ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

যানজট বিপর্যস্ত নগরজীবন

প্রকাশিত: ০৬:১০, ২৭ অক্টোবর ২০১৪

যানজট বিপর্যস্ত নগরজীবন

এম. আমানউল্লাহ নগরবাসীর যাতায়াতের প্রধান মাধ্যম বাস। এতে চলাফেরা করে ২৮ শতাংশ। রেজিস্ট্রেশন করা বাসের সংখ্যা ৮-১০ হাজার হলেও রাস্তায় আছে অর্ধেক। দ্বিতীয় মাধ্যম রিকশা, চলাচলকারীর হার ৩৮ শতাংশ। ১ লাখ রিকশার রেজিস্ট্রেশন থাকলেও চলাচল করছে ৪ লাখের মতো। ২০ শতাংশ মানুষ হেঁটে চলাচল করে। বাকি ১৪ শতাংশ প্রাইভেটগাড়ি ও সিএনজি অটোরিকশা যাতায়াতকারী। প্রাইভেট গাড়িতে যাতায়াত করে ৭-৮ শতাংশ মানুষ। এই ৭-৮ শতাংশের যাতায়াতকারী প্রাইভেট গাড়িতেই ঢাকার ৫০-৬০ শতাংশ জায়গা দখল করে আছে। ঢাকা শহরের এই তীব্র ও অসহনীয় যানজটের কারণগুলো কমবেশি অনেকেরই জানা। আগেই বলেছি ধারণক্ষমতার চেয়ে কয়েকগুণ লোকের বসবাসই এর প্রধান কারণ। এত লোকের যাতায়াতের জন্য প্রতিদিনই রাস্তায় নামছে নতুন নতুন যানবাহন। যেখানে সড়ক বাড়ছে না, অবকাঠামোগত সুবিধা তৈরি হচ্ছে না কেবল বাড়ছে মানুষ, আর যানবাহন সেখানে যানজটসহ সকল ভোগান্তিই তীব্র থেকে তীব্রতরই হওয়ার কথা। সুষ্ঠু পরিকল্পনা ও দক্ষ ব্যবস্থাপনা থাকলে এত অধিক লোক এবং যানবাহন নিয়েও যানজট ও জনজট অনেকটা সহনীয় মাত্রায় রাখা যেত। কিন্তু তা না হয়ে প্রায় সর্বক্ষেত্রেই ঘটছে বিপরীতটি। ঢাকা শহরের এই যে বৃদ্ধি ঘটেছে এবং প্রতি মুহূর্তেই বৃদ্ধি ঘটে চলেছে তার প্রায় সবটাই বলা যায় অপরিকল্পিত। আর এই অপরিকল্পিত নগরায়নের অনিবার্য পরিণতিই যানজটসহ যাবতীয় জনদুর্ভোগ। ফুটপাত বেদখল থাকায় চলাচলের জন্য মানুষও নেমে আসছে মূল রাস্তায়। এসবের ফলে অপর্যাপ্ত সড়ক আরও অপর্যাপ্ত হয়ে পড়েছে। রাস্তাগুলোর আরেকটি সমস্যা ইউটার্ন ব্যবস্থা না থাকা। এতসব সঙ্কটকে আরও ঘনীভূত করে যানজটকে তীব্র করে তুলেছে দুর্বল ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা, জনসচেতনতার অভাব, ট্রাফিক সিগন্যাল না মানা ইত্যাদি। তীব্র এই যানজটে ক্ষতি হচ্ছে বহুমাত্রিক। ঢাকা শহরে বসবাসকারী মানুষ গড়ে ট্রাফিক সিগন্যালে আটকা থাকছে ২ ঘণ্টা ৪০ মিনিট। তার মধ্যে ১ ঘণ্টা ৪০ মিনিট অতিরিক্ত। গাড়ি চালকদের গড়ে প্রতিদিন সময় নষ্ট হচ্ছে ৩ ঘণ্টার বেশি। কর্মঘণ্টা হিসেবে প্রতিদিন অপচয় হচ্ছে ৩০ কোটি টাকা, বছরে ১০ হাজার কোটি টাকারও বেশি। যানবাহনের অতিরিক্ত জ্বালানি খরচ হচ্ছে প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকা। তাছাড়া যানজট গাড়ি ঘন ঘন চালানো বন্ধ করায় প্রচুর টাকা ব্যয় হচ্ছে গাড়ির পেছনে। যানজটে বিশাল অঙ্কের অর্থনৈতিক ক্ষতি ছাড়াও স্বাস্থ্যগত ও পরিবেশগত ক্ষতি অনেক। ট্রাফিক জ্যামের কারণে ৭৩ শতাংশ মানুষ শারীরিক ও মানসিক অসুস্থতায় ভুগছে। তীব্র ধোঁয়ায় ও ধুলাবালিতে মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে শ্বাসকষ্টে। বিরামহীন হর্ন ও শব্দে মাথাব্যথা, হার্ট ডিজিজ, জ্বর, শ্রবণ সমস্যা, ডাস্ট এলার্জিসহ আক্রান্ত হচ্ছে নানা রোগে। ঢাকার অসহনীয় যানজটের জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছে। এই তীব্র যানজট নিরসন করা হয়ত অসম্ভব কিন্তু তা কমিয়ে আনা, জনজীবনকে স্বাভাবিক করা মোটেও অসম্ভব নয়। ঢাকার