ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১ আশ্বিন ১৪৩১

জেলিফিশ

অমেরুদণ্ডী প্রাণী, সব মহাসাগরে দেখা মেলে

এইচএম এরশাদ, কক্সবাজার 

প্রকাশিত: ২৩:৪০, ৫ আগস্ট ২০২৪

অমেরুদণ্ডী প্রাণী, সব মহাসাগরে দেখা মেলে

কক্সবাজার উপকূলে জেলিফিশ

বঙ্গোপসাগরে কমছে সামুদ্রিক কাছিম, বাড়ছে জেলিফিশ!
বঙ্গোপসাগরে সামুদ্রিক কাছিমের সংখ্যা দিন দিন কমছে আর বেড়ে যাচ্ছে জেলিফিশের সংখ্যা। এর ফলে সাগরে মাছের প্রাচুর্য কমছে আর সাগরের পরিবেশগত ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। এই অবস্থায় সামুদ্রিক কাছিমের প্রতি গুরুত্ব দেওয়া উচিত মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
জেলিফিস এক ধরনের অমেরুদ-ী প্রাণী যাদের পৃথিবীর সব মহাসাগরে দেখতে পাওয়া যায়। নামে ‘ফিশ’ হলেও এটি মাছ নয়; এর মেরুদ- নেই। ঘণ্টাকৃতি জেলিসদৃশ প্রাণীটি প্রাণীজগতের নিডারিয়া পর্বের সিফোজোয়া শ্রেণির অন্তর্গত। জেলিটিন সমৃদ্ধ ছাতার মতো অংশ এবং ঝুলে পড়া কর্ষিকা - এ দুই অংশে প্রাণীটির দেহ গঠিত। একটি স্বাস্থ্যকর সমুদ্রের প্রয়োজনীয় অঙ্গ হিসেবে বিবেচিত সী-টার্টল বা সামুদ্রিক কচ্ছপ।

এটি পরিবেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ বা ‘কী-স্টোন প্রজাতি’ হিসেবেও বিবেচিত। পরিবেশে এই ধরনের প্রজাতির বেঁচে থাকার ওপর নির্ভর করে আরও বহু প্রজাতির প্রাণীর অস্তিত্ব। কাছিমকে ‘সামুদ্রিক ঝাড়ুদার’ও বলা হয়। এরা সমুদ্রের পচাগলা বস্তু খেয়ে দূষণ পরিষ্কার করে।   
সামুদ্রিক কাছিম পানির বাইরেও ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। এরা স্থলে ও সমুদ্রে একটি খাদ্য জালের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে কাজ করে। এরা সৈকতের বালিয়াড়িতে বাসা বেঁধে ডিম পাড়ার মাধ্যমে সৈকতকেও পরিবেশগতভাবে সাহায্য করে থাকে। সামুদ্রিক কচ্ছপের ডিমের খোসা মাটিতে গুরুত্বপূর্ণ পুষ্টি সরবরাহ করে, যা টিলা বা বালিয়াড়ির গাছপালা ও অন্যান্য উদ্ভিদকে পুষ্ট করে। আর এর মাধ্যমে বালিয়াড়িকে স্থিতিশীল করে, উপকূলীয় ক্ষয় রোধ করতে সহায়তা এবং সাগরতীরের  জৈব প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় সহায়ক ভূমিকা পালন করে আসছে যুগ যুগ ধরে।
বিজ্ঞানীরা জানান, বিশ্বে সাত প্রজাতির সামুদ্রিক কচ্ছপ রয়েছে। এরমধ্যে ফ্ল্যাটব্যাক (নাটাটোর ডিপ্রেসাস), সবুজ কাছিম (চেলোনিয়া মাইডাস), হক্সবিল (ইরথমোচেলিস ইব্রিকাটা), লেদারব্যাক (ডার্মোচেলিস করিয়াসিয়া), লগারহেড (ক্যারেটা কেরেটা), অলিভ রিডলি (লেপিডোচেলিস অলিভাসিয়া) এবং কেম্পস রিডলি (লেপিডোচেলিস কেম্পি)।

