ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ধর্মের নামে হরতাল ডেকে প্রত্যাখ্যাত ইসলামী দলগুলো

প্রকাশিত: ০৬:০২, ২৭ অক্টোবর ২০১৪

ধর্মের নামে হরতাল ডেকে প্রত্যাখ্যাত ইসলামী দলগুলো

ওদের সবাই জামায়াত ও বিএনপিপন্থী স্টাফ রিপোর্টার ॥ বিতর্কিত বক্তব্যের জেরে লতিফ সিদ্দিকীকে মন্ত্রিসভা ও আওয়ামী লীগের সদস্য থেকে সরিয়ে দেয়ার পরেও দেশজুড়ে হরতাল ডেকে প্রত্যাখ্যাত হয়েছে বিএনপি-জামায়াতপন্থী ইসলামী দলগুলো। বিএনপির প্রত্যক্ষ মদদ আর জামায়াতের সমর্থনের পরেও হরতালে জনগণ সাড়া না দেয়ায় সারাদেশে জনজীবন ছিল স্বাভাবিক। দু’একটি স্থানে ঝটিকা মিছিল ছাড়া হরতাল ডেকে মাঠে দেখা যায়নি সম্মিলিত ইসলামী দলের নেতাকর্মীদের। ঢাকায় দু’একটি ঝটিকা মিছিলে ইসলামী দলগুলোর সঙ্গে শিবিরের নেতাকর্মীদের দেখা গেছে। তবে কোন সমর্থনই হরতালকে সফল করতে পারেনি। রাজধানীসহ সারাদেশের যান চলাচল ছিল অনেকটাই স্বাভাবিক। সাধারণ মানুষসহ বিশ্লেষকরা বলছেন, নানান ছুঁতোয় দফায় দফায় হরতাল দিয়ে কর্মসূচীকে রীতিমতো ভোঁতা কর্মসূচীতে পরিণত করা হয়েছে। ফলে আবারও দেখা গেছে নামকাওয়াস্তে হরতালের চেহারা। কারণে-অকারণে হরতালের মতো কর্মসূচী এখন আর জনগণ চায় না। হরতাল সফল করার ঘোষণা দিয়ে শনিবার বিএনপি-জামায়াতপন্থী ইসলামী দলগুলোর নেতারা হুমকি দিয়েছিলেন, হরতালে বাধা দেয়া হলে লাগাতার কর্মসূচী দেয়া হবে। বিএনপির সঙ্গে আন্দোলন নিয়ে ইসলামী দলগুলোর নেতাদের শলাপরামর্শ এমনকি জামায়াতের পক্ষ থেকে হরতালে সমর্থনের ঘোষণাও দেয়া হয়েছিল। শনিবার রাতে হরতালে সমর্থন জানিয়ে জামায়াতের ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল মুজিবুর রহমান এক বিবৃতিতে বলেছিলেন, হরতাল সফল করার জন্য দলটির নেতাকর্মীসহ সাধারণ মানুষকেও আহ্বান জানিয়েছিল জামায়াত। তবে বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়ার আদালতে হাজিরা না দেয়ার কৌশল বাস্তবায়নে হরতাল ডাকাসহ রাজনীতি করার খবর প্রকাশ হয়ে পড়ায় কর্মসূচী পুরোপুরি ফ্লপ করে। যদিও হরতালে নিরাপত্তার অজুহাত দেখিয়ে বরাবরের মতো এবারও আদালতে হাজিরা দেননি খালেদা জিয়া। ধার্য হয়েছে শুনানির নতুন তারিখ। ধর্মের নামে হরতাল ডেকে রাজনীতি করায় বিএনপি চেয়ারপার্সন ও হরতাল আহ্বানকারীদের বিরুদ্ধে সমালোচনার ঝর বইছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। জানা গেছে, সম্মিলিত ইসলামী দলসমূহের ব্যানার থেকে ডাকা হরতালের পেছনে মামলায় বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়ার আদালতে হাজিরা না দেয়ার কৌশলই ছিল অন্যতম কারণ। জামায়াতপন্থী হেফাজতের একটি অংশ, খেলাফত মসলিস ও খেলাফত আন্দোলনসহ ২০ দলের শরিক নেতাদের ভিন্ন ব্যানারে মাঠে নামিয়ে ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করতে চেয়েছিল জামায়াত-শিবিরও। আন্দোলনের জন্য ইসলামী দলগুলোকে সমন্বয় করার দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল জামায়াতের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ মসজিদ মিশনের সেক্রেটারি জেনারেল খলিলুর রহমান মাদানীকে। হরতালের নামে নাশকতার চেষ্টার খবর জানতে পেরেই সরকারের বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ছিল সক্রিয়। হরতালে নাশকতার পরিকল্পনা করতে গিয়ে শনিবার আটক হয়েছেন বিএনপির অঙ্গসংগঠন যুবদলের সভাপতি মোয়াজ্জেম হোসেন আলালসহ ৬৪ নেতাকর্মী। নাশকতার চেষ্টার অভিযোগে রবিবার হরতালের সময়ও সারাদেশে আটক করা হয়েছে বিএনপি-জামায়াত-শিবিরের দেড় শতাধিক নেতাকর্মীকে। উদ্ধার করা হয়েছে নাশকতার জন্য রাখা ৫৭টি বোমা ও দুই কেজি গানপাউডার। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কঠোর নজরদারিতে অপচেষ্টা করেও কোথাও বড় ধরনের নাশকতা করতে পারেনি। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতারও প্রশংসা করেছেন সাধারণ মানুষ। এবারের হরতালে সকালেই প্রচুর যানবাহন চলাচল শুরু হয়। ঢাকার আন্তঃজেলা বাস টার্মিনালগুলো থেকে দূরপাল্লার অনেক বাসও ছেড়ে যায়। সাভাবিক ছিল ঢাকার সঙ্গে আশপাশের সকল জেলার যোগাযোগ। বন্ধ রাখা হয়নি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। রাজধানীর শাহবাগ, ফার্মগেট, বিজয়সরণি, নাবিস্কো, মহাখালী, বনানী, গুলশান, বারিধারা ও বাড্ডা ঘুরে দেখা গেছে, পাবলিক পরিবহনের চলাচল স্বাভাবিক রয়েছে। বিআরটিসি বাসের পাশাপাশি বিভিন্ন রুটে চলাচলকারী ব্যক্তিমালিকানাধীন বাসের ভিড়ও ছিল চোখে পড়ার মতো। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, সরকারী-বেসরকারী সব প্রতিষ্ঠান খোলা রয়েছে। শিশুদের প্রতিষ্ঠান হওয়ায় প্রাথমিক বিদ্যালয়ে হরতালের প্রভাব পড়লেও অধিকাংশ মাধ্যমিক স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়, এমনকি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়েও কার্যক্রম চলেছে। হরতালের শুরুতে সকালে মিরপুর ১১ নম্বরে হরতালের সমর্থনে মিছিল করে হরতাল আহ্বানকারীরা। যেখানে আব্দুল লতিফ সিদ্দিকীর সর্বোচ্চ শাস্তির ব্যবস্থা না করলে আন্দোলন অব্যাহত থাকবে বলে হুমকি দেন মাওলানা জাফরুল্লাহ খান। বলেন, আমাদের এই হরতাল নাস্তিক-মুরতাদদের বিরুদ্ধে। লতিফ সিদ্দিকীর বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ শাস্তির আইন পাস করতে হবে। এসময় উপস্থিত ছিলেন মুফতি মাহমুদুল হাসান, মাওলানা সাইফুল কাদের, মাওলানা আবদুল করিম, মাওলানা রিয়াজ উদ্দিন ও মাওলানা সাইফুল ইসলাম প্রমুখ। ফজর নামাজের পর বংশালের আরমানিটোলায় হরতালের সমর্থনে একটি মিছিল হয়। মিছিলে নেতৃত্ব