ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৩ জুলাই ২০২৫, ৭ শ্রাবণ ১৪৩২

মা যাদের বাঁচিয়ে নিজের জীবন উৎসর্গ করেছেন তারাও আমাদের ছোট ভাইবোন

তাহমিন হক ববী, নীলফামারী

প্রকাশিত: ১৮:৫৮, ২২ জুলাই ২০২৫

মা যাদের বাঁচিয়ে নিজের জীবন উৎসর্গ করেছেন তারাও আমাদের ছোট ভাইবোন

মা যাদের বাঁচিয়ে নিজের জীবন উৎসর্গ করেছেন, তারাও আমাদের ছোট ভাইবোন। মা আমাদের অনেক শিক্ষা দিয়ে গেলেন। মানবতা কাকে বলে, শিখিয়ে ও দেখিয়ে দিয়ে পৃথিবী ছেড়ে চলে গেলেন। কান্না জড়িত কণ্ঠে একথা বলেন নিহত সাহসী শিক্ষিকা মাহেরিন চৌধুরীর দুই সন্তান আয়ান রহীদ মিয়াদ চৌধুরী ও আদিল রহীদ মাহিব চৌধুরী।

মঙ্গলবার (২২ জুলাই) বিকাল ৪টায় নীলফামারীর জলঢাকা পৌরসভার ৩ নম্বর ওয়ার্ডের চৌধুরীপাড়াস্থ বগুলাগাড়ী স্কুল অ্যান্ড কলেজ মাঠে জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে মায়ের দাফন শেষে কথা বলার সময় জনকণ্ঠের এ প্রতিবেদককে দুই ভাই এসব কথা বলছিলেন।

মাহেরিনের বড় ছেলে আয়ান রহীদ মিয়াদ চৌধুরী ‘ও’ লেভেল শেষ করেছেন। তিনি বলেন, মা চাইলে নিজের জীবন বাঁচিয়ে পালাতে পারতেন। কিন্তু তিনি ছিলেন শিক্ষক। শুধু পাঠদানে নয়, প্রাণ দিয়ে আদর্শ রচনা করে গেলেন। অগ্নিদগ্ধ হয়েও একে একে করে আমরা ছোট ভাইবোনদের বাঁচিয়েছেন।

ছোট ছেলে আদিল রহীদ মাহিব চৌধুরী নবম শ্রেণির ছাত্র। তিনি বলেন, আমরা গর্বিত, আমাদের মা নিজের জীবনের কথা চিন্তা না করে, আমাদের কথা চিন্তা না করে, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নিজের শিক্ষক হওয়ার দায়িত্ব পালন করেছেন। আমাদের মা একজন আসল যোদ্ধা। আমাদের দুই ভাইয়ের মতো আরও ২০ জন ছেলেমেয়েকে মা রক্ষা করতে পেরেছেন। মা আমাদের মরে গিয়েও একজন শিক্ষক হিসেবে অনেক কিছু শিখিয়ে দিয়ে গেলেন। আমাদের মায়ের জন্য দেশবাসীর কাছে দোয়া চেয়ে দুই ভাই বলেন, মহান সৃষ্টিকর্তা যেন মাকে জান্নাতুল ফেরদৌস দান করেন।

রাজধানীর উত্তরায় সোমবার (২১ জুলাই) বিমানবাহিনীর একটি প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্ত হয়ে স্কুল ভবনে আগুন ধরে গেলে শিক্ষার্থীদের বাঁচাতে গিয়ে দগ্ধ হন মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের সাহসী শিক্ষিকা মাহেরিন চৌধুরী। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে প্রথমে একাধিক শিক্ষার্থীকে উদ্ধার করেন তিনি। কিন্তু পরে আবার কয়েকজন শিক্ষার্থীকে বাঁচাতে ভেতরে ঢোকার পর নিজেই আগুনে পুড়ে যান। আইসিইউতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় সোমবার রাতেই মারা যান তিনি।

