ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

বিশ্বব্যাংকে বিদ্রোহ

প্রকাশিত: ০৫:০৭, ২৯ অক্টোবর ২০১৪

বিশ্বব্যাংকে বিদ্রোহ

মূল : পিটার রোনাল্ড ডিসুজা অনুবাদ : এনামুল হক (শেষাংশ) তা সে চাকরি সরকারী হোক কী সরকারী কোন প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজনীয় সহায়ক সার্ভিসের হোক। যেমন ধরুন অধস্তন প্রশাসনিক স্টাফ। এতে এক আন্ডারক্লাস কর্মী বাহিনীর সৃষ্টি হয়। এই কর্মীদের এখনও প্রয়োজন থাকলেও স্থায়ী স্টাফরা যেসব কল্যাণমূলক ও নিরাপত্তা সুবিধা ভোগ করে থাকে সেগুলো থেকে তারা বঞ্চিত হয়ে পড়েছে। কাজেই নিরাপত্তা রক্ষী, ড্রাইভার, মেস শ্রমিক, সুইপার, চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের এখন এমন জীবনযাপন করতে হচ্ছে যা রোগব্যাধি, বেকারত্ব ইত্যাদি সংক্রান্ত উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় পূর্ণ। কারণ তারা শ্রমিক ঠিকাদারদের পক্ষে কাজ করছে যারা তাদের এ ধরনের কোন সুবিধা প্রদান করে না। কাজেই এ অবস্থায় সংস্থাকে ঢেলে সাজানোর কারণে ব্রেকফাস্টের খরচ নিজেদের পকেট থেকে মেটাতে হবে বলে বিশ্বব্যাংকের পেশাজীবী ব্যক্তিদের যখন রাগ করার কথা শোনা যায় তখন তা বুঝতে একটু অসুবিধা হয় বৈকি। দক্ষিণের বিশ্বের দেশগুলোর অর্থনীতিকে ঢেলে সাজানোর ফলে এমন এক আন্ডারক্লাস কর্মী বাহিনী গড়ে উঠেছে যাদের জীবিকার নিরাপত্তাহীনতা বহুগুণে বেড়ে গেছে। সেদিক বিচারে বিশ্বব্যাংকের বিদ্রোহের ব্যাপারটি কতকাংশে আপাত বিরোধী বলে মনে হয়। এ কার্যক্রমটি ব্যক্তিগতভাবে অসৎই শুধু নয়, ২০১৫ সালের বিশ্ব উন্নয়ন রিপোর্টের বক্তব্য বিষয় পাঠ করে দেখলে সেটিকে বুদ্ধিবৃত্তিগতভাবেও অসৎ বলা চলে। এটা কি তাহলে মিউটিনি অন দ্য বাউন্টির আধুনিক পরিবেশনা? মুষ্টিমেয়র নিয়ন্ত্রণ দ্বিতীয় দিকটি হলো অভ্যন্তরীণ পুনর্বিন্যাসের ক্ষেত্রে গৃহীত প্রক্রিয়া রয়টার ও ফিন্যান্সিয়াল টাইমসের খবর থেকে আমরা জানতে পারি যে, স্টাফদের অভিন্ন একটি অভিযোগ হলো এই যে ব্যাংকের প্রেসিডেন্টের সূচিত ঢেলে সাজানো কার্যক্রমের অনেক দিকই অস্বচ্ছ। এই প্রক্রিয়ার একটা ঘোলাটে দিক আছে। দৃষ্টান্তস্বরূপ, এমন সব প্রশ্ন উত্থাপন করা প্রয়োজন ছিল। সিএফওকে তাঁর বিরল দক্ষতার পুরস্কার হিসেবে বেতনের অতিরিক্ত ৯৪ হাজার ডলার প্রদানের ক্ষেত্রে কোন পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়েছিল? তাঁর সেই কাজটা কি সিএফওর স্বাভাবিক কর্তব্য ও দায়িত্বের বাইরে করা হয়েছিল? প্রেসিডেন্ট কিভাবে ঠিক করেছিলেন বিরল দক্ষতার পুরস্কার লাভের যোগ্যতা কার আছে এবং কতজন এই বোনাস পাওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেছিলেন? স্টাফদের সঙ্গে এই বোনাস পাওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেছিলেন? স্টাফদের সঙ্গে প্রেসিডেন্টের বৈঠকে এই প্রশ্নগুলো তোলা হয়েছিল। ব্যবস্থাপনার