
ছবিঃ সংগৃহীত
পাবনার ঈশ্বরদী উপজেলার সাঁড়া এবং পার্শ্ববর্তী নাটোরের লালপুরে পদ্মা নদীর সন্ত্রাসী বাহিনী আলোচিত আওয়ামী লীগ নেতা কাকন বাহিনীর আস্তানায় সেনাবাহিনী অভিযান চালিয়ে ৩ জনকে অস্ত্র, মাদকসহ গ্রেপ্তার ও বালু বিক্রয়ের নগদ টাকা জব্দ করার ঘটনাকে কেন্দ্র করে দুটি মামলা হয়েছে। উদ্ধার হওয়া বালু মহালের হিসেবের খাতায় পাওয়া চাঁদা ভাগবাটোয়ারা হিসেবে নাটোর জেলা প্রশাসক, নাটোর পুলিশ সার্কেল, লালপুর, বাগাতিপাড়া থানা পুলিশ, সাংবাদিকসহ লক্ষ্মীকুন্ডা নৌ পুলিশ ফাঁড়ির অফিসার ইনচার্জ (ওসি) কর্মকর্তার নাম উঠে এসেছে। বৃহস্পতিবার লক্ষ্মীকুন্ডার নৌ পুলিশের ইনচার্জ মো. ফিরোজ উদ্দিনকে প্রত্যাহার করে ঢাকা নৌ পুলিশ হেডকোয়ার্টারে সংযুক্ত করা হয়েছে।
নাটোর পুলিশ সুপারের কার্যালয় থেকে শুক্রবার (১৮ জুলাই) তিন সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। রোববার (২০ জুলাই) বিকেলে নাটোরের পুলিশ সুপার আমজাদ হোসেন বিষয়টি নিশ্চিত করেন।
এদিকে পদ্মা নদীর বালু মহালে সেনা ও পুলিশ বাহিনীর অভিযানের ঘটনাটি নাটকীয় উল্লেখ করে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার উপদেষ্টা সদস্য ও পাবনা জেলা বিএনপির আহ্বায়ক হাবিবুর রহমান হাবিব একটি বেসরকারি টেলিভিশনের টকশোতে বক্তব্য রেখেছেন। এতে নিজ দলের কতিপয় ব্যক্তিকে ইঙ্গিত করে বালু মহালে সন্ত্রাসী কার্যকলাপে যুক্ত থাকার অভিযোগ করেছেন। এরপর থেকে বিএনপির একটি অংশের মধ্যে তীব্র উত্তেজনা বিরাজ করছে। স্থানীয় বিএনপির নেতাকর্মীরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে হাবিবুর রহমান হাবিবের এই বক্তব্যের পক্ষে-বিপক্ষে তীব্র সমালোচনা করে নানা ধরনের মন্তব্য করছেন।
পদ্মা নদীর দিয়ার বাহাদুরপুর বালু মহাল, লক্ষ্মীকুন্ডা নৌ ফাঁড়ি ও মামলার সূত্রে জানা যায়, পদ্মা নদীর লালপুরের দিয়ার বাহাদুরপুর বালু মহালে সরকারের ডাকে ৯ কোটি ৬০ লাখ টাকা দর দিয়ে বালু উত্তোলনের অনুমোদন পান নাটোর বাগাতিপাড়ার মো. শহিদুল ইসলাম মোল্লা। অপর দিকে ঈশ্বরদীর সাঁড়া এলাকায় বালু উত্তোলন করছিলেন উপজেলা যুবদলের আহ্বায়ক সুলতান আলী বিশ্বাস টনি। এ নিয়ে দুই গ্রুপের মধ্যে মাঝেমধ্যেই হামলা, ভাঙচুর ও মামলার ঘটনায় উত্তেজনা চলে আসছিল।
গত বৃহস্পতিবার সকাল থেকে নাটোর থেকে সেনা ও পুলিশ এবং পাবনা থেকে সেনা ও পুলিশ সদস্যরা দিয়ার বাহাদুরপুর চরে দিনভর অভিযান চালায়। অভিযানে বৈধভাবে বালু উত্তোলনকারী মেসার্স মোল্লা ট্রেডার্সের মালিক শহিদুল ইসলাম মোল্লার দুইজন লোককে আটক করে। আটককৃতরা হলেন ঈশ্বরদীর সাঁড়া ইউনিয়নের আড়মবাড়িয়ার মনজুরুল ইসলামের ছেলে মো. আশরাফুল ইসলাম বাপ্পী (২৬), কুষ্টিয়ার ভেড়ামারার দক্ষিণ ভবানীপুর গ্রামের মৃত আজিজুলের ছেলে মেহফুজুর রহমান সোহাগ (৩৮)। পরে সেনাবাহিনী ও পুলিশ সদস্যরা লালপুরের কাইগীমারীর চর এলাকার ভাষানের ছেলে মো. ইদ্রিস (৩০)-এর বাড়িতে অভিযান চালিয়ে কয়েকটি আগ্নেয়াস্ত্র ও গুলি উদ্ধার করে। তারা দিয়ার বাহাদুরপুর বালু মহালের শ্রমিক।
