ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

কফিনে পড়ল জুতো, ফাটল বোমা, এর মধ্যে কুখ্যাত গোলামের জানাজা

প্রকাশিত: ০৪:২৮, ২৬ অক্টোবর ২০১৪

কফিনে পড়ল জুতো, ফাটল বোমা, এর মধ্যে কুখ্যাত গোলামের জানাজা

স্টাফ রিপোর্টার ॥ মহান স্বাধীনতাযুদ্ধে নরঘাতকদের শিরোমণি কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধী জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমির গোলাম আযমের কফিনে জুতো নিক্ষেপের ঘটনা ঘটেছে। প্রায় তেত্রিশ বছর আগে আরও একবার এই মসজিদেই জুতোপেটার শিকার হয়েছিল নরঘাতক গোলাম আযম। নামাজে জানাজার জন্য জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের পশ্চিম পাশে আপন জুয়েলার্সের সামনে কফিন নামানো হলে একাধিক জুতো নিক্ষেপের ঘটনা ঘটে। এ নিয়ে ব্যাপক হইচই হয়। এবার শুধু কফিনে জুতো মারাই নয়, জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের মতো পবিত্র স্থানে পাকিস্তানী হানাদারদের প্রধান দোসর গোলাম আযমের জানাজার প্রতিবাদে বোমা বিস্ফোরণের ঘটনাও ঘটেছে। শেষ পর্যন্ত কড়া প্রতিবাদ আর প্রতিরোধের মুখে জাতীয় মসজিদের উত্তর গেটে যানবাহন রাখার স্থান হিসেবে ব্যবহৃত সাধারণ জায়গায় কফিন রেখে জানাজা করা হয় নরঘাতক গোলাম আযমের। জানাজায় শত শত লোকের সমাগম ঘটেছিল। এর মধ্যে উৎসুক মানুষের পরিমাণও ছিল অনেক। তারা বায়তুল মোকাররমের আশপাশের বিভিন্ন জায়গা থেকে জানাজা নিয়ে কী হয়Ñতাই দেখার জন্য এসেছিলেন। জানাজায় অংশ নেয়াদের অধিকাংশই ঢাকা, ঢাকার আশপাশ এলাকা মানিকগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, সাভার, কেরানীগঞ্জ, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ ছাড়াও চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন জেলা ও উপজেলা থেকে গাড়ি দিয়ে আনানো হয়েছিল। গোলাম আযমের জানাজা উপলক্ষে ব্যাপক লোক সমাগম ঘটিয়ে জামায়াত-শিবিরের বড় ধরনের শোডাউন করার উদ্দেশ্য ছিল। প্রসঙ্গত, মহান স্বাধীনতাযুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধে ৯০ বছর কারাদ- হয় কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমের। সাজা ভোগকালেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রিজনসেলে গত বৃহস্পতিবার রাতে তার মৃত্যু হয়। ৮৯ বছর কারাভোগ বাকি থাকতেই মৃত্যু হয় ৯২ বছর বয়সী গোলাম আযমের। মুক্তিযুদ্ধকালে জামায়াতে ইসলামীর আমির হিসেবে গোলাম আযম বাংলাদেশের স্বাধীনতাবিরোধীদের নেতৃত্ব দিয়েছিল। শনিবার জোহর নামাজের পর জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের উত্তর গেটে গোলাম আযমের জানাজা অনুষ্ঠিত হওয়ার ঘোষণা দেয় তার পরিবার। শনিবার সকাল ১০টা থেকেই অনাকাক্সিক্ষত পরিস্থিতি এড়াতে বায়তুল মোকাররমসহ আশপাশের এলাকায় নিরাপত্তা জোরদার করা হয়। বায়তুল মোকাররমের উত্তর ও দক্ষিণ গেট, পুরানা পল্টন, দৈনিক বাংলা, আশপাশের প্রতিটি গলি, বড় মগবাজার, বঙ্গবন্ধু এ্যাভিনিউসহ পুরো এলাকায় মোতায়েন করা হয় অতিরিক্ত পুলিশ ও র‌্যাব। বায়তুল মোকাররমের চারদিকে বসানো হয় একাধিক জলকামান ও এপিসি (আর্মার পার্সোনাল ক্যারিয়ার)। পুলিশের মতিঝিল বিভাগের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার আনোয়ার হোসেন জনকণ্ঠকে বলেন, শুধু