সুষ্ঠু নীতিমালার ভিত্তিতেই যদি বিরল দক্ষতার পুরস্কার দেয়া হয়ে থাকে তাহলে এ নিয়ে হৈ চৈ হওয়ার পর কেন সিএফও বোনাসটা ত্যাগ করতে রাজি হয়েছিলেন। এসব হচ্ছে সঙ্গত প্রশ্ন এবং এ থেকে যে কারও মনে এমন প্রশ্নের উদয় হতে পারে যে, রাষ্ট্রসমূহেরও যদি প্রতিবাদ জানানোর একই পথ থাকত! গ্রীস, পর্তুগাল, আয়ারল্যান্ড ও আর্জেন্টিনার কি প্রতিবাদ জানানোর পথ ছিল? এই ঘটনার চিত্তাকর্ষক শিক্ষাটি হলো ঢেলে সাজানোর প্রক্রিয়ায় অনেকের দুঃখ-বেদনা-যন্ত্রণা ও দুর্ভোগের কারণ ঘটলেও মুষ্টিমেয় কিছু লোক বিশেষ করে এই প্রক্রিয়া বাস্তবায়নের দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিরাই লাভবান হয়। এই মুষ্টিমেয়র রাজনৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক ক্ষমতার অধিকারী হওয়ার সুযোগ আছে। এরা জনগণের কাছে যৌক্তিকতা প্রমাণের জন্য অনুসৃত পদ্ধতি নিয়ন্ত্রণ করে বলে এমন আলোচনার জন্ম হয় যে ঢেলে সাজানোর কার্যক্রমের প্রয়োজনীয়তা এসেছে এবং তাতে সবাই লাভবান হবে। দরিদ্র বিশ্বের বহু দেশে অর্থনীতিকে ঢেলে সাজাতে গিয়ে মুষ্টিমেয় কিছু লোক পুরস্কৃত হয় এবং অনেককে তার মাসুল দিতে হয়। নব্য উদারপন্থীদের বিজয় তৃতীয় বিষয়টি হলো পরামর্শক নিয়োগ। বিদ্রোহের ঘটনাটির এটাই সবচেয়ে নৈরাশ্যজনক ও আশঙ্কাজনক দিক। বিশ্বব্যাংকের মতো একটা প্রতিষ্ঠান যার মূল বৈশিষ্ট্য হলো উন্নয়ন কিভাবে সাধন করতে হয় সে সম্পর্কিত জ্ঞানের এটা একটা আধার। সেই বিশ্বব্যাংককে আজ পরোক্ষভাবে ঘোষণা করতে হচ্ছে যে নিজেকে ঢেলে সাজানোর জন্য প্রয়োজনীয় জ্ঞান এই সংস্থার নেই। এটা নিজের জ্ঞান ও দক্ষতার ভিত্তির দুর্বলতা সম্পর্কে গুরুতর ধরনের স্বীকারোক্তি। একটা দেশের অর্থনীতিকে ঢেলে সাজানোর চেয়ে একটা প্রতিষ্ঠানকে ঢেলে সাজানো যেখানে অনেক বেশি সহজ সেখানে বিশ্বব্যাংক কোন দেশের অর্থনীতিকে ঢেলে সাজানোর রোডম্যাপ কিভাবে তৈরি করে? একটা প্রতিষ্ঠানকে অধিকতর উন্নত, দক্ষ ও ন্যায়ভিত্তিক করার লক্ষ্যে ২০১৫ সালের বিশ্ব উন্নয়ন রিপোর্টে বর্ণিত বিভিন্নমুখী জ্ঞানের ভিত্তিতে সেই প্রতিষ্ঠানকে ঢেলে সাজানো যেতে পারে যেমন সর্বোত্তম কর্মানুশীলন, ক্রমান্বয়ে গৃহীত পদক্ষেপ, তথ্য-প্রমাণনির্ভর কর্মনীতি, ফলাফলভিত্তিক ব্যবস্থাপনা, পরিমাপন ও পরিবীক্ষণ ইত্যাদি। এসবই হলো বিশ্বব্যাংকের ব্যবহৃত শব্দমালা। কিন্তু বাইরের পরামর্শক নিয়োগ ও তাদের সোয়া কোটি ডলার ফি প্রদানের সিদ্ধান্ত থেকে দেখা যায় যে, বিশ্বব্যাংক হয় নিজের ক্ষমতা ও সামর্থ্যরে ওপর বিশ্বাস রাখে না নয়ত সেই ক্ষমতা ও সামর্থ্য তার নেই যা কিনা আরও খারাপ। আশঙ্কাজনক ব্যাপার হলো এর মধ্য দিয়ে যে বার্তা পৌঁছে দেয়া হচ্ছে তা হলো এখন থেকে উন্নয়ন সম্পর্কিত চিন্তাভাবনার কাজটা বৃহৎ আন্তর্জাতিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠানগুলোই করবে এবং তারাই প্রচার প্রচারণা চালাবে। বিশ্বব্যাংক কী ঘোষণা করছে যে এখন থেকে তার উন্নয়নবিষয়ক জ্ঞানও আউটসোর্সিং করা হবে? ইকোনমিক টাইমসের খবরে বলা হয়, প্রতিবাদকারীদের একজন বলেছেন, ‘আমরা উন্নয়নবিষয়ক এবং এ সংক্রান্ত যেসব জটিলতা নিয়ে কাজ-কারবার করি ওরা তার কী জানে?’ বস্তুতই তারা কী জানে? কিন্তু আমরা যদি বিভিন্ন দেশের অর্থনৈতিক নীতিবিষয়ক প্রতিষ্ঠানগুলোর দিকে দৃষ্টি দেই তাহলে দেখতে পাব যে, সেই দেশগুলোর কেন্দ্রীয় ব্যাংক এবং আন্তর্জাতিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে লোকজনের নিরন্তর আসা-যাওয়া চলছে। আমাদের নিজস্ব উন্নয়ন সম্পর্কিত চিন্তা-ভাবনা আন্তর্জাতিক পরামর্শ সংস্থার মতো নব্য উদারপন্থী জ্ঞানের ধারক প্রতিষ্ঠান, রেটিং এজেন্সি ও বিনিয়োগ ব্যাংকগুলোর কাছ থেকে আউটসোর্সিং করা হয়েছে। আমরা এমনকি ভারতেও অর্থনৈতিক নীতির ক্ষেত্রে জ্ঞান উৎপাদনের এই দখলদারী এবং নব্য উদারপন্থী কাঠামোর বিজয় দেখতে পাই। আমাদের অর্থনৈতিক নীতি-নির্ধারণের প্রধান প্রধান কুশীলবকে দেখুন। বিশ্বব্যাংক এখন এই ধারাটিকে অনুমোদন দিয়েছে। ভারতীয় মনন ও নীতির পুনঃউপনিবেশিকরণ প্রায় সম্পন্ন হওয়ার পথে। এই গোলমেলে আখ্যানের চতুর্থ বিষয়টি হলো কার্যক্রমকে বৈধতা দেয়ার জন্য শব্দমালার ব্যবহার। ভারতে প্রকাশ্য বিতর্কের শেষ কয়েক মাসে আমরা শব্দের শক্তি ও ক্ষমতা এবং এই শব্দমালার ব্যবহারকারীরা যে সামাজিক শক্তি করায়ত্ত করে তা লক্ষ্য করেছি। এই জগত শব্দ বা কথার তৈরি। রবিঠাকুর তাঁর এই দার্শনিক উক্তির পক্ষে যুক্তি দিতে গিয়ে বলেছেন, ভাষা বাস্তবতা নির্মাণ করে, আমরা আমাদের ভাষার মধ্য দিয়ে বিশ্বজগতের সৌন্দর্য দেখতে পাই এবং ভাষার বাইরে সৌন্দর্যের কোন অস্তিত্ব নেই। সেই ভাষা বা শব্দকে নিয়ন্ত্রণ করে বিশ্বব্যাংক তাঁর সিএফও’কে বিশাল অঙ্কের বোনাস দিয়ে পুরস্কৃত করার এবং অন্যদিকে অন্যান্য কর্মচারীর আর্থিক সুবিধা খর্ব করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বিশ্বব্যাংক তার এই সিদ্ধান্তের যৌক্তিকতা দেখাতে গিয়ে ‘বিরল দক্ষতার পুরস্কার’ শব্দাবলী ব্যবহার করেছে। সিএফও এই বাড়তি অর্থ পাচ্ছে এই কারণে যে তাঁর বিরল দক্ষতা রয়েছে। বিনিয়োগ ব্যাংকের সৌভ্রাতৃত্বকে বিপুল অঙ্কের বোনাস দিয়ে পুরস্কৃত করতে হবে কারণ তাদের রয়েছে বিরল দক্ষতা। ওয়াল স্ট্রিট এই যৌক্তিকতার ওপর নির্মিত। ধ্যানধারণাকে নিয়ন্ত্রণ করা এবং শব্দমালা নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে জনগণের আলাপ-আলোচনাকে নিয়ন্ত্রণ করার এটাই হলো পুঁজিবাদের সবচেয়ে মোক্ষম কৌশল। আমরা পার্থক্যগুলোকে মেনে নেই কারণ আমাদের বিশ্বাস করানো হয় যে, এটা এক ‘বিরল দক্ষতার পুরস্কার’ যা আমাদের নিজেদের ভালর জন্যই দিতে হবে। কখনও কখনও শব্দের মুদ্রণ প্রমাদ থেকে সত্য অনেক ভালভাবে বেরিয়ে আসে। প্রমাদবশত আমি কথাগুলোকে টাইপ করেছিলাম ‘ভীতিকর দক্ষতার পুরস্কার।’ ব্যাপারটা এমনই।
×