ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

সপ্তাহজুড়ে উত্তেজনা

প্রকাশিত: ০৫:৪৪, ১ নভেম্বর ২০১৪

সপ্তাহজুড়ে উত্তেজনা

বিকাশ দত্ত ॥ আগামী সপ্তাহ হবে ঘটনাবহুল সপ্তাহ। মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে আগামীকাল রবিবার আলবদর কমান্ডার মীর কাশেম আলীর রায় ঘোষণার পর পরই রায় হতে পারে আপীল বিভাগে। এখানে প্রথমেই রয়েছে সিএভি থাকা জামায়াত নেতা মোহাম্মদ কামারুজ্জামানের মামলাটি। তাই আপীল বিভাগের তার রায়টি হবার সম্ভাবনা বেশি। কারণ, আপীল বিভাগে অন্য দুটি মামলা আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ ও সালাউদ্দিন কাদের (সাকা) চৌধুরীর এখনও শুনানির দিন নির্ধারণ করা হয়নি। সাধারণত আপীল বিভাগে যদি ট্রাইব্যুনালের দেয়া দ- বহাল রেখেই রায় দেন, তারপরেই দ্রুত তা বাস্তবায়িত হয়ে থাকে। এর আগে দেখা গেছে, কাদের মোল্লার রায় যেদিন ঘোষণা করা হয় ওই রাতেই তার রায় বাস্তবায়িত হয়। সে হিসেবে কামারুজ্জামানের ক্ষেত্রে ট্রাইব্যুনালের রায় বহাল থাকলে এ সপ্তাহেই সেটা বাস্তবায়িত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। কারণ আপীল বিভাগে এ রায় ঘোষণার পর রিভিউর কোন সুযোগ নেই। এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেছেন, ট্রাইব্যুনালের দ- আপীল বিভাগ রাখলে তার ওপর রিভিউ চলবে না। যারা বিচারের মুখোমুখি এখন তাদের ট্রাইব্যুনালের রায় এবং আপীল বিভাগের রায় বিশেষ আইনী ব্যবস্থায়ই চলছে। এই ক্ষেত্রে অপরাপর আইনের মতো রিভিউ করা অথবা অনুকম্পায় যাওয়ার কোন আইনগত সুযোগ নেই। এদিকে নিজামীর মৃতুদ-ের রায় ঘোষণার পর জামায়াত বৃহস্পতি, রবি ও সোমবারের ৭২ ঘণ্টা হরতালের ডাক দিয়েছে। ইতোমধ্যে বৃহস্পতিবার পার হয়েছে। মীর কাশেম ও আপীল বিভাগের রায়কে ঘিরে তাদের বুধ ও বৃহস্পতিবার হরতালের কর্মসূচী দেয়ার চিন্তাভাবনা আছে বলে জানা গেছে। হরতালের মধ্যে রেললাইনে আক্রমণসহ বড় ধরনের নাশকতার চেষ্টা চালাবে শিবির। প্রতিশোধ নেয়ার অঙ্গীকার করে দেশজুড়ে শিবির ক্যাডারদের প্রস্তুত হতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। অন্যদিকে জামায়াত-শিবির দেশের কোথাও কোন ধরনের নাশকতামূলক কর্মকা- চালাতে না পারে সেজন্য সারাদেশেই আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের জনগণকে সঙ্গে নিয়ে রাজপথে সতর্কাবস্থায় থাকার নির্দেশ দেয়া হয়েছে দলটির হাইকমান্ড থেকে। এরই মধ্যে অরাজকতা সৃষ্টির জন্য জামায়াতের ৪/৫ শ’ কর্মীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। গ্রেফতার অব্যাহত থাকলে তারা গ্রেফতার এড়াতে প্রতিবেশী দেশ ভারতের পশ্চিম বাংলায় আশ্রয় নিতে পারে। একই সঙ্গে ভারতে থাকা জঙ্গীদের এই সুযোগে এ দেশে প্রবেশ করার সম্ভাবনা রয়েছে। জামায়াতের হরতালের সময় আওয়ামী লীগ মাঠে থাকবে। বিএনপি মৌন সমর্থন দিলেও প্রকাশ্যে থাকছে না। শেষের দিকে তারা কী করবে