তিন শতাধিক পুলিশই মোতায়েন রয়েছে। এর বাইরে র‌্যাব, ডিবি, এসবিসহ অন্যান্য গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরাও রয়েছে। যেকোন ধরনের অনাকাক্সিক্ষত পরিস্থিতি মোকাবেলায় র‌্যাব সব সময় প্রস্তুত ছিল বলে জানিয়েছেন র‌্যাবের লিগ্যাল এ্যান্ড মিডিয়া বিভাগের পরিচালক কমান্ডার মুফতি মাহমুদ খান। সকাল থেকেই দলে দলে আওয়ামী লীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ, মহিলা আওয়ামী লীগ, মুক্তিযুদ্ধ প্রজন্ম লীগ, আমরা মুক্তিযোদ্ধার সন্তান, গণজাগরণ মঞ্চ, অনলাইন ব্লগার এ্যাক্টিভিস্ট ফোরামসহ স্বাধীনতাযুদ্ধের পক্ষের লোকজন বায়তুল মোকাররমের আশপাশের এলাকা, বঙ্গবন্ধু এ্যাভিনিউ আওয়ামী লীগের কেন্দ্র্রীয় কার্যালয়ের সামনে অবস্থান নিতে থাকেন। তাঁরা কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমের জানাজা জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের মতো পবিত্র জায়গায় না করার প্রতিবাদে সেøাগান দেন। এ অবস্থায় দুপুর পৌনে ১২টার দিকে বায়তুল মোকাররমের উত্তর গেটে পর পর ৭টি ককটেলের বিক্ষোরণ ঘটে। পুরো এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। অতিরিক্ত পুলিশ সেখানে হাজির হলে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়। পুলিশ পুরানা পল্টন মোড় থেকে দৈনিক বাংলা পর্যন্ত রাস্তা বন্ধ করে দেয়। আর জিরো পয়েন্ট ও বায়তুল মোকাররমের দক্ষিণ গেটসহ আশপাশের এলাকায় নিরাপত্তা জোরদার করা হয়। দুপুর ১টায় সাদা রংয়ের আলিফ মেডিক্যাল সার্ভিসের একটি ছোট শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত লাশবাহী গাড়িতে গোলাম আযমের কফিন পৌঁছে বায়তুল মোকাররমের পশ্চিম পার্শে মার্কেটের সামনে। লাশবাহী গাড়ির আগে পিছে দুইটি দেড় টন ওজন ধারণক্ষম ট্রাক আর দুইটি পিকআপ, একটি এ্যাম্বুলেন্স আর তিনটি প্রাইভেটকার ছিল। কফিন নামানো হয় তিনতলা বায়তুল মোকাররম মার্কেটের নিচতলায় অবস্থিত স্বর্ণের গহনার দোকান আপন জুয়েলার্সের সামনে। কফিন ভেতরে নেয়ার জন্য গেটের তালা খোলা হচ্ছিল। এ সময় সেখানে রীতিমতো ভিড় জমে যায়। এমন অবস্থার মধ্যেই আচমকা গোলাম আযমকে গালিগালাজ করে কয়েক প্রতিবাদী একাধিক জুতো নিক্ষেপ করে। প্রসঙ্গত, মহান স্বাধীনতাবিরোধীদের প্রতি ঘৃণার প্রকাশ হিসেবে ১৯৮১ সালের ১ জানুয়ারি বায়তুল মোকাররম মসজিদের সামনে এক জানাজায় অংশ নিতে গেলে গোলাম আযমকে জুতোপেটার ঘটনা ঘটেছিল। জুতো নিক্ষেপের ঘটনায় ব্যাপক হইচই শুরু হয়। জুতো নিক্ষেপকারীরা দ্রুত ভিড়ে মিশে যান। পুলিশ দ্রুত সেখানে গেলে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে যায়। এমন পরিস্থিতিতে দ্রুত গেটের তালা খুলে লাশের কফিন ঢুকিয়ে ফেলা হয়। কফিন রাখা হয় বায়তুল মোকাররম মসজিদের উত্তর গেটের সিঁড়ির গোড়ায় ইসলামিক ফাউন্ডেশনের সামনে গাড়ি রাখার জায়গায়। ততক্ষণে যোহরের নামাজের আজান হয়ে যায়। যথারীতি নামাজ শেষ হয়। দুপুর পৌনে ২টায় জানাজা শুরুর আগে গোলাম আযমের চতুর্থ ছেলে আব্দুল্লাহিল আমান আল আযমী তাঁর বক্তব্যে দাবি করেন, তাঁর পিতা ক্ষণজন্মা পুরুষ ছিলেন। গোলাম আযমকে ভাষাসৈনিক উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, তাঁর পিতার জানাজায় শুধু দেশের বিভিন্ন জেলা