
মোহাম্মদ শামীম হাওলাদারের স্ত্রী রোকেয়া বেগম তিন সন্তান নিয়ে বাপের বাড়িতে দুঃসহ জীবন কাটাচ্ছেন
স্বপ্ন ছিল সন্তানদের মানুষ করবেন। বড় ছেলেকে হাফেজ বানিয়ে আল্লাহর পথে চালাবেন। ছোট ছেলেকে পড়ালেখা করিয়ে ইঞ্জিনিয়ার বানাবেন। সেই স্বপ্ন এখন শুধুই স্মৃতি। অবুঝ সন্তানরা বাবাকে আর বাবা বলে ডাকতে পারবে না। বলছিলাম গত বছরের ২০ জুলাই ঢাকায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে গুলিতে নিহত ভোলা সদর উপজেলার শহীদ শামীম হাওলাদারের কথা।
৩৫ বছর বয়সী শামীম ঢাকার মোহাম্মদপুরে ইলেকট্রিকের কাজ করতেন। সংসারে বৃদ্ধ মা, স্ত্রী, তিন সন্তান ও ভাই-বোন ছিল। সাত বছর আগে সড়ক দুর্ঘটনায় বাবাকে হারান। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ছিলেন তিনি। তার মৃত্যুতে পরিবারটি এখন দিশেহারা। মৃত্যুর এক বছর পার হলেও নিহতের স্ত্রীর চোখের অশ্রু থামেনি। কথা বলতে বলতেই কান্নাজড়িত কণ্ঠে বললেন, ‘জুলাই মাসের ৭ তারিখ, শেষবারের মতো বাড়ি থেকে তিনি ঢাকায় যান। ২০ তারিখ মোবাইলে স্ত্রী, সন্তান ও মায়ের সঙ্গে শেষ কথা হয়।
তাকে বাসা থেকে বের না হতে বলেন তারা। কিন্তু সকালে আন্দোলনে গিয়ে রাবার বুলেটে আহত হন তিনি। সেই বুলেটও তাকে থামাতে পারেনি। বিকেলে আবার বাসা থেকে বের হয়ে আন্দোলনে যোগ দেন। এবার গুলি এসে লাগে তার বুকে। লুটিয়ে পড়েন মাটিতে। স্বপ্নগুলো যেন ডানা মেলে উড়ে যায় দূর আকাশে।
শামীমের মৃত্যুতে ছেলেদের ভবিষ্যৎ কী হবে তা নিয়ে চরম দুশ্চিন্তায় দিন কাটাচ্ছেন স্ত্রী রোকেয়া বেগম আসমা। বলেন, শামীম ঢাকায় যাওয়ার আগে পুকুরে মাছ ছেড়ে রেখে গেছেন। মাছের খামার করে ব্যবসা করবেন। ঢাকায় এবারের কাজটি শেষ হলে আর যাবেন না। তিনি ঠিকই ফিরেছেন ঢাকা থেকে একেবারে লাশ হয়ে। তিন সন্তান নিয়ে শামীমের স্ত্রী এখন বাপের বাড়ি থাকেন। এ পর্যন্ত সরকার ও বিভিন্ন রাজনৈতিক দল থেকে কিছু সহায়তা পেয়েছেন, যা প্রয়োজনের তুলনায় একেবারে অপ্রতুল। কিভাবে সন্তানদের মানুষ করবেন ভেবে পাচ্ছেন না তিনি। পরিবারের আর্থিক সংকট মোকাবিলায় সরকারের কাছে সহায়তা ও দ্রুত হত্যার বিচারের জন্য দাবি জানান তিনি।
শামীম হাওলাদারের মতো ভোলা সদর উপজেলার ইলিশা ইউনিয়নের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের মো. মাকসুদুর রহমান ফরাজী ও মিনারা বেগম দম্পতির বড় ছেলে ১৭ বছরের টগবগে তরুণ মিরাজ ফরাজী ও তার চাচা গত বছর ৪ আগস্ট ঢাকার মিরপুর ১০ নম্বরে ছাত্র আন্দোলনে যান। চাচা ও ভাতিজা দুজনই গুলিবিদ্ধ হন। ঘটনাক্রমে চাচা বেঁচে গেলেও ভাতিজা মিরাজ শহীদ হন। নিহত মিরাজের বাবা মাকসুদ ঢাকার মিরপুর ৬ নম্বর রূপনগর থেকে দিনমজুরী করে জীবন চালান।
তিন ছেলের মধ্যে বড় ছেলে মিরাজকে ছোট বেলায় মাদ্রাসায় হেফজ পড়ানোর ইচ্ছে ছিল। ১০ পাড়া মুখস্থ করার পর সে আর মাদ্রাসায় যায়নি। পরে মিরপুর ইসলামিয়া হাইস্কুলে ভর্তি করে দেন। পড়ালেখার ফাঁকে অবসর সময়ে মিরাজ টাইলসের কাজ করে নিজের পকেট খরচ যোগাতেন।
