ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ২১ জুলাই ২০২৫, ৫ শ্রাবণ ১৪৩২

‎ ‎পোনা’র স্বাদে সর্বনাশ! 

‎এস এম নাহিদ হাসান, কন্ট্রিবিউটিং রিপোর্টার,  ‎ফরিদপুর, পাবনা

প্রকাশিত: ০১:০০, ২১ জুলাই ২০২৫

‎ ‎পোনা’র স্বাদে সর্বনাশ! 

‎'পোনা' ‎শব্দটি শুনলেই চকচক করে ওঠে অনেকের চোখ! কারো কারো তো আবার জিভে গড়ায় জল! মাছের ছোট বাচ্চাগুলোকে পোনা বললেও আঞ্চলিক প্রেক্ষাপটে টাকি বা শোল মাছের বাচ্চা গুলোকেই 'পোনা' বলে বোঝানো হয়। পেঁয়াজ, মরিচ আর সামান্য মসলায় ভুনা 'পোনা' অত্যন্ত সুস্বাদু ও প্রায় সবার কাছেই সামাদৃত। কিন্তু রসনা বিলাসের পেছনে চলছে এক নীরব ধ্বংস। পাবনার ফরিদপুর উপজেলায় ব্যাপকভাবে শিকার করা হচ্ছে টাকি মাছের পোনা, যা পরিবেশ ও মৎস্যসম্পদের জন্য হুমকিস্বরূপ।

‎ফরিদপুর উপজেলার খাল-বিল, নদী-নালা ও জলাশয়ে এখন প্রতিনিয়ত ধরা হচ্ছে টাকি মাছের ‘পোনা’। চাহিদা এবং দাম দুটোই বেশি থাকায়, শুধু জেলেই নয়, কৃষক, দিনমজুর এমনকি শিক্ষার্থীরাও এই মাছ শিকারে জড়িয়ে পড়ছে।

‎উপজেলার পুরন্দরপুর গ্রামের এক কৃষক নাম গোপন রেখে বলেন, “এই সময়ে চাষাবাদের কাজ কম থাকে। তাই পোনা মাছ ধরে বিক্রি করি। চাহিদাও বেশি, দামও ভালো পাই।” তবে তিনি স্বীকার করেন, “এই মাছ থাকলে পরে বড় হতো। কিন্তু বিকল্প আয়ের সুযোগ না থাকায় বাধ্য হয়ে ধরতে হয়।”

‎সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, উপজেলার মাছ বাজার থেকে শুরু করে গ্রামাঞ্চলের স্থায়ী ও অস্থায়ী ছোট ছোট বাজারেও প্রায়ই পোনা বিক্রি হচ্ছে। এমনকি অনেক ক্ষেত্রেই ক্রেতারা আগেই মাছ শিকারিদের বলে রাখছেন, যেন তারা মাছ ধরার পর সরাসরি তাদের কাছে নিয়ে আসেন। ভালো দাম পাওয়ায় এই পদ্ধতিই হয়ে উঠেছে প্রচলিত ও জনপ্রিয়। ফলে বাজারে নজরদারি করলেও পোনা নিধন বন্ধ করা যাচ্ছে না। 

‎জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের (ফিশারিজ) সাবেক শিক্ষার্থী মোঃ লতিফুর রহমান খান বলেন, “এক সময় দেশীয় খাল-বিলে প্রচুর মাছ পাওয়া যেত। এখন তা স্মৃতিমাত্র। রেণু ও পোনা মাছ ধরা আমিষ সংকটের অন্যতম কারণ। বিশেষ করে টাকি, শোল, গজার মাছ—যাদের প্রজনন ক্ষমতা বেশি, এখন তা হারিয়ে যাচ্ছে।”

‎এ ব্যাপারে সিনিয়র উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা সুজিত কুমার মুন্সী জানান, "উন্মুক্ত জলাশয়ে শুধু টাকি মাছ নয়, যেকোনো প্রকার দেশি মাছের পোনা ও ডিমওয়ালা মাছ নিধন নিষিদ্ধ ও শাস্তিযোগ্য অপরাধ। মা মাছ ও পোনা রক্ষার জন্য আমরা প্রচলিত আইন মোতাবেক ব্যাপক সচেতনতামূলক প্রচার প্রচারণা চালিয়ে থাকি এবং উপজেলা প্রশাসনের সহায়তায় ভ্রাম্যমান আদালত পরিচালনা করে জরিমানা বা অন্যান্য আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করি।" এই অভিজ্ঞ মৎস্য কর্মকর্তা আরও যোগ করেন, "একটি মৌসুম পোনা শিকার থেকে বিরত থাকলে, দেশীয় মাছ উৎপাদন ১০ গুণ পর্যন্ত বাড়তে পারে।”  

‎তবে শুধু প্রশাসনের উদ্যোগে এই সমস্যা সমাধান করা সম্ভব নয় বলে মত দেন সচেতন নাগরিক সমাজ। তারা মন্তব্য করেন, মাছের পোনা সংরক্ষণের জন্য দরকার সর্বস্তরের জনগণের সচেতনতা এবং বিকল্প আয়ের সুযোগ সৃষ্টি। গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর জন্য টেকসই বিকল্প আয়ের উৎস না থাকলে তারা বারবারই মাছ ধরার মতো সহজ আয়ের পথ বেছে নিতে বাধ্য হবেন।

‎দেশি মাছের অস্তিত্ব রক্ষায় এখনই কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরি। তা না হলে 'পোনা' নামের এই স্বাদের লোভে বিপন্ন হতে পারে দেশের অমূল্য মৎসসম্পদ।

Jahan

×