ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

গোলাম আযমের স্বাভাবিক মৃত্যু গণহত্যাকারীদের বিচারে মারাত্মক ত্রুটি

প্রকাশিত: ০৪:৩৯, ২৬ অক্টোবর ২০১৪

গোলাম আযমের স্বাভাবিক মৃত্যু গণহত্যাকারীদের বিচারে মারাত্মক ত্রুটি

শাহরিয়ার কবির বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় সংঘটিত মানবজাতির ইতিহাসের নৃশংসতম গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের সঙ্গে সম্পৃক্ততার জন্য, এসব অপরাধের পরিকল্পনা ও নেতৃত্ব প্রদানের জন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল জামায়াতে ইসলামীর প্রাক্তন আমির গোলাম আযমকে ৯০ বছর কারাদ- দিয়েছিল এক বছর আগে। এই দ- ভোগ করার আগেই গত ২৩ অক্টোবর (২০১৪) গো. আযম মারা গেছেন বয়সের কারণে। এই ঘৃণিত ঘাতকের স্বাভাবিক মৃত্যু কাম্য ছিল না মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ শহীদের পরিবারবর্গের এবং গণহত্যাকারীদের বিচারপ্রত্যাশী সমগ্র জাতির। গণমাধ্যমে গো. আযমের মৃত্যু সংবাদ প্রচারের পর শহীদ পরিবারের সদস্যরা ক্ষোভ ও হতাশা ব্যক্ত করে আবারও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়ার কিছু মারাত্মক ত্রুটির উল্লেখ করে বলেছেন, এসব দ্রুত অপসারিত না হলে ’৭১-এর গণহত্যাকারী ও মানবতাবিরোধী অপরাধীরা কখনও তাদের কৃতকর্মের জন্য শাস্তিভোগ করবে না, ৩০ লাখ শহীদের পরিবার বঞ্চিত হবে ন্যায়বিচার থেকে এবং ’৭১-এর মতো গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের পুনরাবৃত্তিও রোধ করা যাবে না। গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধ ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের জন্য দায়ী ব্যক্তিদের কঠোরতম শাস্তি দিতে হয় ভুক্তভোগীদের ন্যায়বিচার প্রদানের পাশাপাশি এসব অপরাধের পুনরাবৃত্তি রোধ করার জন্য। গত শতাব্দীতে সংঘটিত এসব অপরাধের শতকরা ৯০ ভাগেরও বিচার হয়নি, অপরাধীরা শাস্তি পায়নি। যে কারণে এসব অপরাধের পুনরাবৃত্তিও রোধ করা যায়নি। সাত বছর আগে আমার প্রামাণ্যচিত্র ‘যুদ্ধাপরাধ ’৭১’-এ আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন গণহত্যা বিশেষজ্ঞ, ‘হিস্ট্রি অব জেনোসাইড ফ্রম স্পার্টা টু দারফুর’ গ্রন্থের প্রণেতা অধ্যাপক বেন কিরনান বলেছিলেন, ‘’৭১-এর গণহত্যার জন্য প্রধানত দায়ী পাকিস্তানী জেনারেল এবং বাংলাদেশের জামায়াতে ইসলামী। এই গণহত্যার বিচার হয়নি বলে পাকিস্তানী জেনারেলদের শক্তি ক্রমশ বৃদ্ধি পেয়েছে, তারা পাকিস্তানের রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজ সব কিছুর নিয়ন্ত্রক হয়েছে এবং অন্তিমে আল কায়েদার জন্ম দিয়েছে। বাংলাদেশে জামায়াতের নেতাদের বিচার হয়নি বলে তাদেরও শক্তি বৃদ্ধি হয়েছে, ক্ষমতার শরিক হয়েছে তারা এবং জঙ্গী-মৌলবাদী সন্ত্রাসের জন্ম দিয়েছে। ...বর্তমান বিশ্বে আল কায়েদা ও জঙ্গী মৌলবাদী সন্ত্রাসের জন্ম ও বিস্তারের সঙ্গে ’৭১-এর গণহত্যাকারীদের বিচার ও শাস্তি থেকে অব্যাহতির বিষয়টি গভীরভাবে সম্পর্কিত।’ ’৭১-এর গণহত্যাকারীদের বিচারের দাবিতে শহীদ পরিবারের সদস্যরা রাস্তায় নেমেছেন বাংলাদেশ হানাদারমুক্ত হওয়ার পর পরই। তখন বঙ্গবন্ধুর সরকার দালাল আইন প্রণয়ন করে তাদের বিচারের প্রক্রিয়া আরম্ভ করেছিলেন, যা ১৯৭৫-এ তাঁর নৃশংস হত্যাকা-ের পর বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জেনারেল জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এসে বন্ধ করে দেন। তিনি দালাল আইন বাতিল করে সাজাপ্রাপ্ত ও বিচারাধীন সব যুদ্ধাপরাধীকে কারাগার থেকে মুক্তির সুযোগ করে দিয়েছিলেন। শুধু তাই নয়, ’৭২-এর সংবিধানে নিষিদ্ধ ঘোষিত মৌলবাদী জামায়াতে ইসলামী এবং তাদের সহযোগী অপরাপর গণহত্যাকারী দলসমূহকে স্বাধীন বাংলাদেশে রাজনীতি করার সুযোগ করে দিয়েছেন। জিয়াউর রহমানের আমলেই ১৯৭৮-এর ১১ জুলাই অসুস্থ মাকে দেখার অজুহাতে জামায়াতপ্রধান পাকিস্তানী নাগরিক গোলাম আযম তিন মাসের ভিসা নিয়ে বাংলাদেশে আসেন। জিয়ার প্রশাসনের সবুজ সঙ্কেত পেয়ে ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ার পরও গোলাম আযম বেআইনীভাবে বাংলাদেশে থেকে গেছেন। যদিও জনঘৃণার কারণে আত্মগোপনে ছিলেন ১৯৯১ সালে খালেদা জিয়ার ক্ষমতালাভের আগ পর্যন্ত। গো. আযমের প্রতি সাধারণ মানুষের ঘৃণা কতটা প্রবল তার প্রমাণ পাওয়া গেছে ১৯৮১ সালের ১ জানুয়ারি। এদিন গোলাম আযম বায়তুল মোকাররম মসজিদে গিয়েছিলেন দলের এক কর্মীর জানাজা পড়ার জন্য। উপস্থিত মুসল্লিরা তাকে চেনামাত্র জুতোপেটা করে মসজিদ থেকে তাড়িয়ে দেন। পরদিন ঢাকার সব কাগজে ফলাও করে গো. আযমকে জুতোপেটার এই ছবি ছাপা হয়েছিল। সকল লজ্জা-শরম বিসর্জন দিয়ে গো. আযমের পরিবার এই বায়তুল মোকাররমে তার লাশ নিয়ে গেছে জানাজা পড়ার জন্য। গোলাম আযমের বিরুদ্ধে জনঘৃণা তুঙ্গে ওঠে যখন খালেদা জিয়ার সঙ্গে সমঝোতা করে জামায়াত তাকে ১৯৯১-এর ২৮ ডিসেম্বর দলের আমির ঘোষণা করে। পরদিন কয়েকটি দৈনিকে এই খবর প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধা সংসদসহ বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন এবং জাতীয় সংসদের ভেতর আওয়ামী লীগ ও অন্যান্য বিরোধী দলের সদস্য তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। অধ্যক্ষ আহাদ চৌধুরীর মুক্তিযোদ্ধা সংসদ বিক্ষোভ মিছিল করে গো. আযমের কুশপুতুল দাহ করে। এই বিক্ষোভেরই ফলশ্রুতি হচ্ছে ১৯৯২-এর ১৯ জানুয়ারি শহীদজননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে প্রথমে ‘একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি’ এবং এর তিন সপ্তাহ পরে ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন ও একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল জাতীয় সমন্বয় কমিটি’ গঠন, যা বাংলাদেশে নাগরিক আন্দোলনে এক অনন্য ইতিহাস সৃষ্টি করেছে। দেশের ১০১ বরেণ্য নাগরিক একটি ঘোষণায় স্বাক্ষর করে গঠন করেছিলেন ‘একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি।’ মুক্তিযুদ্ধকালে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী এবং তাদের এদেশীয় সহযোগীদের নৃশংসতম গণহত্যা, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ ও যুদ্ধাপরাধের বিবরণ দিয়ে এই ঘোষণার শেষে বলা হয়েছিল ‘আমরা নিম্নস্বাক্ষরকারীবৃন্দ এই মর্মে ঘোষণা করছি, বেআইনীভাবে বাংলাদেশে অবস্থানরত পাকিস্তানী নাগরিক গোলাম আযমকে যদি অবিলম্বে দেশ থেকে বহিষ্কার করা না হয় তাহলে আগামী ২৬ শে মার্চ স্বাধীনতার ২১তম বার্ষিকীর দিন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বিশিষ্ট নাগরিক ও আইনজ্ঞদের সমন্বয়ে গঠিত প্রকাশ্য গণআদালতে গোলাম আযমের বিচার হবে। যেহেতু গোলাম আযম অপরাধ করেছে এদেশের সমগ্র জনগণের কাছে সেহেতু গণআদালতই হবে এই ঘৃণিত ব্যক্তির বিচারের উপযুক্ত স্থান।... একই সঙ্গে আমরা দাবি জানাচ্ছিÑএকাত্তরের ঘাতকদের দল যারা এখনও স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও গণবিরোধী চক্রান্তে লিপ্ত সেই জামায়াতে ইসলামীসহ ধর্মব্যবসায়ীদের সকল রাজনৈতিক দল অবিলম্বে নিষিদ্ধ করতে হবে।’ নির্মূল কমিটি গঠনের পর মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের ৭২টি রাজনৈতিক দল, সামাজিক-সাংস্কৃতিক-পেশাজীবী-মুক্তিযোদ্ধা সংগঠনের সমন্বয়ে গঠিত হয়েছিল ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন ও একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল জাতীয় সমন্বয় কমিটি।’ এই সমন্বয় কমিটির উদ্যোগেই ১৯৯২-এর ২৬ মার্চ গণআদালতে পাঁচ লক্ষাধিক মানুষের উপস্থিতিতে যুদ্ধাপরাধী গো. আযমের প্রতীকী বিচারের কার্যক্রম অনুষ্ঠিত হয়েছিল। নির্মূল কমিটি এবং জাতীয় সমন্বয় কমিটির আহ্বায়ক হিসেবে জাহানারা ইমাম গণআদালতের বিচারকম-লীর চেয়ারপার্সনের দায়িত্ব পালন করেছিলেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতার ২১তম বার্ষিকীতে ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে যুদ্ধাপরাধীদের প্রতীকী বিচারের জন্য আয়োজিত গণআদালত ছিল বিশ্বব্যাপী গণহত্যা ও যুদ্ধাপরাধের বিচারের আন্দোলনে এক অনন্যসাধারণ সংযোজন। ২০০৮ সালের ৯ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বাংলাদেশের মানুষ প্রধানত যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের অঙ্গীকারের জন্য শেখ হাসিনার মহাজোটকে তিন-চতুর্থাংশেরও বেশি আসনে জয়ী করেছে। নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ২০১০ সালের ২৫ জানুয়ারি মহাজোট সরকার ১৯৭৩-এ প্রণীত ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইন’ অনুযায়ী ’৭১-এর গণহত্যাকারী, মানবতাবিরোধী অপরাধী ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে। ২০১৩ সালে এই ট্রাইব্যুনাল গোলাম আযমসহ ১০ শীর্ষস্থানীয় গণহত্যাকারীকে মৃত্যুদ-, যাবজ্জীবন ও আমৃত্যু কারাদ- প্রদান করে। ২০১৩-এর ৫ ফেব্রুয়ারি যুদ্ধাপরাধী জামায়াতনেতা কাদের মোল্লাকে মৃত্যুদ- প্রদান না করার প্রতিবাদে তরুণ অনলাইন ব্লগার এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা শাহবাগ চত্বরে সমবেত হয়ে ছাত্র-জনতার এক অভূতপূর্ব অভ্যুত্থান ঘটায়, যার অভিঘাত ছড়িয়ে পড়ে তেঁতুলিয়া থেকে টেকনাফ পর্যন্ত। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বাঙালীরা এর প্রতি স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থন জানিয়ে গণহত্যাকারীদের মৃত্যুদ-ের দাবিতে সোচ্চার হয়ে ওঠেন। শাহবাগে ছাত্র-জনতার মহাসমাবেশ একটানা ১৭ দিন অব্যাহত ছিল, যা প্রমাণ করেছে দলমত নির্বিশেষে বাংলাদেশের সর্বস্তরের মানুষ ’৭১-এর গণহত্যাকারীদের জন্য সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদ- ছাড়া অন্য কোন দ- চান না। শাহবাগের তরুণরা কোন বিশেষ রাজনৈতিক দলের অনুসারী ছিলেন না। তারা ‘জয় বাংলা’সহ মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন সেøাগান দিয়ে শাহবাগ চত্বর থেকে আরম্ভ করে সারা দেশ কাঁপিয়েছেন, রাজাকারদের ফাঁসির দাবিতে নতুন সেøাগান, কবিতা ও গান রচনা করেছেন। এই মহাজাগরণের কেন্দ্রে একটি মাত্র ছবি বিশাল ক্যানভাসে স্থাপিত হয়েছিলÑযেটি ছিল শহীদ জননী জাহানারা ইমামের। শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চের দাবির কারণে সরকার ১৯৭৩-এর আইন সংশোধন করে বাদী ও বিবাদীর আপীলের সমান সুযোগ নিশ্চিত করে। এর পর সুপ্রীমকোর্টের আপীলে কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন কারাদ-ের পরিবর্তে মৃত্যুদ- প্রদান করা হয়, যা কার্যকর হয়েছে ২০১৩-এর ১২ ডিসেম্বর। গো. আযমের মামলায় তার বিরুদ্ধে উত্থাপিত ৬১টি অপরাধ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হলেও এবং এসব অপরাধের শাস্তি মৃত্যুদ- বলা হলেও ট্রাইব্যুনালের রায়ে বার্ধক্যের কারণে তাকে মৃত্যুদ- প্রদান করা হয়। যদিও এই অনুকম্পার জন্য গো. আযম বা তার আইনজীবী ট্রাইব্যুনালের কাছে কোন আবেদন করেননি। ’৭১-এর গণহত্যাকারীদের তালিকায় প্রথম নামটি গোলাম আযমের হলেও তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে ট্রাইব্যুনাল গঠনের ২১ মাস পর। এই গ্রেফতারের জন্য নির্মূল কমিটিকে রাস্তায় বিক্ষোভ, মিছিল, সমাবেশ, মানববন্ধন সবই করতে হয়েছিল। ট্রাইব্যুনালে গো. আযমের মামলা চলেছে দেড় বছরেরও বেশি। তারপর রায় ঘোষণা থেকে মৃত্যু পর্যন্ত সব মিলিয়ে পৌনে তিন বছরে তাকে এক দিনের জন্যও কারাগারে থাকতে হয়নি। বার্ধক্য ও অসুস্থতার অজুহাতে পুরো সময়টা তিনি ছিলেন দেশের সেরা হাসপাতালে, সেরা চিকিৎসকদের তত্ত্বাবধানে এবং পারিবারিক পরিবেশে; ৩০ লাখ শহীদ পরিবারসহ বিচারপ্রত্যাশী গোটা জাতির ট্যাক্সের টাকায়। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ দেশের শীর্ষস্থানীয় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, বুদ্ধিজীবী, পেশাজীবী এবং বহু বরেণ্য মুক্তিযোদ্ধাকে জীবনের বিভিন্ন সময়ে পাকিস্তান ও বাংলাদেশ আমলে কারাগারে থাকতে হয়েছে। গো. আযম যে শান-শওকতের সঙ্গে গ্রেফতারকালীন সময় অতিবাহিত করেছেন এ দেশে আর কারও ভাগ্যে তা জোটেনি। গো. আযমের মতো একজন ভয়ঙ্কর অপরাধীর প্রতি রাষ্ট্রের এই আচরণ আমাদের দেশের ন্যায়বিচার ও সভ্যতার বোধকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। আমি গত দুই দশকে পঞ্চাশেরও অধিক গণহত্যাবিষয়ক আন্তর্জাতিক সেমিনার ও সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেছি। বহু সভায় গণহত্যা বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, গণহত্যা এমন এক জঘন্য অপরাধ যার সর্বনি¤œ শাস্তি হওয়া উচিত মৃত্যুদ-। মৃত্যুদ-ের অধিক কোন শাস্তির যদি সুযোগ থাকত সেটাই দেয়া উচিত গণহত্যাকারীদের। গোলাম আযমের মৃত্যু সংবাদ শুনে দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে শহীদ পরিবারের সদস্যরা আমাকে ফোন করেছেন, কেঁদেছেন হত্যাকারীদের পালের গোদা