গত ৪ আগস্ট সকাল ১০টার দিকে বাসা থেকে বের হয়ে যাওয়ার সময় তাকে ডেকে কাছে আনেন বাবা। ঘরের সামনের সিঁড়িতে বসে ছেলের সঙ্গে কথা বলেন। জিজ্ঞেস করলে মিরাজ বলে, আমি ট-ব্লকে আন্দোলনে যাই। তাকে যেতে নিষেধ করেন বাবা মাকসুদ। সে বলে, আমি আরও দুইদিন আন্দোলনে গিয়েছি। এ অবস্থায় বাবা বলেন, আগামীকাল আমরাসহ যাব। আজকে তোমার যাওয়ার দরকার নাই। ছেলেও রাজি হয়ে সেখান থেকে উঠে যায়। পরে জানতে পারেন মিরাজ সেখান থেকে চাচার দোকানে গিয়ে চা-নাস্তা করেছে।
পরে সেলুনে গিয়ে চুলও কাটিয়েছে। চুল কাটানোর পর তাদের স্কুলের শিক্ষক জলিল স্যারের সঙ্গে দেখা হলে তার সঙ্গেই রিক্সায় চড়ে মিরপুর-১০ নম্বরে যাওয়ার কিছুক্ষণ পর পুলিশের গুলির মধ্যে পড়ে যায় সে। এক পর্যায়ে তার বুকে পরপর দুটি গুলি লাগলে সে পাটিতে লুটিয়ে পড়ে। এ অবস্থা দেখে সেখানে থাকা তার মামা তাকে উদ্ধার করে স্থানীয় একটি হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
মাকসুদ ফরাজী আরও জানান, মিরাজ গুলিবিদ্ধ হওয়ার খবর পেয়ে তারাও বাসা থেকে ছুটে যান হাসপাতালে। ৫ আগস্ট সকাল ১০টার দিকে ভোলায় গ্রামের বাড়িতে এনে পারিবারিক কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়।
মিরাজের বাবা বলেন, ছেলেদের লেখাপড়া করাতে গিয়ে নিজে কিছুই করতে পারি নাই। আশা ছিল ছেলেরা পড়ালেখা করে বড় হয়ে আমাদের দুঃখ ঘুচাবে। কিন্তু সেটি আর হয়ে ওঠেনি। যে ছেলেটি আমার সবচেয়ে বেশি খবর নিত, একটু অসুস্থ হলেই পাগলের মতো হয়ে যেত, কাছে বসে থেকে সেবা-শুশ্রƒষা করত সেই ছেলেটি চলে গেছে। এখন বাকি দুই ছেলে আছে তাদের দিকেই তাকিয়ে আছি। আমি আমার ছেলে হত্যার বিচার চাই।
মিরাজের কথা মনে করতেই কান্নায় ভেঙে পড়েন ভোলার বাড়িতে থাকা নিহত মিরাজের বৃদ্ধ দাদি ও ফুপু। স্বজনরা মিরাজের পুরানো জামা-কাপড় বুকে নিয়ে তাকে খুঁজে ফেরেন।
মিরাজের কথা বলতে বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েন মিরাজের ফুপু আসমা। বলেন, মিরাজের আশা ছিল এ বছর এসএসসি পরীক্ষা দেওয়ার। পড়ালেখা করে একটা চাকরি করার স্বপ্ন ছিল। কিন্তু সেই আশা আর পূরণ হলো না। মিরাজের দাদি রেনু বিবি এখনো শুধু নাতির জন্য কাঁদেন। বলেন, মিরাজ চলে যাবে যদি জানতাম তাহলে কাপড়ের আঁচল দিয়ে গলার সঙ্গে বেঁধে রাখতাম। উড়াল দিতে দিতাম না।
শামীম হাওলাদার ও মিরাজ ফরাজীর মতো আরও ৪৮ জন শহীদ পরিবারে করুণ কাহিনী রয়েছে ভোলা জেলায়।
জুলাই-আগস্টে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের গণঅভ্যুত্থানে গুলিতে নিহত হওয়ার প্রায় এক বছর পরও শহীদ পরিবারগুলোর স্বজনদের কান্না থামছে না। গুলি কেড়ে নিয়েছে সংসার, রঙিন স্বপ্ন আর আশা। এখনো বুকফাটা আর্তনাদ আর স্বজনদের স্মৃতি নিয়ে দুঃসহ দিন কাটাচ্ছেন ভোলার অসহায় পরিবারগুলো। সরকারের কাছে আর্থিক ভাতা সহায়তার পাশাপাশি তারা এই নির্মম হত্যার বিচার দেখে যেতে চান। ভোলা জেলা প্রশাসক মো. আজাদ জাহান বলেন, জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানে ভোলায় ৪৮ জন শহীদ রয়েছেন।
তাদের পরিবারকে জেলা প্রশাসন ও সরকারের পক্ষ থেকে সহায়তা করা হচ্ছে। পাশাপাশি প্রতিটি পরিবারের সক্ষম ব্যক্তিদের স্থায়ীভাবে কর্মসংস্থান করা যায় কি না সে ব্যাপারে পরিকল্পনা রয়েছে। এছাড়া, আহতদের প্রতিনিয়ত সহায়তা করে যাচ্ছি। ভোলায় জুলাই স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হবে। সেখানে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করা হবে।
প্যানেল হু