
প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এক অপূর্ব নিদর্শন হয়ে আজও টিকে আছে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা উপজেলার গোপিনাথপুর ইউনিয়নের গোসাইস্থল পদ্মবিল। প্রায় ১৬ একর জুড়ে বিস্তৃত এই বিলে বর্ষা ও শরৎকালে ফুটে ওঠে নীল, সাদা ও হলুদ রঙের পদ্মফুল, যা চোখে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে যেকোনো দর্শনার্থীর হৃদয় ছুঁয়ে যায়। শুধু পদ্ম নয়, বিল জুড়ে শোভা পায় সাদা ও নীল শাপলাও, আর সেই সঙ্গে ডাহুক, বালিহাস, পানকৌড়ি, সারসসহ অসংখ্য জলচর পাখির কলকাকলিতে মুখর থাকে চারপাশ। প্রকৃতি যেন এখানে আপন হাতে এক স্বর্গ নির্মাণ করেছে। প্রতিদিন শত শত দর্শনার্থী পরিবার পরিজন নিয়ে নৌকা ভাড়া করে এই প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে আসছেন দূরদূরান্ত থেকে। তবে এই অপরূপ প্রাকৃতিক নিদর্শন আজ ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে।
প্রতি বছরই মৌসুমে অনিয়ন্ত্রিত পর্যটন, দর্শনার্থীদের অসচেতন আচরণ, এবং কর্তৃপক্ষের নজরদারির ঘাটতির কারণে গোসাইস্হল পদ্মবিল আজ বিপর্যয়ের মুখে। সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, অনেকেই নিয়ম তোয়াক্কা না করে নির্বিচারে পদ্মফুল ছিঁড়ে নিয়ে যাচ্ছেন। কেউ কেউ পানিতে নেমে গাছ উপড়ে দিচ্ছেন, ফুলের গোঁড়া ভেঙে দিচ্ছেন; যার ফলে পদ্মগাছের স্বাভাবিক বৃদ্ধিতে বিঘ্ন ঘটছে এবং বিলের প্রাকৃতিক ভারসাম্য মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। মাত্র ৮-১০টি নৌকা থাকায় পর্যটকদের কাছ থেকে অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের অভিযোগ উঠেছে, যা পর্যটন ব্যবস্থাপনায় নৈরাজ্যের দৃষ্টান্ত হয়ে দাঁড়িয়েছে।
স্থানীয় বাসিন্দারা বিষয়টি নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। বাড়াই গ্রামের আল-আমিন বলেন, এই বিলটা আমাদের গর্ব। প্রতিদিন শত শত মানুষ আসে, কিন্তু তারা ফুল ছিঁড়ে নিয়ে যায়, পানিতে নামে, গাছ ভেঙে ফেলে,দেখার কেউ নেই। এভাবে চলতে থাকলে আর কিছুদিন পর কিছুই থাকবে না। নোয়ামুড়া গ্রামের বাসিন্দা বাছির মিয়া বলেন, আমরা চাই বিলটা বাঁচুক। প্রশাসনের নজরদারি দরকার। নিয়ম না মানলে এই প্রাকৃতিক সৌন্দর্য একদিন হারিয়ে যাবে, তখন আমাদের সন্তানেরা শুধু গল্পেই পদ্মবিলের কথা জানবে। লক্ষীপুর গ্রামের দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী আশ্রাফুল বলেন, এই পদ্মবিলটি আমাদের গোপীনাথপুর তথা সমগ্র কসবা উপজেলার একটি রোমাঞ্ছকর পর্যটক স্থান,শুধুমাত্র নজরদারির জন্য পর্যটকরা ফুল ছিঁরে নিয়ে গিয়ে আমাদের এই অপার সৌন্দর্য্য এর ক্ষতিসাধন করছে। খিরনাল গ্রামের বাসিন্দা মেহেদী হাসান রায়হান বলেন, প্রতি বছরই প্রচুর পর্যটক আসে এই গোসাইস্থল পদ্মবিল দেখার জন্য,তবে অনেক পর্যটক ঘুরতে এসে পদ্মফুল ও তার পাতা ছিঁরে ফেলায় দিনকে দিন পদ্মবিলের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। প্রশাসনের উচিত দ্রুত সময়ের মধ্যে পদ্মবিলের সৌন্দর্য্য রক্ষায় কার্যকরী ভূমিকা রাখা।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো: ছামিউল ইসলাম জানান, গোসাইস্হল পদ্মবিল আমাদের এলাকার এক অসাধারণ প্রাকৃতিক সম্পদ। ইতিমধ্যে আমরা ফুল ছেঁড়াসহ যেকোনো অনিয়ম রোধে নিয়মিত নজরদারি শুরু করেছি। দর্শনার্থীদের সচেতন করতে নির্দেশনা বোর্ড বসানো হচ্ছে, স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবক নিয়োগ এবং নৌকা চলাচল নিয়ন্ত্রণে আনার কাজ চলছে। ইউএনও আরও জানান, প্রশাসন পদ্মবিল রক্ষায় আন্তরিক এবং তা টেকসইভাবে সংরক্ষণের লক্ষ্যে স্থানীয় জনগণকে সম্পৃক্ত করার পরিকল্পনা রয়েছে।
তবে বাস্তবতা হলো, প্রশাসনিক তৎপরতার পাশাপাশি দর্শনার্থীদের সচেতনতা এবং স্থানীয়দের দায়িত্ববোধ ছাড়া গোসাইস্হল পদ্মবিলকে রক্ষা করা কঠিন। এই বিল কেবল একটি জলাশয় নয়, এটি একটি বাস্তুতন্ত্র, একটি প্রাকৃতিক ঐতিহ্য, যা শুধু এ অঞ্চলের নয়; সমগ্র দেশের গর্ব। অনিয়ন্ত্রিত পর্যটন কিংবা মানবসৃষ্ট দখল দূষণের কারণে যদি এই প্রাকৃতিক সৌন্দর্য একদিন ধ্বংস হয়ে যায়, তবে তা হবে আমাদের সবার জন্য এক অপূরণীয় ক্ষতি। এখনই যদি প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা না নেওয়া হয়, তবে একদিন সত্যিই গল্পে পরিণত হবে গোসাইস্হলের পদ্মবিল। যেখানে এক সময় ফুটত হাজারো পদ্ম, ডাহুক ডাকত সকাল-বিকেল, আর প্রকৃতি হাসতো তার স্বভাবিক ছন্দে। তাই আসুন, আমরা সবাই মিলে এই বিলকে বাঁচাই। প্রকৃতিকে তার রূপে ফিরতে দিই, যেন আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মও এই অপরূপ সৌন্দর্যের সাক্ষী হতে পারে।
Jahan