ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ২০ জুলাই ২০২৫, ৪ শ্রাবণ ১৪৩২

সাভারের নিটারের শিক্ষার্থীদের ভাবনায় স্বাস্থ্য-সচেতনতা

মিঠুন দাস মিঠু, কন্ট্রিবিউটিং রিপোর্টার, নিটার

প্রকাশিত: ২২:৪৭, ১৯ জুলাই ২০২৫

সাভারের নিটারের শিক্ষার্থীদের ভাবনায় স্বাস্থ্য-সচেতনতা

সাভারের ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অফ টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড রিসার্চ (নিটার) ক্যাম্পাসে দীর্ঘদিন ধরেই নিরাপদ, স্বাস্থ্যকর ও মানসম্পন্ন খাবারের সঙ্কটে ভুগছেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা। দীর্ঘসময় ধরে তারা নানা মাধ্যমে এই সমস্যার কথা জানিয়ে এলেও এখন পর্যন্ত কোনো টেকসই বা কার্যকর সমাধান দেখতে পাননি বলে অভিযোগ শিক্ষার্থীদের। খাবারের মান নিয়ে প্রতিনিয়ত ক্ষোভ আর হতাশা প্রকাশ করছেন তারা—বিশেষ করে আবাসিক শিক্ষার্থীরা, যারা প্রতিদিনের তিনবেলা খাবারের ওপর সরাসরি নির্ভরশীল। খাবারে পোকামাকড় পাওয়া, রান্নার অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ, পর্যাপ্ত পুষ্টিগুণের অভাবসহ নানা অনিয়ম শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্যঝুঁকিতে ফেলছে বলে জানিয়েছেন অনেকে। এই দীর্ঘদিনের ভোগান্তি ও সমাধানের দাবিতে শিক্ষার্থীদের মতামত, বাস্তব অভিজ্ঞতা ও প্রত্যাশার চিত্র তুলে ধরেছেন ‘দৈনিক জনকণ্ঠ’ -এর কন্ট্রিবিউটিং রিপোর্টার মিঠুন দাস মিঠু।

নিটারের মতো প্রযুক্তিনির্ভর প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনায় মনোযোগ ধরে রাখতে পরিমিত ও স্বাস্থ্যকর খাবারের সহজলভ্যতা অত্যন্ত জরুরি। বর্তমানে নিটারে অনেক শিক্ষার্থী অস্বাস্থ্যকর বা অনিয়মিত খাবার গ্রহণে বাধ্য হচ্ছে, যা তাদের মনোসংযোগ, শরীরিক সুস্থতা ও ক্লাস অ্যাটেন্ডেন্সে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। এই সমস্যা সমাধানে ভারতের অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো ‘সাবসিডাইজড ক্যান্টিন মডেল’ অনুসরণ করা যেতে পারে। যেমন—IIT বা JNU-এর ক্যান্টিনগুলোতে নির্দিষ্ট বাজেটের মধ্যে স্বাস্থ্যকর খাবার সরবরাহ করা হয়, যা ছাত্রদের জন্য সাশ্রয়ী ও পুষ্টিকর। নিটারে একটি কেন্দ্রীয় ক্যান্টিন চালু করে, যেখানে সপ্তাহভিত্তিক রোটেশন মেনু, ছাত্রছাত্রীদের মতামতভিত্তিক খাবার নির্ধারণ এবং পুষ্টিবিদ পরামর্শ যুক্ত করলে তা হবে একটি টেকসই ও কার্যকর উদ্যোগ। হোস্টেল সুপার এবং সহকারী সুপার খাবারের মান পরিচালনা করবে। হোস্টেলের শিক্ষার্থীরা প্রতি মাসের শুরুতে নির্দিষ্ট টাকা জমা দিয়ে খেতে পারবে। এতে শিক্ষার্থীদের পুষ্টির ঘাটতি যেমন কমবে, তেমনি পড়াশোনায় মনোযোগ বাড়বে এবং একটি সুস্থ, একাগ্র ক্যাম্পাস সংস্কৃতি গড়ে উঠবে।

