ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ২০ জুলাই ২০২৫, ৪ শ্রাবণ ১৪৩২

গ্রেপ্তার আরও ৪৪

শিথিলের ১৪ ঘণ্টা পর গোপালগঞ্জে ফের কার্ফু

স্টাফ রিপোর্টার

প্রকাশিত: ২৩:৫৩, ১৯ জুলাই ২০২৫

শিথিলের ১৪ ঘণ্টা পর গোপালগঞ্জে ফের কার্ফু

শিথিলের ১৪ ঘণ্টা পর গোপালগঞ্জে ফের কার্ফু

গোপালগঞ্জে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সমাবেশ ঘিরে আওয়ামী লীগ ও নিষিদ্ধ ঘোষিত সংগঠন ছাত্রলীগের হামলা, সংঘর্ষ ও প্রাণহানির ঘটনার পর জারি করা কার্ফু ১৪ ঘণ্টার জন্য শিথিল ছিল। শনিবার সকাল ৬টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত কার্ফু শিথিল ছিল। তবে রাত ৮টা থেকে আজ রবিবার সকাল ৬টা পর্যন্ত আবারও কার্ফু সময় বাড়ানো হয়েছে। শনিবার এক বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানিয়েছে জেলা প্রশাসন।
তবে ১৪ ঘণ্টা কার্ফু শিথিল থাকলেও গোপালগঞ্জে বাজারঘাট ছিল ফাঁকা। বন্ধ ছিল বেশিরভাগ দোকানপাট। ঘটনার চারদিনেও পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়নি। জনমনে এখনো আতঙ্ক বিরাজ করছে। শহরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা টহল দিচ্ছেন। কার্ফুর মধ্যেই নতুন করে ৪৪ জন গ্রেপ্তার হয়েছে। এদিকে সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যাওয়া রিক্সাচালক রমজান মুন্সির মরদেহের ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হয়েছে।

বাকি চারজনের মরদেহ ময়নাতদন্ত ছাড়াই এর আগে দাফন ও সৎকার করা হয়েছে। প্রয়োজনে তাদের লাশ কবর থেকে তুলে ময়নাতদন্ত করা হবে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী। সেদিন সংঘর্ষ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গুলিতে পাঁচজন নিহত হওয়ার ঘটনায় গভীর উদ্বেগ ও তীব্র নিন্দা জানিয়েছে মানবাধিকার সংগঠনগুলোর জোট হিউম্যান রাইটস ফোরাম বাংলাদেশ (এইচআরএফবি)। এই ঘটনাকে নাগরিক নিরাপত্তা ও সংবিধানপ্রদত্ত মৌলিক অধিকারের ওপর সরাসরি আঘাত উল্লেখ করে অবিলম্বে বিচার বিভাগীয় তদন্তের দাবি জানিয়েছে জোটটি।