নয়, প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকেও মানুষ এসেছেন। তাঁর পিতাকে মিথ্যা মামলায় সরকার সাজা দিয়েছিল। এত দিন মানবেতরভাবে তাঁর পিতাকে জেলে থাকতে হয়েছে। গোলাম আযমের মৃত্যু মানেই ইসলামী আদর্শের মৃত্যু নয়। ব্যক্তি গোলাম আযমকে ভাল না বাসলেও তাঁর আদর্শকে ভালবাসতে হবে। এ দেশে তাঁর পিতার আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে লাখ লাখ গোলাম আযমের জন্ম হবে। তিনি আরও বলেন, তাঁর পিতা খুবই সাধারণ জীবনযাপন করতেন। জ্ঞানত তিনি কোন অপরাধ করেননি। তারপরও তিনি যদি কোন অন্যায় করে থাকেন এ জন্য তিনি তাঁর পিতার হয়ে ক্ষমা চাইছেন। তিনিই পিতার জানাজা নামাজের ইমামতি করেন। জানাজা শেষে কফিন নিয়ে লাশবাহী গাড়িটি বড় মগবাজারের উদ্দেশে রওনা হয়। এবার যাতে জুতো নিক্ষেপের ঘটনার পুনরাবৃত্তি না হয় এ জন্য জামায়াত-শিবিরের লোকজন রাস্তায় সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে যান। তাঁরা গাড়ি যাতায়াতের জায়গা রেখে পুরো রাস্তা বন্ধ করে দেন। গাড়িটি দুপুর সোয়া ৩টায় বড় মগবাজার কাজী অফিস গলিতে গোলাম আযমের বাড়িতে পৌঁছে। বিকেল সাড়ে ৩টায় গোলাম আযমের মুখ শেষবারের মতো দেখার জন্য কিছু সময় খুলে রাখা হয়। এরপর দ্বিতীয় দফায় জানাজা না করেই বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে গোলাম আযমকে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়। জানাজায় অংশ নেয়া মুসল্লিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মুসল্লিদের প্রায় শতভাগই জামায়াত-শিবির নেতাকর্মী। এদের অনেককেই বিভিন্ন জেলা থেকে গাড়ি ভাড়া করে আনা হয়েছে। নুরুল হুদা নামে এক যুবক বলেছেন, তিনি ফেনীর দাগনভূঁঞা থেকে এসেছেন। গোলাম আযমের জানাজায় অংশ নেয়ার পাশাপাশি জানাজা উপলক্ষে বড় ধরনের শোডাউন করতেই তাঁর মতো অনেকেই দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে এসেছেন। জামায়াতের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের তরফ থেকেও এমন নির্দেশই রয়েছে। শুধু ফেনী নয়, রাজধানীর প্রতিটি ইউনিট ছাড়াও ঢাকার আশপাশের সাভার, কেরানীগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, টাঙ্গাইলসহ দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে লোকজন এসেছে বলেও দাবি করেন তিনি। গোলাম আযমের বাড়িতে যাওয়ার পথে কথা হয় অনেকের সঙ্গেই। কক্সবাজার থেকে এসেছেন আব্দুস সালাম (৪৩)। তিনি বলছেন, গোলাম আযমের মৃত্যু হয়েছে। তার জানাজায় আসতে দলের তরফ থেকে বলার পাশাপাশি আমাদেরও দায়িত্ব ও কর্তব্য রয়েছে। দলের তরফ থেকেও প্রয়োজনীয় সহযোগিতা করা হয়েছে। ধানম-ি থেকে এসেছেন তরিকুল ইসলাম (৪৫)। তিনি বলেছেন, শুধু ঢাকা নয়, সারাদেশ থেকেই তাদের লোকজন আনা হয়েছে। গোলাম আযমের জানাজা উপলক্ষে জামায়াত-শিবির আবার নিজেদের অস্তিত্বের প্রমাণ দিয়েছে। জানাজায় অংশ নেয়া অনেকের সঙ্গেই কথা বলে জানা গেছে, জানাজায় অংশ নেয়া প্রায় সবাই জামায়াত-শিবির নেতাকর্মী। দলের নির্দেশে তাদের অধিকাংশই ঢাকা, ঢাকার আশপাশ ও দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে এসেছেন। তাঁদের অনেকেই গোলাম আযমের বাড়ি ও জামায়াতের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ও চেনেন না বলে দাবি করেছেন।
×