ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১৯ জুলাই ২০২৫, ৪ শ্রাবণ ১৪৩২

দখল-দূষণে অস্তিত্ব সংকটে ঐতিহ্যবাহী হোজা নদী

জিএম কিবরিয়া, দুর্গাপুর, রাজশাহী

প্রকাশিত: ১৮:৩৭, ১৯ জুলাই ২০২৫

দখল-দূষণে অস্তিত্ব সংকটে ঐতিহ্যবাহী হোজা নদী

একসময় হোজা নদীতে চলতো, ডিঙ্গি, কোষা, পানসি, বজরা, সাম্পান, ঘাসি এবং পাতামের মতো অসংখ্য ছোট বড় রঙবেরঙের পালতোলা নৌকা। খরস্রোতা নদীটি পরিপূর্ণ ছিল পানিতে, উৎপাদিত হতো অসংখ্য দেশীয় প্রজাতির মাছ। যা আহরণ করেই জীবন ধারণ করতেন নদীপাড়ের জেলে পরিবারগুলো। এগুলো শুধুই সোনালি অতীত। দখল-দূষণে নাব্যতা হারিয়ে মৃতপ্রায় ঐতিহ্যবাহী হোজা নদীটি। দ্রুত সংস্কারের মাধ্যমে নদীটি বাঁচানোর দাবি জানিয়েছেন সুশীল সমাজ থেকে জনসাধারণ।

নদীটি রাজশাহীর দুর্গাপুর উপজেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে পুঠিয়া উপজেলার ঝলমলিয়া এলাকায় মুসাখান নদে গিয়ে মিলিত হয়েছে। নদীটির দৈর্ঘ্য প্রায় ২৬ কিলোমিটার। এর মধ্যে ৯ কিলোমিটারেই পানির প্রবাহ নেই। অনেক স্থান দখল করে গড়ে তোলা হয়েছে অবৈধ স্থাপনা, কৃষিজমি, বিভিন্ন বাগান, পানবরজ; কোথাও আবার পুকুর কেটে চাষাবাদ করা হচ্ছে মাছ।

দুর্গাপুর উপজেলার পৌর সদরের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা না থাকায় বাজারের সমস্ত বর্জ্য ও ব্যবসায়ীদের নানান উৎকৃষ্ট দ্রব্যাদি ব্রিজের চারিদিকে ফেলা হয়। পচা দুর্গন্ধে নাক চেপে ব্রিজ পারাপার হতে হয় পথচারীদের। এছাড়াও নদীর দুই পাশে নদীর জায়গা দখল করে গড়ে উঠেছে অসংখ্য ব্যক্তিগত স্থাপনা। মন্দির কর্তৃপক্ষ প্রতিবছরেই সংস্কারের নামে নদীর জায়গা দখল করতে থাকে।

দুর্গাপুর পৌরবাসিন্দা গোলাম রাব্বানী জানান, হোজা নদীটি অনেক গভীর স্বচ্ছ পানির প্রবাহ ছিল। আমরা উঁচু ব্রিজ থেকে নদীতে লাফ দিয়ে গোসল করতাম। ছোট ডিঙ্গি নৌকা দিয়ে দেশি প্রজাতির নানান মাছ আহরণ করতাম। নদীটি দখল-দূষণে বর্ষা মৌসুমে কোনো প্রবাহ নেই, শুধু ময়লা আর কচুরিপানায় পরিপূর্ণ। নদীটি খনন করে জীববৈচিত্র্য রক্ষার দাবি জানাচ্ছি।

