
পরিকল্পনা উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদ উদ্দীন মাহমুদ
পার্বত্য চট্টগ্রামের জন্য পরিকল্পিত বিদেশি সাহায্য থাকবে না বলে জানিয়েছেন পরিকল্পনা উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদ উদ্দীন মাহমুদ। এক্ষেত্রে সেখানকার অধিবাসীদের জন্য সরকার বিভিন্ন প্রকল্প নিয়েছে বলে তিনি জানান।
রবিবার রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে সোসাইটি ফর এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট (সেড) আয়োজিত দিনব্যাপী কর্মশালায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এ কথা বলেন। এতে যৌথভাবে সহযোগিতা করেন ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও জার্মানভিত্তিক ক্যাথলিক ত্রাণ ও উন্নয়ন সংস্থা মিজেরিওর। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও পিপিআরসির নির্বাহী চেয়ারম্যান ড. হোসেন জিল্লুর রহমান।
পরিকল্পনা উপদেষ্টা বলেন, সরকার চমক সৃষ্টির জন্য কোনোকিছু করছে না। এই অল্প সময়ের মধ্যে যেখানে যা কিছু করতে পারছে করছে। আমরা বরং আরও অনেক কিছু করছি, যেটা কাউকে বলাও হয়নি, কিন্তু পরে দেখা যাবে। সাংবাদিকরা যদি অনুসন্ধানী হন তাহলে হয়তো প্রকাশ পাবে। পার্বত্য চট্টগ্রামের জন্য কিছুটা বৈদেশিক সাহায্য থাকতে পারে, কিন্তু বিদেশ থেকে পরিকল্পিতভাবে না। দুই-তিনটি প্রকল্প, যেগুলোকে আমি বলি আমব্রেলা প্রকল্প।
এসব পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে আমার কাছে এসেছে, সঙ্গে সঙ্গে অনুমোদন করে দিয়েছি। প্রান্তিক জনগোষ্ঠী এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের শহরগুলোর আশপাশে না, একেবারে গভীরে থাকে তাদের যে পানির সমস্যা, বাচ্চাদের স্কুল সমস্যা সেগুলোর সমাধানের জন্য বিশেষত এই প্রকল্পগুলো নেওয়া হয়েছে। দুর্গম এলাকায় আবাসিক স্কুল চালুর পরিকল্পনা আছে।
ওয়াহিদ উদ্দিন বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের জন্য যে প্রকল্প নেওয়া হয়েছে তার অর্ধেক নেওয়া হয়েছে তাদের জীবনমান উন্নয়নে। বাংলাদেশের বিভিন্ন বন অঞ্চলে যারা থাকেন তাদের কেবল বন সম্পদের ওপর নির্ভর করে টিকে থাকা যৌক্তিক নয় উল্লেখ করে উপদেষ্টা বলেন, এইভাবে তারা দারিদ্র্যসীমার নিচে রয়ে যাবে। বরং আরও আধুনিক পদ্ধতির কৃষি ও কৃষি উপকরণের মাধ্যমে তাদের জীবিকা নির্বাহ করতে হবে। সেটাতেই তাদের উপকার হবে।
আদিবাসী জনগোষ্ঠীর ভাষা ও সংস্কৃতির বৈচিত্র্য অক্ষুণœ রাখার ব্যাপারে দৃঢ় অবস্থান জানিয়ে তাদের শিক্ষা গ্রহণ ও বৃহত্তর অর্থনৈতিক কর্মকা-ে সম্পৃক্ত হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন পরিকল্পনা উপদেষ্টা। তিনি বলেন, এদের শিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে এবং ধাপে ধাপে কর্মসংস্থানের মাধ্যমে মূলধারায় যুক্ত করতে হবে।
আগের ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে এগোনোর তাগিদ দিয়ে পরিকল্পনা উপদেষ্টা বলেন, যে ভুলগুলো আমরা অতীতে করেছি এসব প্রকল্পের মাধ্যমে যেন সেগুলো আর না ঘটে সেদিকে বিশেষ নজর রাখা হবে। আগে বিদেশিদের পরামর্শে অনেক ভুল প্রকল্প নেয়া হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, বৈদেশিক অর্থায়নে দেশে অনেক অপরিকল্পিত বন প্রকল্প বাস্তবায়স হয়েছে।