-রিফাত আহমেদ, শিক্ষার্থী (৪র্থ বর্ষ), নিটার

একজন শিক্ষার্থীর মেধা বিকাশ, শারীরিক সক্ষমতা এবং একাগ্রতা ধরে রাখার জন্য পরিমিত ও স্বাস্থ্যকর খাবার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অথচ সাভারের ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অফ টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড রিসার্চ (নিটার)-এর মতো একটি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এই বিষয়ে যথাযথ নজরদারির ঘাটতি চোখে পড়ার মতো। অনিয়মিত ও অপুষ্টিকর খাবার গ্রহণের ফলে শিক্ষার্থীরা পর্যাপ্ত শক্তি থেকে বঞ্চিত হয়, যার প্রভাব পড়ে তাদের পড়াশোনার ওপর। ক্লান্তি, একাগ্রতা হ্রাস, এমনকি মানসিক অবসাদের মতো সমস্যা দেখা দেয়, যা দীর্ঘমেয়াদে শারীরিক দুর্বলতা ও নানান রোগের ঝুঁকি বাড়িয়ে তোলে। এর পাশাপাশি বাইরে থেকে নিম্নমানের খাবার খাওয়ার প্রবণতায় শিক্ষার্থীরা পেটের সমস্যা, ফুড পয়জনিংয়ের মতো স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়ছে। এই পরিস্থিতির কার্যকর সমাধানে প্রশাসনের উদ্যোগ অত্যাবশ্যক। প্রথমত, শিক্ষার্থীদের জন্য একটি স্বাস্থ্যসম্মত ও নির্ভরযোগ্য ডাইনিং ব্যবস্থা চালু করা প্রয়োজন, যেখানে মানসম্মত ও পুষ্টিকর খাবার ন্যায্য মূল্যে সরবরাহ নিশ্চিত করা হবে। দ্বিতীয়ত, শিক্ষার্থীদের মতামত ও অভিযোগ নিয়মিতভাবে গ্রহণ ও বিশ্লেষণের জন্য একটি সুষ্ঠু ফিডব্যাক পদ্ধতি চালু করা যেতে পারে, যা খাবারের মান উন্নয়নে বাস্তবভিত্তিক সিদ্ধান্ত নিতে সহায়ক হবে।

-আরিফুল আরাফ, শিক্ষার্থী (৪র্থ বর্ষ), নিটার

নিটারের শিক্ষার্থীদের জন্য পড়াশোনায় মনোযোগ ধরে রাখা এবং মানসিক ও শারীরিকভাবে সুস্থ থাকার জন্য পরিমিত ও স্বাস্থ্যকর খাবারের ব্যবস্থা অত্যন্ত জরুরি। কিন্তু দুঃখজনকভাবে, নিটারে এই মৌলিক চাহিদাটিরত পর্যাপ্ত জোগান নেই বললেই চলে। বিশেষ করে ছাত্রী হোস্টেলের শিক্ষার্থীরা প্রতিদিনের খাবারের জন্য চরম ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন। হোস্টেলের অভ্যন্তরে কোনো ডাইনিং ব্যবস্থা না থাকায়, তাদের প্রতিবার খাবারের জন্য হোস্টেল থেকে বের হয়ে ক্যাম্পাসের বাহিরে যেতে হয়। যদিও ক্যাম্পাসের ভিতরে একটি ক্যান্টিন রয়েছে, সেটির খাবার মানহীন ও অস্বাস্থ্যকর হওয়ায় অধিকাংশ শিক্ষার্থী সেটি এড়িয়ে চলেন। ছাত্রীদের জন্য এই পরিস্থিতি আরও জটিল, কারণ বারবার বাহিরে যাওয়া তাদের নিরাপত্তা ও সময় ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে অসুবিধা সৃষ্টি করছে। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, এই সংকট নিরসনে ছাত্রী হোস্টেলের অভ্যন্তরে একটি পূর্ণাঙ্গ ডাইনিং ব্যবস্থা চালু করা অত্যন্ত জরুরি। সেক্ষেত্রে প্রতিদিনের খাবার সময়মতো, স্বাস্থ্যসম্মতভাবে এবং নিরাপদ পরিবেশে গ্রহণ সম্ভব হবে। একই সঙ্গে, এই ডাইনিং ব্যবস্থার নিয়মিত পর্যবেক্ষণ ও মান নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করতে হবে প্রশাসনের পক্ষ থেকে। তবেই শিক্ষার্থীরা মানসিক চাপমুক্ত হয়ে পড়াশোনায় মনোযোগ দিতে পারবে।

