ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

অবকাঠামো ও জমি সমস্যার ফাঁদ ॥ মুখ ঢাকছে বিনিয়োগ

প্রকাশিত: ০৪:৩০, ২৬ অক্টোবর ২০১৪

অবকাঠামো ও জমি সমস্যার ফাঁদ ॥ মুখ ঢাকছে বিনিয়োগ

০ নিবন্ধিত প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বাড়লেও প্রকৃত বিনিয়োগে হতাশা ০ কর্মসংস্থান ও প্রবৃদ্ধি অর্জনে নেতিবাচক প্রভাব ০ ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার মূল লক্ষ্য পূরণ হচ্ছে না হামিদ-উজ-জামান মামুন ॥ জমি ও অবকাঠামোর ফাঁদে আটকে আছে দেশী-বিদেশী বিনিয়োগ। নিবন্ধিত প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা কিছুটা বাড়লেও প্রকৃত বিনিয়োগ নিয়ে হতাশা কাটছে না। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বিরাজমান থাকলেও শুধু জমি ও অবকাঠামো সমস্যার কারণেই দেশে কাক্সিক্ষত বিনিয়োগ হচ্ছে না । এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে প্রবৃদ্ধি ও কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে। এ প্রেক্ষিতে কাক্সিক্ষত বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে দ্রুত সমস্যা সমাধানের তাগিদ দিয়েছে উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা, অর্থনীতিবিদ, শীর্ষ ব্যবসায়ী সংগঠনের নেতৃবৃন্দ ও এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা। এ বিষয়ে ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স এ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সভাপতি কাজী আকরাম উদ্দীন জনকণ্ঠকে বলেন, গত বছরের রাজনৈতিক অস্থিরতার পরও বর্তমানে দেশী-বিদেশী বিনিয়োগ বাড়ছে। সেই পরিবেশ আমরা তৈরি করতে পেরেছি। তারপরও সবাই জানি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে জমি ও অবকাঠামো সমস্যা রয়েছে। আজ (শনিবার) অনুষ্ঠিত আমাদের বোর্ড সভায় আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে যে, বিনিয়োগকারীদের জন্য জমি ও অবকাঠামো সমস্যা সমাধানের জন্য কি কি করা যায় সে বিষয়ে সরকারের সঙ্গে আলোচনা করা হবে। কেননা বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগ করতে চাচ্ছে। যেমন, জমি দেয়া হয়েছে বলেই জাপান বাংলাদেশে বিনিয়োগ করতে আসছে। কয়েকদিন আগে ইতালি সফরে দেখেছি প্রচুর বিনিয়োগকারী বিনিয়োগে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। এখন সমস্যাগুলো সমাধানে কাজ করতে হবে। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) মহাপরিচালক ড. মোস্তফা কে. মুজেরী জনকণ্ঠকে বলেন, বিনিয়োগ বোর্ডের হিসাব অনুযায়ী নিবন্ধিত বিদেশী প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা হয়ত কিছুটা বেড়েছে। কিন্তু রেজিস্ট্রেশন মানে তো আর বিনিয়োগ নয়। এটি হচ্ছে ইনটেনশন বা বিনিয়োগের ইচ্ছা। তাই প্রকৃত বিনিয়োগ কতটা হচ্ছে সেটিই ভাবনার বিষয়। তিনি বলেন, সামগ্রিকভাবে বেসরকারী বিনিয়োগ শ্লথ। যেখানে বেসরকারী বিনিয়োগ কাক্সিক্ষত গতি পায়নি, সেখানে বিদেশী বিনিয়োগ আশা করা যায় না। বিদেশী বিনিয়োগের ক্ষেত্রে অনেক বাধা রয়েছে। এর মধ্যে প্রধান বাধা হিসেবে মনে করছি জমির দুষ্প্রাপ্যতা এবং অবকাঠামো সমস্যা। এক্ষেত্রে যোগাযোগ খাতের বড় বড় প্রকল্প বাস্তবায়নে ধীর গতি, বিদ্যুত সমস্যা ও পোর্টের ক্ষেত্রে এখনও সমস্যা বিরাজ করছে। তার মধ্যেও বিনিয়োগ ক্ষেত্রে সামান্য উন্নতি হলেও সামগ্রিকভাবে কাক্সিক্ষত মাত্রায় হচ্ছে না। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, নীতির ক্ষেত্রে খুব বেশি সমস্যা নেই। তারপরও কোরিয়ান ইপিজেড নিয়ে যে সমস্যা হয়েছে তাতে বিদেশী বিনিয়োগকারীদের কাছে ভুল সিগন্যাল যাচ্ছে। আমরা স্পেশাল ইকোনমিক জোন দ্রুত করতে পারছি না বা ধীরগতি বিরাজ করছে। এখন কিছু বিদেশী মাল্টিন্যাশনাল বিনিয়োগ দ্রুত দেশে আনতে হবে। তাহলে অন্যরা দেখে উৎসাহিত হবে। সূত্র জানায়, চলতি বছরের এপ্রিল থেকে জুন মাস পর্যন্ত তিন মাসে শতভাগ বিদেশী প্রতিষ্ঠান ১০টি এবং যৌথ বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান ১৬টিসহ মোট ২৬টি প্রতিষ্ঠান নিবন্ধিত হয়েছে। এগুলোর বিনিয়োগের পরিমাণ ৫০৭ কোটি ৫৮ লাখ ২ হাজার কোটি টাকা। তার আগের তিন মাসে অর্থাৎ জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত নিবন্ধিত হয়েছিল ৪০টি প্রতিষ্ঠান। এতে বিনিয়োগ হয়েছিল ১ হাজার ১৬৬ কোটি ৪৫ লাখ টাকা। এক্ষেত্রে যৌথ ও শতভাগ বিদেশী বিনিয়োগ কমেছে ৫৬ দশমিক ৪৮ শতাংশ। কিন্তু পরবর্তীতে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বিরাজ করায় দেশী-বিদেশী বিনিয়োগ কিছুটা বাড়তে শুরু করেছে। বিনিয়োগ বোর্ডের সর্বশেষ নিবন্ধিত শিল্পের ত্রৈমাসিক প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, গত জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তিন মাসে শতভাগ বিদেশী প্রতিষ্ঠান ১২টি এবং যৌথ বিনিয়োগের জন্য নিবন্ধিত ১৫টি শিল্প প্রতিষ্ঠানসহ মোট ২৭টি নিবন্ধিত শিল্প ইউনিটের প্রস্তাব পাওয়া গেছে। এসব ইউনিটে বিনিয়োগের পরিমাণ এক হাজার ৭১১ কোটি ৮৫ লাখ টাকা। এক্ষেত্রে তার আগের তিন মাসের তুলনায় প্রস্তাবিত বিনিয়োগকৃত অর্থের পরিমাণ বেড়েছে। পাশপাশি বেড়েছে দেশী বিনিয়োগ নিবন্ধনের সংখ্যাও। বিনিয়োগ বোর্ড বলছে স্থানীয় ও বৈদেশিক মিলে সম্মিলিতভাবে বস্ত্রশিল্প খাতে বেশী বিনিয়োগ পাওয়া গেছে; যা মোট বিনিয়োগের ৩৭ দশমিক ৩৪ শতাংশ। এছাড়া পর্যায়ক্রমিকভাবে ইঞ্জিনিয়ারিং খাতে ২৯ দশমিক ৩১, রসায়ন শিল্প খাতে ১৩ দশমিক ৫৬, সেবা খাতে আট দশমিক ২৬ এবং অন্যান্য শিল্পখাতে ১১ দশমিক ৫৩ শতাংশ বিনিয়োগ প্রস্তাব নিবন্ধিত হয়েছে। বিনিয়োগ বিষয়ে এক্সপোর্টার্স এ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সভাপতি আব্দুস মুর্শেদী জনকণ্ঠকে বলেন, বিনিয়োগ বোর্ডে নিবন্ধিত শিল্প ইউনিটের সংখ্যা বাড়লেই যে আশান্বিত হতে হবে এমন কোন কথা নেই। বাস্তবতা হচ্ছে অনেক দেশী ও বিদেশী বিনিয়োগকারী নিবন্ধন করে দুশ্চিন্তায় আছে। প্রায় দুই শ’র মতো কোম্পানি ব্যাংক ঋণ ম্যানেজ করেছে অন্যান্য কাজও করেছে; কিন্তু ইউটিলিটর অভাবে কারখানা চালু করতে পারছে না। আবার অনেকেই সবকিছু রেডি করেছে কিন্তু জমি পাচ্ছে না। তাছাড়া রফতনিমুখী শিল্পের উদ্যোক্তারা হিমসিম খাচ্ছে। কারণ গত বছরের রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা যদিও এখন নেই তারপরও পরিবহন খাতের সমস্যা এবং ব্যাংকিং খাতেও সমস্যা বিরাজমান। এ্যাকর্ড ও এ্যালায়েন্স আসার কারণে আমাদের কমপ্লায়েন্স ব্যয় অনেক বেড়ে গেছে। সেই সঙ্গে বিনিয়োগের জন্য একটি অন্যতম উপাদান জমির দাম এখন সবচেয়ে বেশি। বিদ্যুত, গ্যাস ও অবকাঠামো খাতের সমস্যা সমাধান করে কিছু শিল্পে সরকারকে রিফাইন্যান্সিং করা উচিত, যেটি ভারতে আছে। এখন বলতে গেলে বলতে হয় উদ্যোক্তারা নিজেদের টিকিয়ে রাখার কাজে ব্যস্ত। এ অবস্থায় নতুন বিনিয়োগ আনতে গেলে সরকারীভাবে প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করতে হবে। বিশ্বব্যাংকের মতে, চলতি অর্থবছরে ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে গেলে ৩৪ থেকে ৩৫ শতাংশ বিনিয়োগ দরকার। বর্তমানে জিডিপির ২৮ শতাংশ বিনিয়োগ হচ্ছে। এক বছরের মধ্যে তা ৩৪ শতাংশে নিয়ে যাওয়া প্রায় অসম্ভব। বিনিয়োগের ক্ষেত্রে প্রধান সমস্যা হচ্ছে ভূমি ও অবকাঠামো। এজন্য যে চারটি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল তৈরির উদ্যোগ নেয়া হয়েছে তা দ্রুত করার পরামর্শ দিয়েছে সংস্থাটি। অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলো তৈরি হলে সেখানে ব্যাপক বিদেশী বিনিয়োগ আসবে। তাছাড়া তৈরি পোশাক খাতের চলমান সংস্কারের পাশাপাশি পদ্মা সেতুর বাস্তবায়ন, ঢাকা-চট্টগ্রাম ও ঢাকা-ময়মনসিংহ চার লেন সড়কের কাজ দ্রুত শেষ করা, ঢাকা-চট্টগ্রাম ডবল লাইন রেলপথ, ঢাকা মেট্রোরেলসহ বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচীর আওতায় নেয়া বড় বড় অবকাঠামো প্রকল্পের বাস্তবায়ন করতে হবে। সংস্থাটির পক্ষ থেকে সম্প্রতি বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট আপডেট প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিনিয়োগের জন্য পরিবেশের ঘাটতি রয়েছে। জাতীয় সঞ্চয় হার এখন জিডিপির ৩০ শতাংশ; যা অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগ হারের চেয়ে ১ দশমিক ৮৫ শতাংশ বেশি। ঢাকা অফিসে নিযুক্ত বিশ্বব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, বিনিয়োগ হওয়ার মতো সম্ভাবনা ও অর্থ থাকলেও রাস্তাঘাট, অবকাঠামো, গ্যাস, বিদ্যুত ও বন্দর সুবিধা, অর্থনৈতিক অঞ্চল তৈরি হলে বেসরকারী ও বিদেশী বিনিয়োগ আসবে। বিনিয়োগ বিষয়ে ফরেন ইনভেস্টমেন্ট চেম্বার অব কমার্স এ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফআইসিসিআই) সভাপতি রুপালী চৌধুরী জনকণ্ঠকে বলেন, আমাদের বিনিয়োগের প্রধান সমস্যাই হচ্ছে জমি নিয়ে। সেই সঙ্গে অবকাঠামো। এই দুই সমস্যার কারণে কাক্সিক্ষত বিনিয়োগ আসছে না। ফলে কাক্সিক্ষত কর্মসংস্থান ও প্রবৃদ্ধিও হচ্ছে না। এজন্য অতি দ্রুত সরকারকে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল তৈরি করতে হবে। রাস্তা, বন্দর, বিদ্যুত-গ্যাস সমস্যার সমাধানে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া জরুরী। আর একটি বিষয় হচ্ছে, দক্ষ জনশক্তি তৈরি করতে হবে। তাহলে বিদেশী বিনিয়োগ বাড়বে। পরিকল্পনা কমিশন সূত্র জানায়, চলমান ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা অনুযায়ী পাঁচ বছরে মোট দেশজ বিনিয়োগ ধরা হয়েছে যথাক্রমে (জিডিপির অংশ) ২৬ দশমিক পাঁচ শতাংশ, ২৮ দশমিক চার শতাংশ, ২৯ দশমিক ছয় শতাংশ, ৩১ শতাংশ এবং শেষ বছরে ৩২ দশমিক পাঁচ শতাংশ। ব্যক্তিখাতের বিনিয়োগ (জিডিপির অংশ) যথাক্রমে ২০ দশমিক নয় শতাংশ, ২২ দশমিক দুই শতাংশ, ২৩ শতাংশ, ২৪ শতাংশ এবং ২৫ শতাংশ। অবকাঠামো খাতে বিনিয়োগ ( জিডিপির অংশ) যথাক্রমে দুই শতাংশ, তিন দশমিক পাঁচ শতাংশ, চার দশমিক পাঁচ শতাংশ, পাঁচ শতাংশ এবং ছয় শতাংশ। সরকারী খাতে বিনিয়োগ (জিডিপির অংশ) যথাক্রমে পাঁচ দশমিক ছয় শতাংশ, ছয় দশমিক দুই শতাংশ, ছয় দশমিক ছয় শতাংশ, সাত শতাংশ এবং সাত দশমিক পাঁচ শতাংশ। ২০১১ সাল থেকে বাস্তবায়ন শুরু হওয়া পরিকল্পনায় বলা হয়েছিল, ২০১৫ সাল নাগাদ সরকারী ও বেসরকারী বিনিয়োগ জিডিপির ৩২ শতাংশে উন্নীত করা হবে। ওই বছর বিনিয়োগ ছিল জিডিপির ২৪ শতাংশ। কিন্তু সম্প্রতি মধ্যবর্তী মূল্যায়নে দেখা গেছে, চার বছর পর এখন সরকারী-বেসকারী বিনিয়োগ হয়েছে জিডিপির ২৮ দশমিক ৬৯ শতাংশ। বাকি এক বছরে তা তিন শতাংশ বাড়িয়ে ৩২ শতাংশে উন্নীত করা সম্ভব হবে না। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে,সরকারী ও মোট বিনিয়োগের লক্ষ্য ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্র্ণ নয়। যদিও পূর্বের যেকোন সময়ের তুলনায় বিনিয়োগের পরিমাণ কিছুটা বেড়েছে; তারপরও মোটের ওপর ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় বিনিয়োগের লক্ষ্য পূরণ হবে না। বলা হয়েছে, বাংলাদেশ গ্লোবাল কার্যসম্পাদন ক্ষমতা র‌্যাংকিং হতে দেখা যায় বিনিয়োগের পরিবেশ ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার প্রক্ষেপণ মতো সহায়ক নয়। এ বিষয়ে পরিকল্পনার মূল্যায়ন প্রতিবেদন তৈরির সঙ্গে যুক্ত পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের সদস্য ড. শামসুল আলম জনকণ্ঠকে বলেন, শুধু রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা থাকলেই বিনিয়োগ আসবে না। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বছরের পর বছর ধরে সিভিল ওয়্যার চলছে। সেসব দেশে বিনিয়োগ ও প্রবৃদ্ধি বেড়েই চলছে। আমাদের দেশে মূল সমস্যা হচ্ছে জমির সঙ্কট আর অবকাঠামো। যদিও বিদ্যুত সমস্যার কিছুটা উন্নতি হয়েছে কিন্তু গ্যাস দিতে পারছি না। বর্তমানে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার ক্ষেত্রে অতীতের যেকোন সময়ের তুলনায় ভাল আছে। ফলে বিনিয়োগকারীদের কিছুটা আস্থা ফিরে আসছে। বিনিয়োগ নীতির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ যথেষ্ট উদার হলেও আমাদের প্রধান দুটি সমস্যা সমাধান দ্রুত করতে হবে। পাশাপাশি জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। অন্যদিকে সম্প্রতি প্রকাশিত জাতিসংঘের বাণিজ্য ও উন্নয়ন সংস্থার (আঙ্কটাড) ‘বিশ্ব বিনিয়োগ রিপোর্ট ২০১৪’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে অর্থনীতির ওপর আস্থা থাকায় ২০১৩ সালে দেশে সরাসরি বিদেশী বিনিয়োগ বেড়েছে। এজন্য গত বছর রাজনৈতিক অস্থিরতা থাকলেও তার প্রভাব পড়েনি বিদেশী বিনিয়োগে। দেশে গত বছর এই বিনিয়োগ হয়েছে ১৫৯ কোটি ৯০ লাখ মার্কিন ডলার, যা আগের বছরের চেয়ে প্রায় ২৪ শতাংশ বেশি। আর সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগ এসেছে ব্যাংকিং, টেক্সটাইল এবং টেলিকমিউনিকেশন্স খাতে। প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৩ সালে বিশ্বে এফডিআই ৯ শতাংশ বেড়ে হয়েছে ১ দশমিক ৪৫ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার। সংস্থাটি মনে করছে, ২০১৪ সালে আঙ্কটাড প্রকল্পের আওতায় উন্নত দেশগুলোতে এই বিনিয়োগের পরিমাণ দাঁড়াবে ১ দশমিক ৬ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারে। আর ২০১৬ সালে তা ১ দশমিক ৮ ট্রিলিয়ন ডলারে পৌঁছবে। আঙ্কটাডের ওই প্রতিবেদনে বাংলাদেশে এই বিনিয়োগের বৃদ্ধি দেখানো হয়েছে ২৩ দশমিক ৬৬ শতাংশ। তা ২০১২ সালে ১৩ দশমিক ৮২ শতাংশ বেড়েছিল। প্রতিবেশী দেশ ভারতে এই বৃদ্ধির হার ১৬ দশমিক ৫৪ শতাংশ বেড়ে বিনিয়োগ হয়েছে ২ হাজার ৮১৯ কোটি ৯০ লাখ মার্কিন ডলার। তবে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট খাতগুলোতে বেসরকারী বিনিয়োগের অংশগ্রহণ তুলনামূলকভাবে কমে গেছে। উন্নয়নশীল দেশের তুলনায় স্বল্পোন্নত দেশগুলোতে (এলডিসি) এটা বেশিমাত্রায় কমেছে। ওই প্রতিবেদন প্রকাশের সময় প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানি উপদেষ্টা তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের পরে বাংলাদেশের অবস্থানকে ইতিবাচক হিসেবে উল্লেখ করে বলেন, আশা