
২০২৪ সালের ১৯ জুলাই, এক জুমার দিন। ঢাকার মিরপুর-১০ গোলচত্বরে যখন কোটা সংস্কার আন্দোলন উত্তাল, তখনই ঘটে যায় এক মর্মান্তিক ঘটনা। পুলিশের ছোড়া গুলি এসে বিদ্ধ হয় অফিস থেকে বাসায় ফেরার পথে থাকা এক নিরীহ টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারের মাথায়।নাম তার মো. আতিকুল ইসলাম রুবেল (৩৫)।
আজ, তার মৃত্যুর এক বছর পরও থামেনি স্বজনদের কান্না। ছোট্ট মেয়ে ফারিস্তা এখনও খোঁজে বাবাকে। মাত্র দেড় বছর বয়সেই সে হারিয়েছে জীবনের সবচেয়ে বড় আশ্রয়।
রুবেল ছিলেন পটুয়াখালীর গলাচিপা উপজেলার পানপট্টি ইউনিয়নের গ্রামার্দন গ্রামের এক শিক্ষিত, স্বাবলম্বী সন্তান। চার ভাইয়ের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার ছোট, অথচ পরিবারের সবচাইতে বড় ভরসা।
২০০৭ সালে গলাচিপা সরকারি টেক্সটাইল ইনস্টিটিউট থেকে এসএসসি, এরপর ২০১১ সালে বরিশাল সরকারি টেক্সটাইল কলেজ থেকে ডিপ্লোমা এবং ২০১৪ সালে ঢাকা সিটি ইউনিভার্সিটি থেকে টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে বিএসসি সম্পন্ন করেন।তিনি কাজ করতেন রাজধানীর বারিধারায় অবস্থিত জাস্টেক্স বায়িং হাউজে সিনিয়র মার্চেন্ডাইজার হিসেবে।
স্বপ্নের ঘর, অথচ বেশিদিন থাকতে পারলেন না
নিজের উপার্জনে গলাচিপা পৌরসভার ৭ নম্বর ওয়ার্ডের রূপনগরে একটি বাড়ি তৈরি করেছিলেন রুবেল। কিন্তু সেই বাড়িতে পরিবার নিয়ে থাকা হলো না বেশি দিন।
২০১৭ সালে বিয়ে করেন রাঙ্গাবালীর মেয়ে মোসা. তামান্নাকে। তাদের একমাত্র সন্তান আলিসবা ইসলাম ফারিস্তা তখন মাত্র ১৮ মাস বয়সী, যখন রুবেল শহীদ হন একটি আন্দোলনের হঠাৎ ছোড়া গুলিতে।
পরিবারের চালিকা শক্তি ছিলেন রুবেল
রুবেলের মা মমতাজ বেগম আজও বিশ্বাস করতে পারেন না—তার সেই পরিশ্রমী, মেধাবী সন্তান আর ফিরবে না।
বাবা শাহ আলম হাওলাদার ছিলেন একজন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক, অল্প বেতনে সংসার চালাতে হিমশিম খেতেন। রুবেলের বড় বোন লিপি নিজের কাছে এনে তাকে পড়াশোনা করিয়েছিলেন। একসময়ে ভাইয়ের সেই পরিশ্রমই হয়ে উঠেছিল পুরো পরিবারের অবলম্বন।
তাঁর ছোট ভাইদের কেউ বাকপ্রতিবন্ধী, কেউ এখনও স্বাবলম্বী হতে পারেননি। রুবেল একাই সবার পাশে ছিলেন।
দ্বিগুণ শোক, এক বছরেই হারালেন ছেলেকে ও স্বামীকে
শুধু রুবেল নয়, তার মৃত্যুর এক বছর পার হতে না হতেই ২০২৫ সালের ২৭ জুন হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান তার বাবা শাহ আলম মাস্টার।
ছেলের মৃত্যু যেন তাঁকে বেঁচে থাকতে দেয়নি। রুবেল হত্যার পর থেকেই যেন স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলেন তিনি।
স্ত্রীর কান্নাভেজা স্মৃতিচারণ
রুবেলের স্ত্রী তামান্না বলেন, “ওইদিন দুপুরে বলল বাইরে যেও না, গণ্ডগোল হচ্ছে। এরপর বিকেলে খবর পাই, মাথায় গুলি লেগেছে।
সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে গিয়েছিলাম, কিন্তু কিছুই করার ছিল না।
আমার স্বামী কোনো রাজনীতি করত না। তাহলে কেন মরতে হলো ওকে?
এখন মেয়েটার দিকে তাকালেই বুক ফেটে যায়।”
নিরাপরাধের মৃত্যু, কে নেবে দায়?
এই প্রশ্ন আজ শুধু রুবেলের পরিবারের নয়, সমগ্র সমাজের।
কেন একজন নিরীহ নাগরিক, যিনি আন্দোলনে সম্পৃক্ত ছিলেন না, তার প্রাণ যাবে রাষ্ট্রীয় গুলিতে?
এই প্রশ্নের উত্তর নেই, নেই কোনো বিচার।
একটি পরিবার আজ নিঃস্ব—চায় রাষ্ট্রের সহানুভূতি
রুবেলের মা, স্ত্রী ও আত্মীয়রা এখনো আশায় বুক বাঁধেন—সরকার বা সমাজ থেকে কেউ এগিয়ে আসবে হয়তো।
রুবেলের চাচী তাহমিনা বেগম বলেন, “সে আমাদের সবার পাশে ছিল। এখন তার স্ত্রী-মেয়ের ভবিষ্যত খুবই অনিশ্চিত। সরকারের উচিত সাহায্য করা।”
শহীদ রুবেলকে গলাচিপা পরিবার ও এই সমাজের পক্ষ থেকে গভীর শ্রদ্ধা।
তাঁর স্মৃতি আমাদের অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের প্রেরণা হয়ে থাকুক।
Jahan