দাফন শেষে জনকণ্ঠের এ প্রতিনিধির সঙ্গে কথা বলার সময় কান্না জড়িত কণ্ঠে মরহুম শিক্ষিকার স্বামী মনসুর আলী হেলাল বলেন, শেষ রাতে হাসপাতালে ওর সঙ্গে আমার শেষ দেখা। আইসিইউতে শুয়ে শুয়ে ও আমার হাত নিজের বুকের সঙ্গে চেপে ধরেছিল। বলেছিল, আমার সঙ্গে আর দেখা হবে না। আমি ওর হাত ধরতে গিয়েছিলাম, কিন্তু শরীরটা এমনভাবে পুড়ে গিয়েছিল যে ঠিকভাবে ধরতেও পারিনি।

তিনি আরও বলেন, আমি ওকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, তুমি তোমার নিজের দুই সন্তানের কথা একবারও ভাবলে না? সে বলল, ‘ওরাও তো আমার সন্তান। ওদের একা রেখে আমি কী করে চলে আসি?’ আমার বাচ্চারা চোখের সামনে পুড়ে মরছিল, আমি কী করে চুপ করে থাকি? যাদের বাঁচিয়েছি, তারাও তো আমারই সন্তান। আমি আমার সবকিছু দিয়ে চেষ্টা করেছি ওকে বাঁচাতে, কিন্তু পারিনি। আমার দুইটা ছোট ছোট বাচ্চা এতিম হয়ে গেল। তুমি তাদের দেখে রাখিও।

মনসুর হেলাল আরো বলেন, ও অনেক ভালো মানুষ ছিল। আমার স্ত্রী ওর ভেতরে একটা মায়া ছিল সবাইকে ঘিরে। আগুন লাগার পর যখন অন্যরা দৌড়াচ্ছিল, সে তখন বাচ্চাদের বের করে আনছিল। কয়েকজনকে বের করার পর আবার ফিরে গিয়েছিল বাকি বাচ্চাদের জন্য। সেখানেই আটকে পড়ে, সেখানেই পুড়ে যায়। মাহেরিনার স্বামী পেশায় একজন কম্পিউটার প্রকৌশলী।

মাহেরিন চৌধুরী শিক্ষকতার চাকরি জীবনে সবচেয়ে বেশি সময় পার করেছেন নীলফামারীর জলঢাকায়। এরপর চলে যান ঢাকায়। সেখানে যোগ দেন উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে। সেখানে তিনি স্কুলের বাংলা ভার্সনের কো-অর্ডিনেটর (৩য় থেকে ৫ম শ্রেণি) শিক্ষক ছিলেন। পরিবার নিয়ে ঢাকার উত্তরার একটি বাসায় বসবাস করতেন। মাহেরিন চৌধুরীর দুই ছেলে পড়াশোনা করছে মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে। বড় ছেলে আয়ান রহীদ মিয়াদ চৌধুরী সদ্য এসএসসি পাস করেছে ও ছোট ছেলে আদিল রহীদ মাহিব চৌধুরী নবম শ্রেণিতে পড়ছে। স্বামী মনসুর আলী হেলাল কম্পিউটার প্রকৌশলী। দুই বোন দুই ভাইয়ের মধ্যে মাহেরিন হচ্ছেন বড়।

তার বাবা মরহুম মহিতুর রহমান চৌধুরী ছিলেন শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের আপন খালাতো ভাই। তার দাদি মরহুম রওশনারা বেগম ছিলেন জিয়াউর রহমানের মাতা মরহুম জাহানারা খাতুনের আপন বোন।

প্রসঙ্গত, সোমবার (২১ জুলাই) রাজধানীর উত্তরায় বিমানবাহিনীর একটি প্রশিক্ষণ বিমান মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের স্কুল ভবনে বিধ্বস্ত হয়। এতে ভবনটিতে আগুন ধরে যায়। এ সময় ওই ভবনে ক্লাস করছিলেন শিক্ষার্থীরা। তাদের মধ্যে অন্তত ২০ জনকে আগুন থেকে উদ্ধার করেন মাহেরিন চৌধুরী।

আফরোজা

×