তিনি বলেন, বাংলাদেশে দখলদারদের নানা ধরন দেখে বিশ্ব অবাক হতে পারে। এত ধরনের ‘ডাকাত’ (দখলদার) পৃথিবীর আর কোথাও নেই। নদী দখলদার, ভূমি দখলদার, বন দখলদার, পাহাড় দখলদার- সব রকমেরই আছে এখানে। এছাড়া বন বিনষ্ট না করে সেখান থেকে সম্পদ আহরণের কথাও বলেছেন তিনি। উপদেষ্টা বলেন, দেশের সামান্য পরিবেশগত সম্পদ সংরক্ষণ করা সরকারের জন্য কঠিন হয়ে পড়েছে। বন থেকে সম্পদ আহরণ অবশ্যই পরিকল্পিতভাবে হতে হবে।
সভাপতির বক্তব্যে ড. হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, আজকে যে আশা-আকাক্সক্ষার কথা শুনলাম এবং পরিকল্পনা উপদেষ্টার কাছ থেকে প্রতিশ্রুতির ঘোষণা পেলাম এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের বাংলাদেশের জন্য এখন বড় চ্যালেঞ্জ, যে আশা-আকাক্সক্ষা উচ্চারণ হচ্ছে তা অর্জন করা এবং মূল বিষয় হচ্ছে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা। বিভিন্ন কমিউনিটির অধিকার, প্রয়োজন ও চাহিদার সমস্যার সমাধান। তিনি বলেন, আজকে পাহাড়ি ও বনাঞ্চলের বিভিন্ন সম্প্রদায়ের যে সমস্যা এটা শুধু তাদের নয়, সমগ্র মানবজাতির সমস্যা। উন্নয়ন নিয়ে আমাদের যে বৈশ্বিক ধারণা সেখানেও ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করা খুবই জরুরি।
অনুষ্ঠানে পাহাড়ি নারীদের বিভিন্ন সমস্যার কথা তুলে ধরেন সিএইচটি হেডম্যান কার্বারী নেটওয়ার্কের সভাপতি জয়া ত্রিপুরা। তিনি বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে যখন বনায়ন শুরু হয় তখন নারীরা বেশি ভুক্তভোগী, বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। নারীদের সঙ্গে বনের একটা অঘোষিত আত্মিক সম্পর্ক রয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, প্রতিদিন নারীদের খাদ্য আহরণ থেকে শুরু করে জ্বালানি কাঠ, তরিতরকারি সংগ্রহের জন্য বনে যেতে হয়। সেখানে পুরুষের প্রবেশাধিকার থাকলেও এটাকে নারীদের দায়িত্ব মনে করে পুরুষরা যেতে চায় না। বন যখন ধ্বংস হয় তখন এ নারীদের কঠিন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়।
জয়া ত্রিপুরা বলেন, ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত নারীরা যে ক্লান্তিহীন পরিশ্রম করে তা এখনো সমাজ, পরিবার কর্তৃক অস্বীকৃত। ঘরের গৃহস্থালির কাজ থেকে শুরু করে সব কাজ যেমন ছেলেমেয়ে থেকে শুরু করে স্বামীর কাপড় চোপড়সহ বাড়ির পরিধেয় বস্ত্র ধৌতকরণ, রান্নাবান্না, সামাজিকতা, আপ্যায়ন ইত্যাদি। এসব কাজ করেও নারীরা মর্যাদা পান না। তবে খুশির বিষয় যে, বর্তমান সময়ে তুলনামূলকভাবে এর কিছুটা হ্রাস পেয়েছে। সহভাগিতা, সহমর্মিতা নিয়ে অনেক সমাজ এগিয়ে যাচ্ছে।
শিক্ষার অগ্রগতির কল্যাণে এ পরিবর্তনগুলো নারীর মর্যাদার জন্য অপরিহার্য। মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সেডর পরিচালক ফিলিপ গাইন। কর্মশালায় অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সদস্য প্রফেসর তানজীমউদ্দিন খান, ইউরোপীয় ইউনিয়নের হেড অব কো-অপারেশন মিহাল ক্রেজা, দি হাঙ্গার প্রজেক্টের কান্ট্রি ডিরেক্টর প্রশান্ত ত্রিপুরা, বন অধিদপ্তরের প্রধান বন সংরক্ষক (সিসিএফ) আমীর হোসাইন চৌধুরী, পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক কমিটির সভাপতি গৌতম দেওয়ান।
এ ছাড়াও বিভিন্ন পাহাড়ি বনাঞ্চলের বিভিন্ন কমিউনিটির পক্ষে বক্তব্য রাখেন পার্বত্য চট্টগ্রাম বন ও ভূমি আন্দোলনের বান্দরবান চ্যাপ্টারের চেয়ারপারসন জুয়াম লিয়ান আমলাই, জয়েনশাহী আদিবাসী উন্নয়ন পরিষদের সভাপতি ইউজিন নকরেক এবং বাংলাদেশ কোচ আদিবাসী মহিলা সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক আল্পনা সরকার প্রমুখ।