ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

সম্ভব হবে কি ১৯ লাখ অবৈধ পরিবহনের বিরুদ্ধে অভিযান

প্রকাশিত: ০৪:৩৫, ২৯ অক্টোবর ২০১৪

সম্ভব হবে কি ১৯ লাখ অবৈধ পরিবহনের বিরুদ্ধে অভিযান

রাজন ভট্টাচার্য ॥ দেশে মোট পরিবহনের সংখ্যা প্রায় ৪০ লাখের বেশি! সরকারী তালিকাভুক্ত পরিবহনের সংখ্যা ২১ লাখের কিছু বেশি। ১৯ লাখ পরিবহনই অবৈধ। এরমধ্যে ফিটনেস ছাড়াই চলছে প্রায় তিন লক্ষাধিক পরিবহন। লাইসেন্সপ্রাপ্ত চালকের সংখ্যা ১৩ লাখ। সাত লাখ অবৈধ চালক রেজিস্ট্রেশনভুক্ত পরিবহন চালাচ্ছেন। সব মিলিয়ে দেশে অবৈধ চালকের সংখ্যা ৩৩ লাখেরও বেশি। তারাই দাবড়ে বেড়াচ্ছেন সড়ক-মহাসড়ক। অর্থাৎ অবৈধ চালক আর পরিবহনের দখলে দেশের ৩৬১টি রুট। কোন বাধা ছাড়াই চলছে চালক ও পরিবহনগুলো। অথচ অবৈধ এ পরিবহন চালক ধরতে নির্বিকার যোগাযোগ মন্ত্রণালয়। প্রয়োজনীয় লোকবল ছাড়াই খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে সরকারী পরিবহন নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ)। যদিও পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের জানিয়েছেন, ১০ নবেম্বর থেকে অবৈধ পরিবহনের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু হবে। বাস্তবতা হলো- গেল চার বছরে অবৈধ পরিবহন ধরার সবকটি অভিযানই ব্যর্থ হয়েছে। সরকারী-বেসরকারী গবেষণা বলছে, প্রতিবছর সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যাচ্ছে প্রায় ১৪ হাজার মানুষ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য মতে বাংলাদেশে প্রতিদিন সড়ক দুর্ঘটনায় ৫৫ জন নিরীহ যাত্রী প্রাণ হারাচ্ছে। বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ পরিষদের পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ১৮ লক্ষ নসিমন, করিমন, ভটভটি বিভিন্ন সড়কে চলাচল করছে। যার একটিও সরকারীভাবে অনুমোদিত নয়। ৩ লক্ষাধিক ব্যাটারিচালিত রিকশা ও ইজিবাইক মহাসড়কে চলতে দিয়ে কোন অবস্থাতেই নিরাপদ সড়ক বাস্তবায়ন সক্ষম নয়। সড়ক দুর্ঘটনা রোধে চালকদের বিরুদ্ধে কঠোর আইন প্রণয়নের দাবি ওঠেছে বিভিন্ন মহল থেকে। বলা হচ্ছে, মৃত্যুদ-, যাবজ্জীবন, অর্থ ও কারাদ-ের বিধান রাখাসহ নিহত পরিবারের ক্ষতিপূরণের বিধান লেখে মোটরযান অধ্যাদেশ আইন সংশোধন করা হোক। আমেরিকা থেকে শুরু করে বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে সড়ক দুর্ঘটনা রোধে চালকদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তির বিধান রয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দুর্ঘটনার জন্য দায়ী ৯১ ভাগ চালক। পরীক্ষা ছাড়াই লাইসেন্স পাচ্ছে ৬১ ভাগ ড্রাইভার। পরিবহন সেক্টরের অরাজগতা রোধে কার্যকর পদক্ষেপ নেই। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আমাদের দেশে প্রতি ১০ হাজার যানবাহনের মধ্যে ৮৬ দশমিক ৬টি যানবাহন প্রতি বছর মারাত্মক দুর্ঘটনায় পড়ছে। এই পরিসংখ্যানে নিহতের সংখ্যা এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশে সর্বোচ্চ ১৬৯ জন। এ দেশের ২ শতাংশ জিডিপি ক্ষতি হচ্ছে সড়ক দুর্ঘটনার কারণে। সড়ক দুর্ঘটনায় যারা মারা যাচ্ছে তার ৬০ শতাংশের বয়স ১৫ থেকে ৪৫ বছরের মধ্যে তারা পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। একটি দুর্ঘটনা এভাবে এক একটি পরিবারকে দারিদ্র্যতার কাতারে নিয়ে যাচ্ছে। বুয়েটের এক্সিডেন্ট রিসার্স ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক শামসুল হক জনকণ্ঠকে বলেন, বিআরটিএ হিসেব মতে দেশে লাইসেন্সপ্রাপ্ত চালকের সংখ্যা ১৩ লাখ। অথচ রেজিস্ট্রেশনভুক্ত গাড়ি আছে ২১ লাখের বেশি। সাত লাখের বেশি অবৈধ চালক গাড়ি চালাচ্ছেন। অথচ তাদের ঠেকাতে সরকারের তরফ থেকে কোন পদক্ষেপ নেই। তিনি বলেন, চালকের দুর্বলতার কারণে দেশে ৯১ ভাগ সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে থাকে। পরিবহন কোম্পানির পক্ষ থেকে চালকদের প্রশিক্ষণ দেয়ার দাবি জানান তিনি। পাশাপাশি সরকারী কর্মকর্তা থেকে শুরু করে উচ্চ পদস্থদের গাড়ি শহরের উল্টোপথে চলা বন্ধেরও দাবি জানান এই দুর্ঘটনা বিশেষজ্ঞ। যাত্রী সমিতির পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, দেশে সড়ক দুর্ঘটনা আজ মহামারী আকার ধারণ করেছে। তাই বিষয়টিকে জাতীয় সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করা জরুরী। এ বিষয়টিকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে প্রতিকারের জন্য প্রধানমন্ত্রীকে দায়িত্ব নেয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে সমিতির পক্ষ থেকে। সামাজিক এই সংগঠনের গবেষণায় বলা হয়েছে, সড়কে যানবাহন চলাচল নিয়ন্ত্রণে সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার অভাব, গণ-পরিবহন সংকট, মানসম্মত গণ-পরিবহনের অভাব, অনিরাপদ সড়ক, চালকদের অদক্ষতা, ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন, পথচারীদের অসতর্কতা ও আইন মেনে না চলার প্রবণতা, দুর্ঘটনার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণে দুর্বলতা প্রভৃতি সড়ক দুর্ঘটনার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কয়েকটি কারণ। বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোঃ মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, সড়ক দুর্ঘটনা কমাতে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের অধীন জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিল নামে একটি সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম থাকলেও নিয়মিত সভা হয় না। এই ফোরামের অধীনে কোন সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা সেল নেই। এই ফোরামে যাত্রীদের কোন প্রতিনিধিত্ব নেই। এই ফোরামের সড়ক দুর্ঘটনা মনিটরিং সেল সড়ক দুর্ঘটনা যে রিপোর্ট সংগ্রহ করে তাতে সড়ক দুর্ঘটনার প্রকৃত চিত্র উঠে আসছে না। তাই সড়ক দুর্ঘটনার সমস্যা সমাধানে আলোর মুখ দেখছে না। বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির প্রকাশিত এক প্রতিবেদন বলছে, চলতি বছরের শুরু থেকে শুধু জুন পর্যন্ত সড়ক দুর্ঘটনায় মৃতের সংখ্যা প্রায় চার হাজার। এর একটি বড় অংশ পথচারী। বুয়েটের সড়ক দুর্ঘটনা ইনস্টিটিউটের পরিসংখ্যান বলছে, উন্নত দেশগুলোতে প্রতি ১০ হাজার গাড়িতে সড়ক দুর্ঘটনা হচ্ছে মাত্র একটি। বাংলাদেশে ১০ হাজার গাড়িতে সড়ক দুর্ঘটনা