
ছবি: জনকণ্ঠ
সাধারণত বিয়ের কথা উঠলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে আতশবাজির ঝলকানি, মিষ্টির পাহাড়, আত্মীয়স্বজনের কোলাহল আর সাজসাজ রব। কিন্তু বগুড়ার সাবগ্রামের চক আলম গ্রামে ঘটল এক ব্যতিক্রমী, ভালোবাসায় মোড়ানো, হৃদয়ে লেখা বিয়ের গল্প। এখানে বাজেনি উচ্চস্বরে ডিজে, হয়নি বিলাসিতার প্রতিযোগিতা। এই বিয়েতে আমন্ত্রণ পেয়েছেন সমাজের সেই মুখগুলো, যাদের দিকে আমরা তাকাতে ভুলে যাই— বৃদ্ধাশ্রমের প্রৌঢ়া নারী, ধবধবে চুলের বৃদ্ধ, মায়াবী চোখের এতিম শিশুরা আর এলাকার অবহেলিত, নিরন্ন মানুষগুলো।
এই মহৎ উদ্যোগের নায়ক প্রবাসী জাহাঙ্গীর আলম মঞ্জু। একদিন যিনি নিজেও ছিলেন জীবনের কঠিন পথে হাঁটা এক সংগ্রামী মানুষ, আজ তিনি তাঁর মেয়ের বিয়েকে বানালেন ভালোবাসা বিলানোর এক মহোৎসবে।
"আমি একসময় অভাব-অনটনের ভেতর দিয়ে বড় হয়েছি," কাঁপা গলায় বললেন মঞ্জু। "চেয়েছিলাম, মেয়ের বিয়েতে সেই মানুষগুলোকেই পাশে রাখব, যাদের আমরা ভুলে যাই। আজ সে স্বপ্ন সত্যি হয়েছে। এ আনন্দ কোনো অলংকারে মাপা যায় না।"
বিয়ের আসরে বসে ছিলেন বৃদ্ধাশ্রমের দশজন নারী-পুরুষ— চোখেমুখে অপার বিস্ময় আর শিশুর মতো আনন্দ। ছিল ৩০ জন এতিম শিশু, যাদের হাসির ঝিলিক পুরো অনুষ্ঠানকে করে তুলেছিল এক উৎসবমুখর স্বর্গদ্বার। খাবারের পাতে শুধু রান্নার স্বাদ ছিল না, ছিল শ্রদ্ধা আর ভালোবাসার সুবাস।
এই আয়োজনে উপহার নয়, প্রধান অতিথি ছিল সহমর্মিতা। আগেই জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল—এই বিয়েতে কোনো মোড়া ভর্তি উপহার নয়, প্রিয় অতিথিদের হৃদয়ভরা উপস্থিতিই সবচেয়ে বড় দান।
বরপক্ষের লোকজন, জনপ্রতিনিধি, প্রতিবেশীরা সকলেই এই আয়োজন দেখে অভিভূত। বর মোছাদ্দেক হোসেন বললেন, “মানবিকতার এমন উদাহরণ সত্যিই বিরল। আমার আত্মীয় এমন কাজ করেছেন, যা বহুদিন মনে রাখবে সবাই।”
সাবগ্রাম ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ফরিদ উদ্দিন সরকার বললেন, “এই বিয়ে সমাজে এক নবজাগরণ ঘটাবে। আমাদের পারিবারিক অনুষ্ঠানগুলো যদি এমন মানবিক বার্তা দেয়, তবে সমাজ আরও সুন্দর, আরও আলোকিত হবে।”
এই বিয়েতে সোনালি রঙের কার্ড ছিল না, ছিল আতিথেয়তার কোমল হাত। ছিল না চকমকে গয়নাগাঁটি, কিন্তু ছিল মন ছুঁয়ে যাওয়া হাসিমুখ। আনন্দের চেয়েও গভীর ছিল এর অর্থ— মানুষ হয়ে মানুষের পাশে দাঁড়ানো।
চক আলম গ্রামের আকাশ যেন একটু বেশি নীল ছিল সেই দিন। পুষ্পবৃষ্টিতে নয়, ভালোবাসার সিক্ততায় জেগে উঠেছিল নবদম্পতির নতুন জীবনের সূর্য। এই বিয়ে শুধু দুটো মানুষের নয়, ছিল এক নতুন মানবতার, এক নির্মল সৌন্দর্যের, এক নিঃশব্দ বিপ্লবের।
এম.কে.