এখনও অস্পষ্ট। এদিকে জঙ্গীদের হুমকির কারণে প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তা আরও জোরদার করা হচ্ছে বলে জানা গেছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এ খবর জানা গেছে। অন্যদিকে স্বরাষ্ট্রপ্রতিন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, যারা মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার রায় নিয়ে অরাজকতা সৃষ্টি করবে তাদের কঠোর হস্তে দমন করা হবে। পাশাপািশ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হত্যার হুমকির জন্য তাঁর নিরাপত্তা ব্যবস্থা আরও জোরদার করা হচ্ছে। মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে আলবদর বাহিনীর প্রধান মতিউর রহমান নিজামীকে ট্রাইব্যুাল মৃত্যুদ- প্রদান করার পর জামায়াতে ইসলামী ৭২ ঘণ্টার হরতালের ডাক দেয়। ইতোমধ্যে রবিবার জামায়াত নেতা মীর কাশেম আলীর বিরুদ্ধে রায় ঘোষণার জন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ দিন ধার্য করেছে। পাশাপাশি এই রায়ের পর আপীল বিভাগ থেকে আরও একটি রায় আসার সম্ভাবনা রয়েছে। সেদিক থেকে জামায়াত আরও দুদিন হরতালের চিন্তাভাবনা করছে বলে বিভিন্ন পত্রপত্রিকার খবরে জানা গেছে। মঙ্গলবার পবিত্র আশুরার ছুটি। যদি বুধ ও বৃহস্পতিবার হরতাল দেয়, তাহলে সপ্তাহজুড়ে দেশে থাকবে অস্থিরতা। আর এই হরতালকে কেন্দ্র করে নানা ধরনের অরাজকতা সৃষ্টির পাঁয়তারা রয়েছে। জামায়াতের হরতালে বিএনপির মৌন সমর্থন রয়েছে। যেহেতু জামায়াত ২০ দলীয় জোটের অন্যতম শরিক দল সে কারণে জামায়াতকে খুশি করতে তারা মৌন সমর্থন দেবে। তবে প্রকাশ্যে রাস্তায় নামবে না। জামায়াত চেষ্টা করে যাবে তাদের নামাতে। হরতাল ও এত রায়, রায় কার্যকর আর এর বিরুদ্ধে জামায়াতের সন্ত্রাসÑ এ প্রসঙ্গে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল জনকণ্ঠকে বলেছেন, আমাদের ব্যাপক প্রস্তুতি আছে। জামায়াত যদি হরতালের নামে অরাজকতা সৃষ্টি করে তাহলে তাদের কঠোর থেকে কঠোরভাবে প্রতিহত করা হবে। আমরা তাদের মাঠে নামতে দিচ্ছি না। আগামীতেও নামতে দেব না। কোনভাবেই ছাড় দেয়া হবে না। আমাদের বিজিবি, র‌্যাব, পুলিশ আছে। পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে যাতে তারা সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে চলে যেতে পারে, আবার এই সুযোগে ভারতে অবস্থানরত জঙ্গীরা এখানে এসে হামলা করে তাহলে সীমান্ত সিল করে দেয়া হবে কি নাÑ এর উত্তরে স্বরাষ্ট্রপ্রতিমন্ত্রী আরও বলেন, বর্ডার সিল করাই আছে। তবে এত বড় বর্ডারের কোন ফাঁক দিয়ে যাতে আসতে না পারে সে জন্য আমাদের প্রস্তুতি আছে। গোয়েন্দারা সজাগ আছে। তিনি আরও বলেন, জঙ্গীদের ধরতে টাস্কফোর্স গঠন করাটা আন্তর্জাতিক প্রক্রিয়া। দু’ দেশের স্বার্থের জন্য গোয়েন্দারা কাজ করে যাচ্ছে। পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার হুমকি দেয়ার বিষয়ে সরকার