শতবর্ষী আলহাজ্ব বয়েন উদ্দিন বলেন, আগে রাস্তাগুলোর যাতায়াত ব্যবস্থা ভালো ছিল না। একমাত্র নদীপথেই আমাদের যাতায়াতের মাধ্যম ছিল। এই হোজা নদী ধরে বিভিন্ন এলাকায় যেতাম। হোজা নদীটি কোনো খাল নয়, এটি পূর্ণাঙ্গ খরস্রোতা নদী ছিল, নিয়মিত জোয়ার-ভাটা হতো। এই নদীতে বিশাল বিশাল বোয়াল, গজার, শোল মাছসহ নানা দেশি প্রজাতির মাছ উৎপন্ন হতো। এই নদীতে যত বড় মাছ পেতাম, এখনো কোথাও এমন বড় মাছ দেখা যায় না। শুনেছি পদ্মা নদীতে সুইচগেট দেওয়ার পর থেকেই নদীটি তার সৌন্দর্য ও স্রোতধারা হারিয়েছে। কালের পরিক্রমায় দখল-দূষণে আকার, আয়তন, নাব্যতা হারিয়ে মৃতপ্রায় নদীটি। দ্রুতই কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে নদীটি বাঁচানো দরকার।

নদী গবেষক মাহবুব সিদ্দিকীর বইয়ে হোজা নদীটির কথা লেখা রয়েছে, যেখানে ‘গঙ্গা-পদ্মা-পদ্মাবতী’ শিরোনামে বলা হয়েছে যে, হোজা নদী গঙ্গার প্রশাখা। রাইচান ও দয়া নদীর মিলিত ধারাটি রাজশাহী জেলার পবা উপজেলার ফলিয়ার বিলে পতিত হয়েছে। সেখান থেকে হোজা নামের নদীটি উৎপন্ন হয়ে দুর্গাপুর উপজেলা হয়ে পশ্চিম থেকে পূর্বদিকে গিয়ে পুঠিয়া উপজেলার ঝলমলিয়া এলাকায় মুসাখান নদে গিয়ে পড়েছে। মুসাখান আবার বড়ালে গিয়ে পড়েছে। বড়াল গঙ্গার অন্যতম শাখা নদী।

‘গঙ্গা-পদ্মা-পদ্মাবতী’ বই ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, নদীর উৎসমুখ দুর্গাপুর উপজেলার পলাশবাড়ী থেকে তিন কিলোমিটারের বেশি এলাকায় প্রায় ১২–১৫টি পুকুর কেটে দখল করে মৎস্য চাষাবাদ করা হচ্ছে। বর্ষা মৌসুমে উপজেলার আমগ্রাম থেকে দমদমা বিল পর্যন্ত প্রায় ১৭ কিলোমিটার পানি থাকে। এরপর আবার দমদমা থেকে পুঠিয়া উপজেলা কাঁঠালবাড়ি পর্যন্ত ছয় কিলোমিটার পর্যন্ত ভরাট হয়ে অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে।

দুর্গাপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও পৌর প্রশাসক সাবরিনা শারমিন বলেন, দুর্গাপুর পৌরসভা থেকে সিআর-ডিপি ৩ প্রজেক্টের অধীনে হোজা নদীর ৩৩০০ মিটারের পুনঃখননের প্রক্রিয়া চলমান আছে। পাশাপাশি কচুরিপানা পরিষ্কারের জন্য স্থানীয়ভাবে কিছু কার্যক্রম শুরু করার পরিকল্পনা করা হয়েছে।

এ বিষয়ে রাজশাহী পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)-এর উপ-সহকারী প্রকৌশলী মোঃ আব্দুল হামিদ বলেন, প্রাথমিকভাবে প্রথম প্রস্তাবনায় বারনাই নদী ও বড়াল নদীর জরিপ কাজ সম্পন্ন করে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে নদী দখল, দূষণ ও জলাবদ্ধতা নিরসনে পুনঃখনন প্রস্তাবনা দাখিল করা হয়েছে। পরবর্তীতে হোজা নদীসহ কয়েকটি খালের জরিপ কাজ সম্পন্ন করে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে নদী দখল, দূষণ ও জলাবদ্ধতা নিরসনে পুনঃখনন প্রস্তাবনা প্রেরণ করা হবে এবং বরাদ্দ সাপেক্ষে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

আফরোজা

×