দেন মাওলানা তাফাজ্জল হোসেন, মাওলানা জয়নাল আবেদীন এবং মাওলানা আসাদুল্লাহ। ডেমরা-যাত্রাবাড়ী সড়কেও মিছিল ও সড়ক অবরোধ করার চেষ্টা করে সম্মিলিত ওলামা মাশায়েখ পরিষদ। এদিকে রাজধানীর বাইরে হরতালে নাশকতার আশঙ্কায় লালমনিরহাট সীমান্তে রেড এ্যালার্ট জারি করে বিএসএফ। লালমনিরহাট থেকে আমাদের সংবাদদাতা জানিয়েছেন, হরতালে নাশকতার আশঙ্কায় লালমনিরহাট সীমান্তে রেড এ্যালার্ট জারি করে ভারতীয় সীমান্তরক্ষীবাহিনী বিএসএফ। শনিরবার রাত থেকে চক্রাবৃত্তেতে বিএসএফ কাঁটাতারের বেড়ার ওপর প্রতিস্থাপিত হ্যালোজিন বাল্বগুলো সীমান্তে থেমে থেমে জ্বালিয়ে রাখে। রবিবার বিএসএফ দুর্গাপুর ও মোগলহাট সীমান্তের বিপরীতে থাকা তাদের ভূখ-ে ধরলা নদীর চরে টহল দিতে দেখা গেছে। বিএসএফকে দুর্গাপুর ও মোগলহাট সীমান্তের বিপরীতে ঢিলছোড়া দূরুত্বে ভারতীয় দরিবশ ও জারিধরলা চরে টহল দিতে দেখা ছে। লালমনিরহাট ১৫ বিজিবি হেড কোয়ার্টরের অধীনে লালমনিরহাট সীমান্তের প্রায় ২শ’ কিলোমিটার নিরাপত্তার দায়িত্বে রয়েছে। বিজিবি’র জনবল এই সীমান্তে রয়েছে মাত্র ১৯৬ জন। এই স্বল্প সংখ্যার সীমান্তরক্ষী দিয়ে নিñিদ্র নিরাপত্তা কোনভাবেই সম্ভব নয়। তাই ভারতীয় বিএসএফ বিজিবি’র নিরাপত্তার দুর্বল দিকটি বিবেচনায় এনে তারাও বিজিবিকে সহায়তা করতে তাদের সীমান্তে নিরাপত্তা জোরদার করেছে। হরতালে নাশকতা দু’দেশের জন্য হুমকি হতে পারে এমন আশঙ্কা থেকে কঠোর অবস্থান নেয় বিএসএফ। রাজশাহী থেকে স্টাফ রিপোর্টার জানিয়েছেন, রাজশাহীতে ইসলামী দলগুলোর ডাকা হরতালের নামে নাশকতার চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। হরতালের আগেই র‌্যাবের সদস্যরা ৫৭টি হাতবোমা ও দুই কেজি গানপাউডার উদ্ধার করেছে। শনিবার দিবাগত রাত ২টার দিকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় (রাবি) ও রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (রুয়েট) মাঝের রাস্তা থেকে পরিত্যক্ত অবস্থায় বিস্ফোরকগুলো উদ্ধার করা হয়। র‌্যাব রাজশাহীর সহকারী পরিচালক এএসপি মীর্জা গোলাম সারোয়ার জানান, হরতালে নাশকতা চালানোর জন্য বিস্ফোরক মজুদ করা হয়েছে এমন গোপান সংবাদের ভিত্তিতে র‌্যাব সদস্যরা বিশেষ অভিযান চালায়। এ সময় রুয়েট ও রাবি সংলগ্ন এলাকা থেকে ৫৭টি শক্তিশালী হাতবোমা ও দুই কেজি গানপাউডার উদ্ধার করা হয়। তবে এ ঘটনায় কাউকে আটক করা সম্ভব হয়নি। রাতেই হাতবোমাগুলো র‌্যাবের বিস্ফোরক বিশেষজ্ঞ দলের সদস্যরা নিষ্ক্রিয় করেছে বলে জানান তিনি। র‌্যাব সূত্র জানায়, রাজশাহীতে ইসলামী দলগুলোর ডাকা হরতালের নামে নাশকতার পরিকল্পনা বাস্তবায়নে এসব হাতবোমা ও বিস্ফোরক নিয়ে আসা হয়েছিল। তবে র‌্যাবের গোয়েন্দা তৎপরতায় তাদের সে চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে।
×