গো. আযমের শাস্তি থেকে অব্যাহতি প্রাপ্তিতে। একজন শহীদের পুত্র এসএমএস করেছেন গো. আযমের লাশ ৯০ বছর মর্গে রাখার দাবি জানিয়ে। তবে অধিকাংশ বলেছেন, উপরে আল্লাহ আছেন। আল্লাহ নিশ্চয় ৩০ লাখ শহীদ পরিবারের ফরিয়াদ শুনবেন। মুসলমানরা বিশ্বাস করেন, এতিমের ফরিয়াদে আল্লাহর আরশও কেঁপে ওঠে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের শহীদরা বিশ্বাস করেন গণহত্যাকারী গো. আযম মৃত্যুর পর অনন্ত নরকের শাস্তি ভোগ করবেন। কারণ মৃত্যুর আগে তিনি তার কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা চাননি। শহীদ পরিবারের কেউ তাকে ক্ষমা করেননি। ২০১০ সালের জুনে ঢাকায় আমরা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, ধর্মনিরপেক্ষ, মানবতা ও বিশ্বশান্তির ওপর একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন আয়োজন করেছিলাম। এই সম্মেলনে এশিয়া, ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকার বিভিন্ন দেশের অর্ধশতাধিক প্রতিনিধি ও পর্যবেক্ষক আমন্ত্রিত হয়েছিলেন। সম্মেলনে উত্তপ্ত আলোচনা হয়েছে গণহত্যাকারীদের মৃত্যুদ- সম্পর্কে। সম্মেলনের প্রথম অধিবেশনের বিষয় ছিল ‘বাংলাদেশের গণহত্যা এবং যুদ্ধাপরাধীদের বিচার।’ বাংলাদেশ, পাকিস্তান, ভারত, ইরান ও নেপালের বক্তারা গণহত্যাকারীদের মৃত্যুদ- সমর্থন করলেও ইউরোপীয় পার্লামেন্টের সদস্য সিসিলিয়া উইকস্ট্রম বলেছিলেন, বাংলাদেশ মৃত্যুদ-ের প্রথা বাতিল না করলে এই বিচার তাদের সমর্থন পাবে না। সিসিলিয়ার জবাব দিয়েছিলেন ‘নর্থ আমেরিকান জুরিস্ট এ্যাসোসিয়েশন’-এর প্রাক্তন সভাপতি, কানাডার সুপরিচিত মানবাধিকার নেতা এ্যাটর্নি উইলিয়াম স্লোন। তিনি বলেছিলেন, কানাডায় মৃত্যুদ- নেই, তিনি নিজেও মৃত্যুদ- সমর্থন করেন না। তবে বাংলাদেশের পরিস্থিতি ভিন্ন। মুক্তিযুদ্ধের পর বঙ্গবন্ধুর সরকার ’৭১-এর কয়েক যুদ্ধাপরাধীকে মৃত্যুদ-সহ বিভিন্ন মেয়াদে কারাদ- দিয়েছিল। ১৯৭৫-এ সরকার পরিবর্তনের পর তাদের সবাইকে ছেড়ে দেয়া হয়েছে। এ্যাটর্নি স্লোন নির্দিষ্টভাবে বলেছিলেন, বাংলাদেশে গণহত্যার অভিযোগে এখন যাদের বিচার চলছে তাদের অপরাধ প্রমাণিত হলে মৃত্যুদ-ই দেয়া উচিত। না হলে সরকার পরিবর্তনের পর এই গণহত্যাকারীরা আবারও শাস্তি থেকে অব্যাহতি পাবে এবং ’৭১-এর গণহত্যার জন্য কেউ কখনও শাস্তি পাবে না। অপরাধকে শাস্তি থেকে অব্যাহতি দিলে সমাজ ও রাষ্ট্রে কী বিপর্যয় সৃষ্টি হয় এ বিষয়ে এ্যাটর্নি স্লোন সম্মেলনে একটি জ্ঞানগর্ভ প্রবন্ধও উপস্থাপন করেছিলেন। গো. আযমের স্বাভাবিক মৃত্যু এ্যাটর্নি স্লোনের এই আশঙ্কাকে সত্য প্রমাণ করেছে। শুধু সরকার পরিবর্তন নয়, স্বাভাবিক মৃত্যুও একজন ব্যক্তিকে অপরাধের শাস্তি থেকে অব্যাহতি দিতে পারে। ট্রাইব্যুনাল এবং আমাদের উচ্চতর আদালত যদি সভ্যতার বোধ ও আইনের শাসনের প্রতি দায়বদ্ধ হন, তাঁরা যদি ’৭১-এর গণহত্যা প্রত্যক্ষ করে থাকেন এবং ৩০ লাখ শহীদ পরিবারের হৃদয়ের বিরামহীন রক্তক্ষরণ অনুভব করেন; তাহলে এই শহীদদের প্রতি রাষ্ট্রের দায়মোচন এবং তাদের পরিবারদের ন্যায়বিচার নিশ্চিতকরণের জন্য ভবিষ্যতে গণহত্যাকারীদের মৃত্যুদ- ছাড়া অন্য কোন দ- প্রদান করবেন না, এটাই আমাদের প্রত্যাশা। ২৫ অক্টোবর ২০১৪
×