ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৩ জুলাই ২০২৫, ৭ শ্রাবণ ১৪৩২

জুলাই আন্দোলনে শহীদ বিপ্লব হাসনের পিতা বাবুল মিয়া

ছেলে দেশের জন্যে জীবন দিলেও পুলিশের চাপে শান্তিপূর্ণ জানাযাও দিতে পারি নাই

শেখ আব্দুল আওয়াল, গফরগাঁও, ময়মনসিংহ

প্রকাশিত: ১৯:০৯, ২২ জুলাই ২০২৫; আপডেট: ১৯:১০, ২২ জুলাই ২০২৫

ছেলে দেশের জন্যে জীবন দিলেও পুলিশের চাপে শান্তিপূর্ণ জানাযাও দিতে পারি নাই

ছবি: সংগৃহীত

ময়মনসিংহের গৌরীপুরে ২০২৪ সালের ২০ জুলাই অনুষ্ঠিত গণঅভ্যুত্থান মিছিলে পুলিশের গুলিতে শহীদ হন এসএসসি পরীক্ষার্থী বিপ্লব হাসান (১৭)। এক বছর পরেও হত্যাকাণ্ডের বিচার না হওয়ায় ক্ষোভ, বেদনা আর আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন তার পরিবার।

ছেলের কবর বাড়ির পাশেই হলেও জানাযা পড়াতে পারেননি শান্তিতে—এভাবেই নিজের অসহায়ত্বের কথা বলছিলেন বিপ্লবের বাবা বাবুল মিয়া। চোখের পানি মুছতে মুছতে তিনি বলেন, "ছেলের জানাযার পর প্রতিদিনই পুলিশ বাড়িতে আসতো। ভয় পেয়ে আমি ঘর ছেড়ে বাইরে থাকতাম। হাসিনার সরকার না গেলে মনে হয় ছেলের প্রতিবাদের অপরাধে আমাকেও জেলে পচতে হতো।"

বাবুল মিয়া জানান, তার তিন সন্তানের মধ্যে বিপ্লব একমাত্র ছেলে এবং বড় সন্তান। সে গৌরীপুরের হাজী মোজাফফর আলী ফকির উচ্চ বিদ্যালয়ের এসএসসি পরীক্ষার্থী ছিল। ঘটনার দিন সকালে মা বিলকিস আক্তারের কাছ থেকে মাত্র ৫০ টাকা নিয়ে নাস্তা খাওয়ার অজুহাতে বাড়ি থেকে বের হয় বিপ্লব। এরপর যোগ দেয় পূর্বঘোষিত ছাত্রজনতার মিছিলে।

শোকাহত মা বিলকিস আক্তার বলেন, “আমি এখনো রাতে ঘুমাতে পারি না। বারবার মনে হয়, বিপ্লব এসে ডাকছে—‘মা, আমাকে নাস্তার টাকা দাও।’ ঘরে তার পায়ের শব্দ শুনি, কোনো শব্দ শুনলেই আমি চমকে উঠি। আমার বুকের ধন আজ কবরের নিচে।”

বিপ্লবের এক সহযোদ্ধা, ছাত্রদল নেতা বাহালুল মুনশি বলেন, “পুলিশের গুলি শেষ হলে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা নতুন গুলি এনে দেয়। এরপর পুলিশের সাথে মিলে ছাত্রদের ওপর নির্বিচারে গুলি চালায়। আমার সামনেই গুলিবিদ্ধ হয় বিপ্লব।”

তিনি আরও জানান, গুলিবিদ্ধ হয়ে বিপ্লব ডেলটা মিল সংলগ্ন সড়কে পড়ে গেলে এসআই শফিকুল ইসলাম এগিয়ে গিয়ে তার মাথায় পরপর আরও দুটি গুলি করেন।

“একটি গুলি বিপ্লবের মাথা ফুঁড়ে বেরিয়ে যায়। এরপর এসআই শফিক দম্ভভরে বলেন, ‘এবার লাশ নিয়ে যা।’ ”

বিপ্লব ছাত্রদলের সক্রিয় কর্মী ছিলেন বলে জানান আরেক নেতা বিল্লাল মিয়া। তিনি বলেন, “উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সোমনাথ সাহার নেতৃত্বে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা পুলিশের সাথে মিলে হামলায় অংশ নেয়। ফলে পুলিশ আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠে।”

ঘটনার পর শহীদ বিপ্লবের বাবা বাবুল মিয়া বাদী হয়ে গৌরীপুর থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন (মামলার তারিখ: ৪ এপ্রিল ২০২৫)। মামলায় প্রধান আসামি করা হয় তৎকালীন এসআই শফিকুল ইসলামকে, এবং দ্বিতীয় আসামি তৎকালীন ওসি সুমন চন্দ্র রায়কে।

মামলায় নাম এসেছে আরও অনেক আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীদের, তাদের মধ্যে রয়েছেন—উপজেলা আ.লীগের সাধারণ সম্পাদক সোমনাথ সাহা, ডৌহাখলা ইউনিয়নের আ.লীগ সাধারণ সম্পাদক শহিদুল হক সরকার, পৌর আ.লীগ সভাপতি সৈয়দ রফিকুল ইসলাম, যুবলীগ সভাপতি মেহেদী হাসান মিথুন, সাবেক ছাত্রলীগ নেতা নাজমুল হক শুভ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ সাধারণ সম্পাদক তানজীর আহম্মেদ রাজিবসহ অন্যান্য ১৫০ জন অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তি।

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ডিবির এসআই আলমগীর হোসেন শরীফ জানান, এখন পর্যন্ত চারজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। কিন্তু প্রধান আসামিরা এখনো পলাতক। জেলা ডিবি পুলিশের ওসি মহিদুল ইসলাম জানান, “অত্যাধুনিক প্রযুক্তির সহায়তায় পলাতকদের অবস্থান শনাক্ত করার চেষ্টা চলছে।”

সেদিনের মিছিলে গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হন আরও দুই তরুণ—নূরে আলম রাকিব (২২), দামগাঁও মধ্যপাড়া, জুবায়ের আহমেদ (২২), কাউরাট, মইলাকান্দা ইউনিয়ন।

আহত হন আরও অনেক—ছাত্রদল নেতা বাহালুল মুন্সি, মনিরুজ্জামান, যুবদল নেতা রাইসুল আহমেদ, কলেজছাত্র মাজহারুল ইসলাম, স্বেচ্ছাসেবক দলের মঞ্জুরুলসহ অনেকে।

শহীদ বিপ্লবের পরিবারকে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ২ লাখ টাকা অর্থ সহায়তা দিয়েছে বলে জানান বাবুল মিয়া। সরকারের পক্ষ থেকে ১০ লাখ টাকার একটি সঞ্চয়পত্রও দেওয়া হয়েছে। সম্প্রতি আরও একটি সঞ্চয়পত্রের চিঠি পেলেও তার পরিমাণ এখনো জানেন না।

শহীদ বাবার শুধু একটাই প্রত্যাশা—“আমার ছেলেকে যেভাবে মেরে ফেলা হলো, যারা এটা করেছে তারা যেন কোনোভাবেই পার না পায়।”

আসিফ

×