ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ২১ জুলাই ২০২৫, ৫ শ্রাবণ ১৪৩২

হাফেজ বানাতে চেয়েছিলাম, লাশ হয়ে ফিরলো: ছাত্র রাব্বির প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতে বাবার কান্না

আরেফিন লিমন, কন্ট্রিবিউটিং রিপোটার, গলাচিপা, পটুয়াখালী

প্রকাশিত: ০০:৫২, ২১ জুলাই ২০২৫; আপডেট: ০০:৫৩, ২১ জুলাই ২০২৫

হাফেজ বানাতে চেয়েছিলাম, লাশ হয়ে ফিরলো: ছাত্র রাব্বির প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতে বাবার কান্না

ছবিঃ সংগৃহীত

“আমার ছেলেটাকে কোরআনের হাফেজ বানাতে চেয়েছিলাম, কোরআনের পাখি বানাতে চেয়েছিলাম। ও দশ পারা মুখস্থ করেছিল। এখন কেবল লাশের কবর দেখে কোরআন পড়ি।”— কথাগুলো বলতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন মো. জুয়েল সিকদার। ছেলের নাম উচ্চারণ করতেই চোখ ভিজে আসে বারবার।

১৯ জুলাই, মাদ্রাসাছাত্র মো. রাব্বি সিকদার (১৩) প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী। কোটা আন্দোলনের সময় ঢাকার মিরপুরে পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারানো এই কিশোর যেন পরিবারকে এক বছরের মধ্যে ফেলে গেছে গভীর শোকের অতলে।

 এক বছর আগে যা ঘটেছে 

২০২৪ সালের ১৯ জুলাই, শুক্রবার। ঢাকার মিরপুর মডেল ডিগ্রি কলেজ সংলগ্ন এলাকায় চলছিল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। নামাজ শেষে মাদ্রাসা থেকে বেরিয়ে রাব্বি মিছিল দেখতে গিয়েছিল। হঠাৎ করেই পুলিশের গুলিতে এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। অন্য শিক্ষার্থীরা দৌড়ে পালালেও রাব্বি একটি ভ্যানগাড়ির নিচে আশ্রয় নেয়। কিন্তু একটি গুলি তার বুক ভেদ করে পিঠ দিয়ে বেরিয়ে যায়। ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয় তার।


কে ছিল এই রাব্বি?

রাব্বির জন্ম ২০১০ সালের ৬ নভেম্বর, পটুয়াখালীর গলাচিপা উপজেলার কলাগাছিয়া ইউনিয়নের বাঁশবাড়িয়া গ্রামে। জীবিকার তাগিদে রাব্বির পরিবার ২০২১ সালে ঢাকায় পাড়ি জমায়। বাবা জুয়েল সিকদার মোজাইক-টাইলসের কাজ করেন, মা ফিরোজা বেগম গৃহিণী। তিন ভাই এক বোনের মধ্যে রাব্বি ছিল সবার ছোট। তাকে ভর্তি করা হয়েছিল মিরপুরের তা’লীমুল ইসলাম মাদ্রাসায়, হাফেজ বানানোর আশায়।

মৃত্যুর পর যা ঘটেছিল

রাব্বির মৃত্যুর পর ছাত্রজনতা তার লাশ উদ্ধার করে আজমল হাসপাতালে নিয়ে যায়। চিকিৎসক জানান, সে আগেই মারা গেছে। পরদিন ২০ জুলাই পরিবারের চাওয়া সত্ত্বেও স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাদের ভয়ভীতি ও রাজনৈতিক চাপে লাশ গ্রামের বাড়িতে নেওয়া সম্ভব হয়নি। নেতারা উল্টো রাব্বির বাবাকে বলছিল মিছিলে তোমার পোলা গেল কেন ? তোমার বিরদ্ধে মামলা হবে। শোকের মধ্যে শহীদ রাব্বির পরিবার ছিল আতংকে। বাধ্য হয়ে মিরপুর-১৩ নম্বর শিশু কবরস্থানে জানাজা ও দাফন সম্পন্ন করে দাফ করে। পরিবার জানায়, জানাজা ও দাফন খরচ বাবদ সাড়ে ৭ হাজার টাকা দিতে হয়েছিল তখন।

পরবর্তীতে ৫ আগস্টের পটপরিবর্তনের পরে পরিবারের পক্ষ থেকে দায়ের করা মামলার প্রেক্ষিতে ২০২৫ সালের ১০ জুলাই নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের উপস্থিতিতে লাশ উত্তোলন করা হয়। ১৩ এপ্রিল হিমাগার থেকে রাব্বির মৃতদেহ ময়নাতদন্ত সহ ডিএনএর নমুনা সংগ্রহ শেষে পরিবারের আবেদনের প্রেক্ষিতে মরদেহ গ্রামের বাড়িতে নিয়ে যায়। গত ১৪ এপ্রিল, সকাল ১১টার দিকে পটুয়াখালীর গলাচিপার বাঁশবাড়িয়ায় পারিবারিক কবরস্থানে জানাজা শেষে তাকে পুনরায় দাফন করা হয়।

বিচারের প্রত্যাশা

রাব্বির বাবা জুয়েল সিকদার জানান, ঘটনার সময় পুলিশ রাব্বির মরদেহ উদ্ধার করে নিয়ে যেতে চাইলেও স্থানীয় জনতা বাধায় নিয়ে যেতে পারেনি। রাব্বির মৃত্যুতে ঢাকার কাফরুল থানায় মামলা দায়ের করেন তারা। মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, ওবায়দুল কাদের, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালসহ ৩৩ জনের নাম উল্লেখ করা হয়। এছাড়া অজ্ঞাতনামা ২০০-৩০০ জনকেও আসামি করা হয়।

“আমি এর বিচার চাই”— মায়ের আর্তনাদ

রাব্বির মা ফিরোজা বেগম বলেন,
“আমার ছেলে রাজনীতি করেনি, কোনো অন্যায় করেনি। যদি কিছু করেও থাকত, একটা হাত-পা ভেঙে দিত, মেরে ফেলতে হলো কেন? আমি এর বিচার চাই, আল্লাহর কাছেও বিচার দেব।”

বাবা জুয়েল সিকদার বলেন, আজও আমার ছেলের রুমে ঢুকলে ওর গন্ধ পাই। ওর জামাগুলো দেখি, কিন্তু ও তো আর কোনোদিন কোরআনের আয়াত শুনাবে না। হাফেজ হওয়ার স্বপ্ন আর পূরণ হলো না।

ইমরান

×