গত বুধবার গোপালগঞ্জে এনসিপি’র পদযাত্রা ঘিরে হামলা চালায় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। পুলিশের গাড়ি ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করে তারা। টানা চার ঘণ্টা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে চলে সংঘর্ষ। এতে পাঁচজন নিহত ও আহত হয়েছেন অর্ধশতাধিক। ঘটনার প্রথমে জেলায় ১৪৪ ধারা জারি করে জেলা প্রশাসন। এরপর দেওয়া হয় কার্ফু। পর্যায়ক্রমে কার্ফুর সময়সীমা বৃদ্ধি করে জেলা প্রশাসন। তবে শনিবার সকাল ৬টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত কার্ফু শিথিল ছিল। ১৪ ঘণ্টা কার্ফু শিথিল থাকলেও শহরটিতে জনমনে এখনো আতঙ্ক বিরাজ করছে। জরুরি প্রয়োজনেও ঘর থেকে বের হননি অনেকে। শহরের বেশিরভাগ দোকান ছিল বন্ধ। 
শনিবার সকাল ১০টার দিকে শহরের লঞ্চঘাট এলাকায় গিয়ে দেখা যায় কিছু যানবাহন দাঁড়িয়ে আছে। তবে যাত্রী তেমন নেই। কিছু মানুষ এদিক-ওদিক যাচ্ছেন। লঞ্চঘাট এলাকায় দু-একটি দোকান ছাড়া বাকি দোকানগুলো বন্ধ দেখা গেছে। 
স্থানীয়রা বলেছেন, শনিবার এখানকার মার্কেট-ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোর সাপ্তাহিক ছুটির দিন। এ কারণে স্বাভাবিক সময়েও শনিবার শহরে লোকজনের উপস্থিতি কম থাকে। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে কার্ফু তাছাড়া সংঘর্ষ ও সংহিসতার ঘটনায় হওয়া বিভিন্ন মামলায় গ্রেপ্তারের আতঙ্কও আছে বলছেন অনেকেই। তবে এমন পরিস্থিতিতে সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়েছেন শহরের নি¤œআয়ের শ্রমজীবী মানুষ।
শহরের ইজিবাইক চালক লিয়াকত বলেন, গত তিন দিন ধরেই শহরে গাড়ি চালাচ্ছি। তবে ইনকাম নেই। আজকে কার্ফু নাই, ভাবছিলাম কিছু আয় হবে, তবে সেই পরিমাণ ইনকাম হচ্ছে না। মানুষ ভয়ে ঘর থেকে বের হচ্ছেন না। যাত্রী নেই। এমনিতেই শনিবার লোক কম থাকে, তার ওপর মনে একটা আতঙ্ক আছে। তিনি জানান, দিনে ৬০০ থেকে হাজার টাকা আয় করি। তবে গত তিন দিনে দুশ-তিনশ টাকার বেশি ভাড়া পাই নাই। অথচ ইজিবাইকের মালিককে ভাড়া বাবদ প্রতিদিন দিতে হয় ৪০০ টাকা। 
শহরের বড় বাজারের চাউল ব্যবসায়ী কনক বড়–য়া বলেন, তিন দিন পর দোকান খুলেছি। সকালের দিকে কিছু কেনা-বেচা হয়েছে। দুপুরের আগেই বাজার ফাঁকা হয়ে গেছে। তাই বন্ধ করে বড়ি চলে যাচ্ছি।  
লঞ্চঘাট এলাকায় কথা হয় ইয়ামিন নামে এক যুবকের সঙ্গে। তিনি বলেন, জরুরি কাজে শহরে এসেছিলাম। তবে কাজ হবে কি না জানি না। বেশিরভাগ দোকানপাট বন্ধ। এখনো চারদিকে আতঙ্ক। কখন জানি গ্রেপ্তার হই, এই ভয়ে আছি! বিভিন্ন এলাকায় রাতে অভিযান পরিচালনা করায় সাধারণ মানুষ অনেকেই ঘরবাড়ি ছাড়া।  
লঞ্চঘাট এলাকায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখার নেতৃত্ব দিচ্ছেন জেলা পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ড. রুহুল আমিন সরকার। জানতে চাইলে তিনি জানান, পরিস্থিতি এখন অনেকটাই স্বাভাবিক। সকাল থেকে কার্ফু নেই, যার কারণে সাধারণ মানুষ অনেকে ঘর থেকে বের হচ্ছেন। আমরা অভিযানও পরিচালনা করছি। তবে অভিযানে যেন নিরপরাধ কেউ আটক না হয় সে বিষয়ে খেয়াল রাখা হচ্ছে। 
বুধবারের পর থেকে গোপালগঞ্জে নিয়মিত অভিযান চালাচ্ছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। রাতভর শহরে, অলিগলিতে ও বাসাবাড়িতে অভিযান চালানো হয়। এতে গ্রেপ্তার আতঙ্কে রাতে গ্রাম শূণ্য হয়ে যায় পুরুষ মানুষ। এমনটি নিশ্চিত করেছেন স্থানীয় অনেকে। শুক্রবার সন্ধ্যা থেকে শনিবার সকাল পর্যন্ত সদর থেকে নতুন করে ৪৪ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন গোপালগঞ্জ সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মীর মোহাম্মদ সাজেদুর রহমান। 
তিনি জানান, শুক্রবার থেকে শনিবার সকাল পর্যন্ত ৪৪ জন সদর এলাকা থেকে গ্রেপ্তার হয়েছে যৌথ অভিযানে। আমরা শনিবার সবাইকে আদালতে চালান করে দিয়েছি। 
নিহত রিক্সা চালকের মরদেহের ময়নাতদন্ত সম্পন্ন ॥ বুধবার সংঘর্ষের ঘটনার সময় চারজন নিহত হয়েছেন। তারা হলেন- গোপালগঞ্জ শহরের কোটালীপাড়ার হরিণাহাটি গ্রামের রাজমিস্ত্রি রমজান কাজী, শহরের পূর্ব মিয়াপাড়া এলাকার মুঠোফোনের পার্টস ব্যবসায়ী সোহেল রানা, শহরের উদয়ন রোডের পোশাক ব্যবসায়ী দীপ্ত সাহা ও সদর উপজেলার ভেড়ার বাজার এলাকার দোকান কর্মচারী ইমন তালুকদার। আর রিক্সা চালক রমজান মুন্সি (৩২) গুলিবিদ্ধ অবস্থায় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন।