-সামিয়া খানম, শিক্ষার্থী (৩য় বর্ষ), নিটার

“স্বাস্থ্যই সকল সুখের মূল” — এই চিরন্তন সত্যটি আমরা সবাই জানি। সুস্থ দেহ ও মন শুধু সুখের উৎসই নয়, একজন শিক্ষার্থীর জন্য এটি মনোযোগ ধরে রাখা ও পড়াশোনায় সাফল্য অর্জনের প্রধান ভিত্তি। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখজনকভাবে, নিটার ক্যাম্পাসে এখনো শিক্ষার্থীদের জন্য স্বাস্থ্যকর ও পুষ্টিকর খাবারের কোনো মানসম্পন্ন ও নির্ভরযোগ্য ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি। বর্তমানে ক্যাম্পাস ক্যান্টিনে পাওয়া খাবারের গুণগতমান অত্যন্ত নিম্নমানের এবং অপরিষ্কার পরিবেশে তা পরিবেশন করা হয়, যা শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়িয়ে তুলছে। ফলস্বরূপ, অনেক শিক্ষার্থী নানাবিধ শারীরিক অসুস্থতা, দুর্বলতা, হজমজনিত সমস্যা এবং মানসিক চাপের সম্মুখীন হচ্ছেন। এই দীর্ঘস্থায়ী সমস্যাগুলো ধীরে ধীরে শিক্ষার্থীদের একাডেমিক মনোযোগ, কর্মদক্ষতা এবং মানসিক স্বাস্থ্যে মারাত্মক প্রভাব ফেলছে। এছাড়া, বাহিরে থেকে প্রতিনিয়ত অস্বাস্থ্যকর ফাস্টফুড খাওয়ার প্রবণতা তৈরি হওয়ায় শিক্ষার্থীরা ঝুঁকছেন অতিরিক্ত খরচ এবং আরও বেশি স্বাস্থ্যঝুঁকির দিকে।  শুধু শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ নয়, একটি সুস্থ প্রজন্ম গঠনের জন্যও বিষয়টির দিকে সুনজর দেওয়া প্রয়োজন।

-জহিরুল ইসলাম প্রান্ত, শিক্ষার্থী (৩য় বর্ষ), নিটার

বাংলাদেশ একটি শিল্পসমৃদ্ধ অর্থনীতির দেশ, যেখানে সবচেয়ে বড় অবদান রাখছে পোশাক শিল্প। এই খাতে দক্ষ জনশক্তি সরবরাহের মাধ্যমে নিটার (NITER) দেশের অর্থনীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলেছে। আর নিটারের প্রাণশক্তি হলো এখানকার শিক্ষার্থীরা। একজন শিক্ষার্থী উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায় শেষ করে বড় স্বপ্ন ও আশা নিয়ে নিটারে আসে, সেই প্রত্যাশা নিয়ে যে সে আধুনিক ও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার মাধ্যমে নিজেকে গড়ে তুলে দেশের অর্থনীতির একজন দক্ষ কারিগরে পরিণত হবে। কিন্তু বাস্তবতায় নিটারিয়ানদের জন্য সেই পথটা খুব একটা সহজ নয়। বিশেষ করে এখানকার আবাসন ও খাদ্য ব্যবস্থার অব্যবস্থাপনা শিক্ষার্থীদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ক্যান্টিন ও ক্যাফেটেরিয়ার দুর্বল ব্যবস্থাপনা শিক্ষার্থীদের দৈনন্দিন খাদ্যচাহিদা মেটাতে ব্যর্থ হচ্ছে। এর অন্যতম কারণ হলো প্রশাসনিকভাবে এসব ব্যবস্থার তদারকির অভাব। আমার বিশ্বাস, যদি প্রশাসন এই বিষয়গুলোর প্রতি গুরুত্ব দিয়ে নিয়মিত নজরদারি ও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করে, তাহলে ক্যান্টিন ও ক্যাফেটেরিয়ার মান উন্নত হবে এবং এর ফলে শিক্ষার্থীরা যেমন স্বাস্থ্যকর খাদ্য পাবে, তেমনি সার্বিকভাবে তাদের শিক্ষাজীবন আরও কার্যকর ও স্বাচ্ছন্দ্যময় হয়ে উঠবে।

-সাকিব আহাদ, শিক্ষার্থী (৩য় বর্ষ), নিটার

 

রাজু

×