
ছবি: জনকণ্ঠ
পদ্মা নদী বেষ্টিত শরীয়তপুরের গ্রামীণ জনপদের নদী-নালা, খাল-বিল ও জলাশয় এক সময় ছিল মৎস্য আহরণের প্রাণকেন্দ্র। এই অঞ্চলে নদী ও বিভিন্ন খাল,বিল থাকায় জেলেরা যুগ যুগ ধরে নানা প্রাচীন ও দেশীয় কৌশলে মাছ ধরার পদ্ধতি রপ্ত করে আসছিল। এর মধ্যে অন্যতম ছিল ‘ভেসাল’ দিয়ে মাছ ধরার অভিনব এবং কৌশলী পদ্ধতি। তবে আধুনিকতার ছোঁয়া, জলজ পরিবেশে নদীর গতিপথ পরিবর্তন এবং পেশাগত সংকটের কারণে আজ এই পদ্ধতি বিলুপ্তির পথে।
ভেসাল হলো একটি দেশীয় জাল, যা সাধারণত বাঁশ ও নাইলনের সুতা দিয়ে তৈরি করা হয়। এটি পানিতে ভাসমান অবস্থায় বসানো হয় এবং চারদিকে বাঁশের খুঁটি গেঁথে স্থির রাখা হয়। পানির স্রোতের সঙ্গে ভেসাল স্থিরভাবে দাঁড়িয়ে থাকে, ফলে জোয়ার-ভাটার সময় মাছ এই জালে আটকা পড়ে।
বর্ষা মৌসুমে যখন নদীতে পানির প্রবাহ বৃদ্ধি পায়, তখন জেলেরা ভেসাল বসিয়ে অপেক্ষা করেন। স্রোতের টানে মাছ জালের ভেতর ঢুকে পড়ে এবং পিছনের সংকীর্ণ অংশ দিয়ে বের হতে না পেরে আটকে যায়। দিনে একাধিকবার জাল ওঠানোর মাধ্যমে মাছ সংগ্রহ করা হয়। এই পদ্ধতিতে দেশি শোল, বোয়াল, টেংরা, পুঁটি, কাতলা ইত্যাদি মাছ ধরা সম্ভব হতো।
১. পরিবেশগত পরিবর্তন: নদী, খাল ও বিলগুলো ক্রমাগত ভরাট হয়ে যাওয়ায় বা প্রবাহহীন হয়ে পড়ায় মাছের পরিমাণ কমে গেছে।
২. আধুনিক জাল ও ট্রলারের ব্যবহার: অল্প সময়ে অধিক মাছ ধরার জন্য জেলেরা ইঞ্জিনচালিত নৌকা ও বড় জাল ব্যবহারে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে।
৩. জেলেদের পেশা পরিবর্তন: মৎস্যজীবীদের অনেকেই বিকল্প পেশায় চলে গেছেন, ফলে এই প্রথাগত পদ্ধতির ব্যবহার কমে গেছে।
৪. আইনগত বাধা: কিছু অঞ্চলে ভেসাল জাল ব্যবহারে স্থানীয়ভাবে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে, কারণ এটি কিছু ক্ষেত্রে মাছের প্রজনন ব্যাহত করতে পারে।
ভেসাল শুধু মাছ ধরার উপকরণ নয়, এটি এক সময়ের গ্রামীণ সংস্কৃতির অংশ ছিল। সন্ধ্যায় পরিবারের সদস্যরা মিলে মাছ ধরার প্রস্তুতি গ্রহণ, জাল ফেলা ও তোলার সময়কার প্রতীক্ষা, আনন্দ—সব মিলিয়ে ছিল এক ধরনের উৎসব।
ভেসাল দিয়ে মাছ ধরার এই প্রাচীন পদ্ধতি এক সময় শরীয়তপুরের জাজিরা, নড়িয়া,পালং, ডামুড্যা,ভেদরগঞ্জ ও গোসাইরহাটের গ্রামবাংলার নদীভিত্তিক জীবনের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল। আজ তা হারিয়ে যেতে বসেছে। গবেষণা, নথিভুক্তকরণ এবং ঐতিহ্য সংরক্ষণের মাধ্যমে এই শিল্পটিকে নতুন প্রজন্মের সামনে তুলে ধরা প্রয়োজন, যাতে এই ঐতিহ্য শুধু বইয়ের পাতায় নয়, বাস্তব জীবনেও টিকে থাকে।
সাব্বির