ধরনের ক্লে ইউরোপে থেকে আনা হচ্ছে। এই কাজে সহযোগিতা দিচ্ছে বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশন (বিপিসি), প্রতœতত্ত্ব অধিদফতর ও এশিয়ান ডেভলপমেন্ট ব্যাংক। সাউথ এশিয়া ট্যুরিজম ইনফ্রাস্ট্রাকচারাল ডেভলপমেন্ট প্রকল্পের আওতায় ফস্টারিং কমিউনিটি পার্টিসিপেশন এ্যান্ড হেরিটেজ ট্যুরিজম লাইভহুড ইন বাংলাদেশ শীর্ষক বৈঠকে বিশিষ্টজনরা বলেন, মৃৎশিল্পী ও গবেষণার সমন্বয়ে বাঙালী সংস্কৃতির গভীরতম জায়গা যে ভাবে উঠে আসছে তা বাঙালী জাতির মর্যাদা বহন করবে রেপ্লিকা দিয়ে। প্রভাষক সোহরাব উদ্দিন সৌরভ বললেন, এই রেপ্লিকা লেখকদের সৃষ্টিশীল কাজের ধারা তৈরি করে দেবে। বগুড়ার পালপাড়ার তুমোর শুভাষ পাল বললেন, দইয়ের খুঁটি ও সরা বানানোর চেয়ে রেপ্লিকা বানানো কঠিন। তবে তা বিক্রি করে যে অর্থ আসবে তা লাভজনক। একই সঙ্গে দেশের সংস্কৃতির জন্য কিছু তৈরি করতে পেরে ধন্য মনে করছেন। বিপিসির এক কর্মকর্তা বললেন, পর্যটক আকর্ষণ করার সকল কর্মসূচীর সঙ্গে রেপ্লিকা বড় ধরনের ভূমিকা রাখবে। রেপ্লিকার বাজার তৈরি করা হবে। যে কুমোররা এক সময় মাটির হাঁড়ি পাতিল ও খেলনা পুতুল বানাত, বগুড়ার যে মৃৎশিল্পীরা বগুড়ার ঐতিহ্যের দইয়ের সরা খুঁটি বানিয়ে দিনগুজরান করত তাদের হাতেই তৈরি হচ্ছে বাঙালীর আড়াই হাজার বছরের ইতিহাসের রেপ্লিকা, যা বিশ্বের দেশে দেশে পৌঁছে যাওয়ার পালা শুরু হয়েছে।
×