যথেষ্ট সজাগ আছে। প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তা বিষয়টি আরও জোরদার করা হচ্ছে। গোয়েন্দারা নজরদারি রাখছে। নিরাপত্তার বিষয়ে আমাদের খেয়াল আছে। আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল-আলম হানিফ একটি অনুষ্ঠানে বলেছেন, জামায়াতকে রাজনৈতিক দল হিসেবে বিবেচনা করার কোন যৌক্তিকতা নেই। জামায়াত ইতোমধ্যে নিজেদের জঙ্গী সংগঠন হিসেবে পরিচিত করেছে। এই সন্ত্রাসী বা জঙ্গী সংগঠনকে নিষিদ্ধ করার দাবি এখন সাধারণ মানুষের। বর্তমান সরকার দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য দেশের আইন শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য যতটুকু যা করা দরকার তা করে যাচ্ছে। আইনজীবী ও সুশীল সমাজের নেতৃবৃন্দ বলেছেন, মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচারের সময় ডিফেন্স পক্ষের আইনজীবী থাকেন তারপরেও তারা হরতাল ডাকে। এই হরতাল ডাকাটাও আদালত অবমাননার শামিল। পশ্চিমবঙ্গে যে সমস্ত জঙ্গী অবস্থান করে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে হামলার পরিকল্পনা করছে তাদের বিরুদ্ধে টাস্কফোর্স গঠন করে যৌথভাবে অভিযান চালানো দরকার। জঙ্গীদের হামলার হুমকি প্রসঙ্গে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি শাহরিয়ার কবির জনকণ্ঠকে বলেছেন, এটা পরিষ্কার জামায়াত পশ্চিমবঙ্গের তৃণমূল কংগ্রেসকে ব্যবহার করে সেখানে ঘাঁটি গেড়েছে। তাদের টার্গেট প্রধানমন্ত্রী। জামায়াতের টার্গেট দিল্লী নয়। যেহেতু তারা উত্তর-পূর্ব ভারতের সন্ত্রাসী দলগুলোর সঙ্গে যুক্ত। বাংলাদেশের নিরাপত্তা বিচ্ছিন্ন নয়। জঙ্গী মৌলবাদী সন্ত্রাসীর ক্ষেত্রে ভারত এবং বাংলাদেশকে একযোগে কাজ করতে হবে। প্রয়োজন হলে টাস্কফোর্স গঠন করতে হবে। তাদের দক্ষিণ এশিয়া থেকে নির্মূল করতে হবে। আমরা চাই অবিলম্বে বিজিবি ও বিএসএফ সীমান্ত সিল করে দেয়া দরকার। বৈঠক করে দুদেশের গোয়েন্দা সংস্থার তথ্য বিনিময় এবং সম্মিলিত অভিযান চালানো প্রয়োজন। আঞ্চলিক টাস্কফোর্সে প্রতিবেশী দেশ ভুটান, মালদ্বীপ, শ্রীলঙ্কা, বার্মাকে যুক্ত করা। অন্যদিকে মানবতাবিরোধী অপরাধের দ-প্রাপ্তদের চূড়ান্ত বিচারিক থেকে দ- কার্যকর করার বিষয়ে প্রসিকিউটর সৈয়দ হায়দার আলী বলেছেন, একটি পয়েন্টে রিভিউ হয় না। কাদের মোল্লার বিষয়ে রিভিউ গ্রান্ড হয়নি। প্রত্যেক কেসে আলাদা আলাদা ম্যারিট থাকে। আপীল বিভাগ যদি কোন আসামিকে সর্বোচ্চ দ- বহাল রাখে তাহলে দ- কার্যকর করতে সময় লাগবে না। জামায়াতের প্রস্ততি ॥ একাত্তরের ঘাতক নিজামীর পর আগামীকাল আরেক জামায়াত নেতা আলবদর মীর কাশেম আলীর রায়। একদিন পর সোমবারই হতে পারে আপীল বিভাগে আরেকটি রায়। আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালের রায়কে কেন্দ্র করে দেশজুড়ে জামায়াত-শিবিরের তা-ব দমাতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রস্তুতি যেমন আছে তেমনি টানা হরতাল দিয়ে নাশকতার ছক কষছে জামায়াতীরাও। জানা গেছে, নিজামীর ফাঁসির রায়ের প্রতিবাদে সোমবার তিনদিনের হরতাল শেষ হতেই বুধ ও বৃহস্পতিবার দেয়া হবে আবার হরতাল। হরতালের মধ্যে রেললাইনে আক্রমণসহ বড় ধরনের নাশবকতার চেষ্টা চালাবে শিবির। প্রতিশোধ নেয়ার অঙ্গীকার করে দেশজুড়ে শিবির ক্যাডারদের প্রস্তুত হতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। দলের নীতিনির্ধারকরা এ বিষয়ে ইতোমধ্যেই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আগামী মঙ্গলবার পবিত্র আশুরার সরকারী ছুটি। জামায়াতের কারণে সপ্তাহের অবশিষ্ট চারটি কর্মদিবসই পড়তে যাচ্ছে হরতালের খপ্পরে। রবিবার কাশেম আলীকে দোষী সাব্যস্ত করা হলে সঙ্গে সঙ্গেই বুধ ও বৃহস্পতিবার হরতাল কর্মসূচী দেবে জামায়াত। সোমবার কামারুজ্জামানের রায় দেয়া হলে পরিস্থিতি অনুযায়ী দেয়া হবে কর্মসূচী। জামায়াত নেতা হলেও কাশেম আলী ও কামারুজ্জামান দুজনই শিবিরের সাবেক সভাপতি হওয়ায় বড় ধরনের তা-ব চালানোর পরিকল্পনা করছে শিবির। দক্ষিণাঞ্চলের একটি উপজেলার ভাইস-চেয়ারম্যান ও ঢাকা মহানগর জামায়াতের এক কর্মপরিষদ সদস্য রীতিমতো সরকারকে হুমকি দিয়েই বললেন, মীর কাশেমের সাজা হলে বুধ ও বৃহস্পতিবারও হরতাল থাকবে। সারা দেশের শিবিরকর্মীদের নিয়ে তারা বড় ধরনের সন্ত্রাস ও নাশকতার প্রস্তুতি নিচ্ছে। সর্বোচ্চ সতর্কাবস্থায় আওয়ামী লীগ ॥ যেকোন ধরনের নাশকতা ও সংঘাত মোকাবেলায় সর্বোচ্চ সতর্কাবস্থায় আওয়ামী লীগ বলে জানিয়েছেন তাঁদের নেতারা। আগামী এক সপ্তাহে মীর কাশেম আলীর রায়ের পর আপীল বিভাগে আরেকটি রায় হবার সম্ভাবনা রয়েছে। যুদ্ধাপরাধীর রায় ঘোষণাকে কেন্দ্র করে আদালত কর্তৃক সন্ত্রাসী দল হিসেবে ঘোষিত জামায়াত-শিবির দেশের কোথাও কোন ধরনের নাশকতামূলক কর্মকা- যাতে চালাতে না পারে সেজন্য সারাদেশেই আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের জনগণকে সঙ্গে নিয়ে রাজপথে সতর্কাবস্থায় থাকার নির্দেশ দেয়া হয়েছে দলটির হাইকমান্ড থেকে। দলটির একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শীর্ষ যুদ্ধাপরাধী মীর কাশেম আলীর রায় রবিবার ঘোষণা করা হবে। এর পর আপীল বিভাগের এম কামারুজ্জামানের রায় হবার সম্ভাবনা রয়েছে। রায় ঘোষণার পর জামায়াত-শিবির ও কিছু উগ্র সাম্প্রদায়িক সংগঠন দেশের বিভিন্নস্থানে নাশকতা চালাতে পারে। এমন আশঙ্কা থেকেই যেকোন ধরনের বিশৃঙ্খলা রাজনৈতিকভাবে মোকাবেলার প্রস্তুতি নিয়েছে আওয়ামী লীগ। প্রস্তুতির অংশ হিসেবে আগামী রবিবার থেকেই রাজধানীর প্রতিটি থানা ও ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগ ও তার সকল সহযোগী সংগঠন জনগণকে সঙ্গে নিয়ে সতর্ক প্রহরায় থাকবে। জানা গেছে, জামায়াত-শিবিরের যেকোন ধরনের অশুভ তৎপরতা বা নাশকতার চেষ্টা শক্তহাতে প্রশাসনিক ও রাজনৈতিকভাবে মোকাবেলায় সর্বাত্মক প্রস্তুতি চলছে সরকার ও আওয়ামী লীগে বলে তারা জানিয়েছে।
×