এ বিষয়ে লালপুরের দিয়ার বাহাদুরপুর বালু মহালের বৈধ ইজারাদার মেসার্স মোল্লা ট্রেডার্সের মালিক শহিদুল ইসলাম মোল্লা বলেন, আমি সরকারি ডাকে যোগদান করে সর্বোচ্চ দরদাতা হিসেবে সরকারি কোষাগারে ৯ কোটি ৬০ লাখ টাকা জমা দিয়ে বালু উত্তোলন করে আসছি। সেখানে সেনা ও পুলিশ বাহিনী অভিযান চালিয়ে আমার দুইজন লোককে আটক করেছে। বালু বিক্রয়ের ১২ লাখ টাকা জব্দ করেছে। এটা খুবই অন্যায় ও নিন্দনীয়। বৈধ বালু মহালে সেনাবাহিনীর অভিযান একটি পরিকল্পিত ও গভীর ষড়যন্ত্র বলেও মন্তব্য করেছেন ইজারাদার শহিদুল।
সেনাবাহিনীর অভিযানে উদ্ধার হওয়া নথিপত্র গণমাধ্যমে দেওয়া হয়েছে। সেই সব নথিপত্র ঘেঁটে দেখা যায়, বৈধভাবে রাষ্ট্রীয় কোষাগারে টাকা জমা দিয়ে বালু উত্তোলন করতেও ইজারাদারকে প্রতিটি নৌকার জন্য ৩০০ টাকা হারে দৈনিক গড়ে ৩০ হাজার টাকা, মাসিক প্রায় সাড়ে ৮ লাখ টাকা দিতে হয়। পাবনা জেলা প্রশাসককে দিতে হয় এক লাখ টাকা, প্রতিদিন পুলিশের বড়াইগ্রাম সার্কেল পেয়েছেন ২৫ হাজার টাকা এবং দুই থানা বাবদ এক লাখ ৪০ হাজার টাকা। এছাড়া বিভিন্ন মহলে আর্থিক সহযোগিতা করার তথ্য রয়েছে।
লক্ষ্মীকুন্ডা নৌ পুলিশ ফাঁড়ির এসআই মো. সজল ইসলাম বলেন, পদ্মা নদীর লালপুরের দিয়ার বাহাদুরপুর বালু মহালে অভিযানের ঘটনায় অস্ত্র ও মাদকের পৃথক দুটি মামলা হয়েছে। এই দুই মামলায় তিনজন নামীয় ও অজ্ঞাত ৮/১০ জনকে আসামি করা হয়েছে। গ্রেফতারকৃত দুইজনকে ওই দুটি মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে লালপুর থানার মাধ্যমে জেল হাজতে প্রেরণ করা হয়েছে।
নৌ পুলিশ সুপার (রাজশাহী) বিএম নুরুজ্জামান বলেন, পদ্মা নদীর লালপুর দিয়ার বাহাদুরপুর চরের ঘটনায় গণমাধ্যমে নাটোর জেলা প্রশাসক, নাটোর পুলিশ সুপার, থানা পুলিশ ও লক্ষ্মীকুন্ডা নৌ পুলিশ ফাঁড়ির আইসির বিরুদ্ধে অর্থগ্রহণের যে অভিযোগ উঠেছে, তা তদন্ত করা হচ্ছে। এই সঙ্গে ফাঁড়ির আইসি মো. ফিরোজ উদ্দিনকে ঘটনার রাতেই প্রত্যাহার করে ঢাকা নৌ পুলিশ হেডকোয়ার্টারে সংযুক্ত করা হয়েছে।
এ বিষয়ে নাটোর পুলিশ সুপার মোহাম্মদ আমজাদ হোসেন বলেন, বালু মহালের ঘটনাটি তদন্তের জন্য অতিরিক্ত পুলিশ (ক্রাইম অ্যান্ড অপস) মো. একরামুল হককে প্রধান করে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটিটি আগামী ৩ কার্যদিবসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিবে। প্রতিবেদন দেখে পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।
বালু মহাল থেকে জেলা প্রশাসকের টাকা নেওয়ার সত্যতা জানতে নাটোর জেলা প্রশাসকের ব্যবহৃত সরকারি মোবাইল নম্বরে একাধিকবার রিং দেওয়া হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি। এজন্য তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
এদিকে ওই বালু মহালে অভিযানের বিষয়ে একটি বেসরকারি টেলিভিশনে বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও পাবনা জেলা বিএনপির আহ্বায়ক হাবিবুর রহমান হাবিবের দেওয়া বক্তব্যকে কেন্দ্র করে স্থানীয় বিএনপির একটি পক্ষের মধ্যে তীব্র উত্তেজনা শুরু হয়েছে।
ইমরান