হচ্ছে ৭০টির বেশি। বিদেশে একটি গাড়ি দিনে যতোটুকু চলে বাংলাদেশে এর অর্ধেকেরও কম চলে। যত কম চলে ততো দুর্ঘটনা কম হওয়ার কথা। কিন্তু আমাদের দেশে গাড়ি কম চললেও সড়ক দুর্ঘটনা বেশি হচ্ছে। তাছাড়া থাইল্যান্ডে এক হাজার জনে যান্ত্রিক যান ১২টি হলেও সড়ক দুর্ঘটনা কম। বাংলাদেশে এক হাজার জনে পরিবহনের সংখ্যা একটি হলেও সড়ক দুর্ঘটনা বেশি হচ্ছে। বিশ্বের সঙ্গে তুলনা করলে সড়ক দুর্ঘটনায় বাংলাদেশের অবস্থান প্রথম দিকে। বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ) সূত্রে জানা গেছে, ২০০৯ সালে রাজধানীতে মোট যানবাহনের সংখ্যা ছিল ৫ লাখ ১৬ হাজার ৯১২টি। পাঁচ বছরে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় দ্বিগুণ। চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত রাজধানীতে রেজিস্ট্রেশনভুক্ত পরিবহনের সংখ্যা আট লাখ ৩৫ হাজার ৮১২টি। এরমধ্যে বাসের সংখ্যা ২১ হাজার ৪৯৩টি। মোটরসাইকেলের সংখ্যা তিন লাখ ২৮ হাজার ৩৪২টি। প্রাইভেট প্যাসেঞ্জার কারের সংখ্যা দুই লাখেরও বেশি আছে। এদিকে চলতি বছরের ১৪ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সারাদেশে রেজিস্ট্রেশনভুক্ত মোট পরিবহনের সংখ্যা ২১ লাখ পাঁচ হাজার ১৪০টি। এরমধ্যে অটোরিকশার সংখ্যা দুই লাখ ২১ হাজার ৮৬টি। ডেলিভারি ভ্যান ২০ হাজার ৫৬২টি, জিপ প্রায় ৪০ হাজার, প্রায় ৮০ হাজার মাইক্রোবাস, মোটরসাইকেল রয়েছে ১১ লাখ ৩০ হাজারের বেশি। প্রাইভেট প্যাসেঞ্জার কারের সংখ্যা ২ লাখ ৬৪ হাজার ১৭টি। ট্রাক রয়েছে এক লাখ ৬৫ হাজারের বেশি। বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ) পক্ষ থেকে কি পরিমাণ পরিবহন অনুমোদন দেয়া হয় এর কোন পরিকল্পনা নেই। তাছাড়া আমাদের দেশের রাস্তা অনুযায়ী কি পরিমাণ পরিবহন চলতে পারবে এ সংক্রান্ত কোন জরিপ নেই সরকারী এই পরিবহন নিয়ন্ত্রণ সংস্থাটির কাছে। নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনের চেয়ারম্যান ইলিয়াস কাঞ্চন জনকণ্ঠকে বলেন, সড়ক দুর্ঘটনা রোধে চালকদের শাস্তি বাড়ানোর দাবি অনেক দিন থেকেই। কিন্তু পরিবহন মালিক ও শ্রমিকদের চাপের মুখে সরকার তা করছে না। মোটরযান অধ্যাদেশ আইন সংশোধনের জন্য তিন বছরের বেশি সময় আগে উদ্যোগ নেয়া হয়। এখনও তা প্রাথমিক পর্যায়ে আছে। চালকদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনের বিকল্প নেই বলে মনে করেন তিনি। ২১ বছর আগে সড়ক দুর্ঘটনার মারা যান ইলিয়াস কাঞ্চনের ন্ত্রী। এরপর থেকেই তিনি দুর্ঘটনা রোধে কাজ করে যাচ্ছেন। বড় পর্দার এক সময়ের জনপ্রিয় তারকা বলেন, বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে বেশি গাড়ি উৎপাদনকারী দেশ জাপানেও সড়ক দুর্ঘটনার জন্য চালক দায়ী হলে সর্বোচ্চ দ- ১৬ বছর। আমেরিকায় বিভিন্ন স্টেটে এক থেকে ৯৯ বছর পর্যন্ত কারাদ-ের বিধান করা হয়েছে। অস্ট্রেলিয়াতে ১৫ বছর কারাদ-ের বিধান আছে। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের হিসেব মতে শুধু ঢাকাতেই প্রতিদিন গড়ে একজন পথচারী মারা যান। কিন্তু এ ধরনের দুর্ঘটনায় শেষ পর্যন্ত কোন তদন্ত, বিচার বা ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা হয় না।
×