সেখানে বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত পৌনে ২টার দিকে তিনি মারা যান। হামলা-সংঘর্ষে এই পাঁচজন নিহত হওয়ার ঘটনায় এখন পর্যন্ত পরিবার বা পুলিশ কারও পক্ষ থেকেই কোনো মামলা হয়নি। এমনকি ময়নাতদন্ত ছাড়াই নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে চারজনের দাফন ও সৎকার হয়েছে। শুধুমাত্র রমজান মুন্সির মরদেহের ময়নাতদন্ত হয়েছে। বৃহস্পতিবার বিকেল ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল মর্গে ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছেন মর্গের ইনচার্জ রামু। 
রামু জানান, ফরেনসিক বিভাগের চিকিৎসক নিহত রমজান মুন্সির মরদেহের ময়নাতদন্ত সম্পন্ন করেন। এরপর ৫টার দিকে নিহতের পরিবারের কাছে বুঝিয়ে দেওয়া হয়। 
নিহতের ভাই হিরা মুন্সিও বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তিনি জানান, রমজানের মরদেহের ময়নাতদন্ত শেষ হলে লাশ আমাদের বুঝিয়ে দেওয়া হয়। পরে বৃহস্পতিবার রাত ১০টায় গ্রামের বাড়িতে তার মরদেহ দাফন করা হয়। ঘটনার পর থেকে পুলিশ বা কেউ আমাদের সঙ্গে কোনো ধরনের যোগাযোগ করেনি। ভাইকে হারিয়ে শোকাহত হিরো মুন্সি বলেন, প্রায় ১০ বছর আগে স্ত্রীর সঙ্গে ডিভোর্স হয় রমজানের। এরপর থেকে আর বিয়ে করেনি। আমাদের সঙ্গেই থাকত। একটা ভাড়া রিক্সা চালাত। কি দোষ ছিল আমার ভাইর। ও তো রাজনীতি করত না। হে গো (রাজনৈতিক দলের নেতারা) কারণে আমার ভাইকে কেন প্রাণ দিতে হলো? 
প্রয়োজনে লাশ কবর থেকে তুলে ময়নাতদন্ত ॥ সহিংসতায় নিহত যে চারজনের মরদেহ ময়নাতদন্ত ছাড়াই দাফন করা হয়েছ, প্রয়োজনে তাদের মরদেহ কবর থেকে তুলে ময়নাতদন্ত করা হবে বলে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী। 
শনিবার সকালে রাজধানীর হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল পরিদর্শন শেষে সাংবাদিকদের তিনি আরও বলেন, নিহতদের স্বজনরা লাশ হাসপাতাল থেকে নিয়ে গেছেন। চিকিৎসকরা ময়নাতদন্ত করতে চাইলেও তারা দেননি। এখন প্রয়োজনে কবর থেকে তুলে ময়নাতদন্ত করা হবে। লাশের ময়নাতদন্ত না হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। গোপালগঞ্জের ঘটনায় উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন কমিটি গঠন করা হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, এই কমিটি তদন্তের মাধ্যমে নির্ধারণ করবে দায়টা আসলে কার। তারা পুরো বিষয় সবার সামনে তুলে ধরবে। 
তদন্তের দাবি হিউম্যান রাইটস ফোরামের ॥ রাজনৈতিক সমাবেশকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গুলিতে পাঁচজন নিহত হওয়ার ঘটনায় গভীর উদ্বেগ, তীব্র নিন্দা ও তদন্তের দাবি জানিয়েছে মানবাধিকার সংগঠনগুলোর জোট হিউম্যান রাইটস ফোরাম বাংলাদেশ (এইচআরএফবি)। শনিবার এক বিবৃতি দিয়ে এইচআরএফবি এই দাবি জানায়।
বিবৃতিতে সই করেন ড. হামিদা হোসেন, অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল, রাজা দেবাশীষ রায়, অ্যাডভোকেট জেড আই খান পান্না, শাহীন আনামসহ অনেকেই।
এতে বলা হয়, গত ১৬ জুলাই গোপালগঞ্জ পৌর পার্কে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সমাবেশ শেষে স্থানীয় একটি রাজনৈতিক দলের একাংশের সঙ্গে সংঘর্ষ শুরু হয়। সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়লে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী জনতার ওপর অতিরিক্ত বলপ্রয়োগ ও প্রকাশ্যে আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করে। এতে ঘটনাস্থলে চারজন এবং পরে হাসপাতালে আরও একজনের মৃত্যু হয়। 
এইচআরএফবি মনে করে, জনসমক্ষে গুলি চালিয়ে পরিস্থিতি মোকাবিলা করা অমানবিক এবং এটি সংবিধানের ৩১ অনুচ্ছেদ ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের সরাসরি লঙ্ঘন। বিবৃতিতে বলা হয়, ‘এই ধরনের অতিমাত্রায় বলপ্রয়োগ কোনো অজুহাতেই গ্রহণযোগ্য নয়, বরং এটি রাষ্ট্রের জবাবদিহিতার অভাবের বহিঃপ্রকাশ।’ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরস্পরবিরোধী বক্তব্যের বিষয়টিও তুলে ধরে ফোরাম।

বিবৃতিতে বলা হয়, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বাহিনীর সদস্যদের গুলি ছোড়ার ভিডিও দেখা গেলেও পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) গণমাধ্যমে প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারের কথা অস্বীকার করেছেন। অন্যদিকে, আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) ‘আত্মরক্ষার্থে’ বলপ্রয়োগের কথা স্বীকার করলেও প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারের বিষয়ে স্পষ্ট কোনো ব্যাখ্যা দেয়নি।
নিহত এক ব্যক্তির পরিবারের গুরুতর অভিযোগের কথা উল্লেখ করে এইচআরএফবি জানায়, ময়নাতদন্ত ছাড়াই লাশ দাফন করতে বাধ্য করা হয়েছে বলে একটি পরিবার অভিযোগ করেছে।

প্যানেল হু

×