করছি-এফডিআই আগামী বছর ৫০ শতাংশ বেড়ে ২ থেকে আড়াই বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ হবে। তবে এজন্য অবকাঠামো খাতের ব্যাপক উন্নতি দরকার হবে। সরকার সেই লক্ষ্য সামনে নিয়ে কাজ করছে। তিনি বলেন, এটা ঠিক, আমাদের অনেক চ্যালেঞ্জ রয়েছে। কিন্তু বর্তমান সরকারের প্রতি বিদেশীদের দীর্ঘমেয়াদি আস্থা রয়েছে। এজন্য দেশের উৎপাদনমুখী বিভিন্ন শিল্পখাতে বিদেশী বিনিয়োগ বেড়েছে। তিনি বলেন, বিদেশী বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে বাংলাদেশ, চীন, ভারত ও মিয়ানমারকে সঙ্গে নিয়ে গঠন করা হচ্ছে বিসিআইএম। গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করা হবে। এছাড়া বিদ্যুত উৎপাদন বাড়ানো হয়েছে। মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্র বিরোধ নিষ্পত্তি হয়েছে। ফলে দেশে বিদেশীরা আকৃষ্ট হচ্ছেন। ইন্ডাস্ট্রিতে বিদ্যুত দিতে অবকাঠামো দরকার। এখন সেই অবকাঠামো নির্মাণ করা হচ্ছে। এর আগে এক প্রতিবেদনে বিশ্বব্যাংক বলেছিল, শ্রমঘন ছয় খাতে দেড় কোটি লোকের কর্মসংস্থানের সম্ভাবনা রয়েছে। একে কাজে লাগাতে ৫টি পরামর্শ দিয়েছে বিশ্বব্যাংক। এর ওপর ভিত্তি করে একটি কর্মকৌশল তৈরি করছে সরকার। এ বিষয়ে ইতোমধ্যেই ১৭টি মন্ত্রণালয় ও সংস্থার কাছ থেকে মতামত নেয়া হয়েছে। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে ব্যাপক কর্মসংস্থান সৃষ্টি, অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপন ও উচ্চতর প্রবৃদ্ধি কর্মকৌশল সংক্রান্ত এক সভায় কর্মসংস্থান সৃষ্টির এ বিষয়ে ব্যাপক আলোচনা হয়েছে বলে জানােেগছে। এ নিয়ে মুখ্য সচিবকে প্রধান করে একটি টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছে। তবে এ উদ্যোগটি যতটা দ্রুত হওয়া দরকার ততটা দ্রুত হচ্ছে না বলে মনে করছে বিশ্বব্যাংক। এ বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের লীড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন জনকণ্ঠকে বলেন, শ্রমিকদের দাম বাড়ায় চীন থেকে আগামী দশ বছরে ৮০ মিলিয়ন কর্মসংস্থান বেরিয়ে যাবে। এর মধ্যে আমরা হিসাব করেছি বাংলাদেশে শ্রমঘন শিল্পে ১৫ মিলিয়ন কর্মসংস্থান সম্ভব। কিন্তু এর জন্য বেশ কিছু পদক্ষেপ নিতে হবে। এর জন্য বিনিয়োগ দরকার। অবকাঠামো, জমি, দক্ষ শ্রমিক, অর্থায়ন ও জ্বালানি এগুলোর প্রয়োজন। এর সব এক সঙ্গে করে অর্থনৈতিক অঞ্চল তৈরির ওপর বেশি জোর দেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, থাইল্যান্ডে যেখানে ৩০০ অর্থনৈতিক অঞ্চল, চীনে ৩ হাজার এবং ফিলিপিন্সে ৩০০ অর্থনৈতিক অঞ্চল রয়েছে সেখানে বাংলাদেশে কার্যকর রয়েছে মাত্র ৩টি এক্সপোর্ট প্রসেসিং জোন (অর্থনৈতিক অঞ্চল নয়)। কাজেই অর্থনৈতিক অঞ্চল তৈরি করে কাক্সিক্ষত কর্মসংস্থান তৈরির ব্যাপক সুযোগ রয়েছে।
×