যানজটের মূল কারণ অত্যধিক জনসংখ্যা, ঢাকার এই জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে যানজটসহ নগরজীবনের কোন দুর্ভোগই কমানো সম্ভব নয়, বরং দিন দিন তা বাড়তেই থাকবে। সকল কাজের জন্যই মানুষ ঢাকানির্ভর। প্রশাসনিক ও বাণিজ্যিক বিকেন্দ্রীকরণ করা হলে ঢাকার জনসংখ্যা হ্রাস পাবে বহুলাংশে। দেশের কোথাও কর্মসংস্থানের তেমন সুযোগ না থাকায় ঢাকায় কর্মমুখী মানুষের যে ঢল তা বন্ধ করতে হলে দেশের বিভিন্ন জায়গায় কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা নিতে হবে। এটি হচ্ছে মূল কাজ। এর ফল হবে দীর্ঘমেয়াদি। যানজট নিরসনে জরুরিভিত্তিতে যা করা দরকার তা হলো অপ্রয়োজনীয় অর্থাৎ লাইসেন্সবিহীন রিকশা অপসারণ। ব্যবসা-বাণিজ্য চাকরির ক্ষেত্রে চীনসহ অন্যান্য জনবহুল নগরের মতো ডাবল শিফট চালু করা। সকল ক্ষেত্রে ডাবল শিফট চালু সম্ভব না হলে জরুরিভিত্তিতে স্কুল-কলেজের সময় পরিবর্তন করা। পর্যাপ্ত স্কুল-কলেজের বাস সার্ভিস চালু করা। বড় বড় সড়কে বিভিন্ন গতি ও শ্রেণীর গাড়ির জন্য আলাদা লেন চালু করা। ঢাকা শহরে কয়েকটি আন্ডারপাস ও অনেক ফুটওভারব্রিজ নির্মিত হলেও জনগণ সেগুলো ব্যবহারে এখনও অভ্যস্ত নয়। তাদের এগুলো ব্যবহারে প্রয়োজন হলে বাধ্য করা। ঢাকার অনেক ছোট রাস্তা বেদখল হয়ে আছে সেগুলো উদ্ধার করে বড় বড় সড়কের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করা। বিশ্বের বিভিন্ন জনবহুল শহরে সাব আরবান রেল চলাচল করে। কলকাতা-মুম্বাই শহরেও সাব আরবান রেলে প্রায় ৭০ লাখ লোক শহরের বাইরে থেকে এসে কাজ করে দিন শেষে চলে যায়। ফলে সেখানকার লোক সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে না। ঢাকার জন্য এ ব্যবস্থা চালু করলে আরও বেশি সুফল পাওয়া যাবে। অন্যদিকে মেট্রোরেল ও মনোরেলের কথা নগরবাসী কেবল শুনেই যাচ্ছে। উল্লেখ্য, যানজট নিরসনের মনোরেল স্থাপনের জন্য জাইকার সঙ্গে ২.৮ বিলিয়ন ডলারের একটি ঋণচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। ২০১৬ সালে কাজ শুরু হয়ে ২০২১ সালে তা সমাপ্ত হওয়ার কথা। অন্যদিকে কয়েকটি ফ্লাইওভার নির্মাণ হয়েছে এবং অনেকগুলোর কাজ এগিয়ে চলছে। কিন্তু যথাযথ পরিকল্পনা না থাকায় যানজট নিরসনে ফ্লাইওভারগুলো ভূমিকা রাখতে পারছে না। নতুনগুলো কতটুকু কাজে আসবে তাও দেখার বিষয়। যানজটের যে অবস্থা তাতে ২০২১ সালে মনোরেল হওয়া পর্যন্ত যানজটে নাকাল নগরবাসীর জীবন কোথায় গিয়ে যে দাঁড়াবে ভাবতেও শঙ্কিত হতে হয়। ঢাকা শহরের চারদিকেই নদী ও খাল রয়েছে। এগুলোকে ব্যবহার উপযোগী করে পর্যাপ্ত নৌযানের ব্যবস্থা করা গেলে যানজট নিরসনের উল্লেখযোগ্য কাজ হবে। অথচ এ বিষয়ে কর্তৃপক্ষ উদাসীন। শেষ কথা যানজট নিরসনে সম্মিলিত ও বিস্তৃত সমাধানের পথে পদক্ষেপ গৃহীত হয়নি। যা করা হয়েছে তা হলো সমস্যা সমাধানে সাময়িক ও বিচ্ছিন্ন ব্যবস্থা। যার অধিকাংশই অপরিকল্পিত। রাজধানীকে যানজটমুক্তসহ অন্যান্য জনভোগান্তি দূর করতে হলে সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা নিয়ে এগোতে হবে। তা না হলে এ নগর বসবাসের অনুপযোগী হতে বেশি সময় লাগবে না। আমরা দেশের প্রাণকেন্দ্র রাজধানীকে ন্যূনতম বসবাসের উপযোগী হিসেবে দেখতে চাই। ধসধহ@ধসধহংঢ়রহহম.পড়স
×