এরমধ্যে বঙ্গোপসাগরে অলিভ রিডলি, হক্সবিল ও গ্রীণ টার্টলসহ তিন থেকে পাঁচ প্রজাতির সামুদ্রিক কাছিম শনাক্ত হয়েছে। তবে  সাম্প্রতিককালে অলিভ রিডলি কাছিম ছাড়া অন্য কাছিম ডিম পাড়তে কক্সবাজার উপকূলে আসছে না। অলিভ রিডলি ও হক্সবিলের প্রজননকাল নভেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত। আর গ্রিন কাছিম এর প্রজননকাল জুন থেকে নভেম্বর পর্যন্ত।

তবে গত ৫ বছর ধরে কক্সবাজার উপকূলের কোথাও হক্সবিল বা ভূত কচ্ছপ এবং ৩ বছর ধরে গ্রিন টার্টল বা সবুজ রঙা কচ্ছপ ডিম পাড়তে আসার তথ্য নেই বলে জানান সমুদ্রবিজ্ঞানীরা। একসময় কক্সবাজার সৈকতে শত শত কাছিম ‘অ্যারিবদা’ বা ডিম পাড়তে আসত। কিন্তু সাম্প্রতিককালে এই হার একেবারেই কমে গেছে। 
সংশ্লিষ্টদের মতে, এক দশক আগেও কক্সবাজার উপকূলে ডিম পাড়তে আসা তিন প্রজাতির কাছিমের মধ্যে ৯৯ শতাংশ ভাগই ছিল অলিভ রিডলি টার্টল বা জলপাই রঙা কাছিম। বাকি একভাগ ছিল গ্রিন টার্টল (সবুজ রঙা কাছিম) ও হক্সবিল টার্টল (ভূত কাছিম)। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কেবল এক প্রজাতির কাছিমই ডিম পাড়তে আসছে কক্সবাজার সৈকতে।

২০১২ সালের বন্যপ্রাণি (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইনে বাংলাদেশে সামুদ্রিক কচ্ছপ সংরক্ষিত প্রজাতি হিসেবে তালিকাভুক্ত। এগুলো শিকার করা, খাওয়া, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ পরিবহন ও ক্রয়বিক্রয় করা দ-নীয় অপরাধ। আন্তর্জাতিক প্রকৃতি সংরক্ষণ সংস্থা আইইউসিএন এর তালিকায় বাংলাদেশে সব কাছিমের অবস্থান বিপন্ন। বিজ্ঞানীরা জানান, বিভিন্ন প্রজাতির সামুদ্রিক কচ্ছপ বিভিন্ন জিনিস খায়, যদিও তাদের বেশিরভাগই জেলিফিশ পছন্দ করে।

তবে লেদারব্যাক ও হক্সবিল সামুদ্রিক কচ্ছপই বেশি জেলিফিশ খেতে পছন্দ করে। আর এরমাধ্যমে সামুদ্রিক কচ্ছপরা সাগরে জেলিফিশের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণে রাখে। যদি সাগরে লেদারব্যাক ও হক্সবিল না থাকে, তাহলে জেলিফিশের সংখ্যা বিস্ফোরিত হয়। 
জেলিফিশ লার্ভা মাছ শিকার করে। ফলে জেলিফিশ বেড়ে গেলে সাগরে মাছের সংখ্যা কমে যায়। এতে সাগরের প্রাণবৈচিত্র্য ও পরিবেশগত ভারসাম্য নষ্ট হয়। তবে কচ্ছপের সবচেয়ে বড় শত্রু হিসেবে বিবেচিত প্লাস্টিক। এরা জেলিফিশ ভেবে প্লাসিক খেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়ছে। সাগরে প্রতি ২টি কাছিমের একটি প্লাস্টিক ভক্ষণ করে।
বিজ্ঞানীরা জানান, সামুদ্রিক কচ্ছপ সারা বিশ্বের মহাসাগরে বাস করে এবং কিছু কাছিম ৮০ থেকে ১০০ বছর বয়স পর্যন্ত বাঁচে। সামুদ্রিক কচ্ছপগুলি বারনাকল এবং অন্যান্য ছোট ক্রাস্টেসিয়ান, রেমোরাস, শেওলা এবং ডায়াটমের মতো ‘জলজ হিচহাইকারদের’ জন্য আবাসস্থল সরবরাহ করে। যেহেতু সামুদ্রিক কচ্ছপগুলি দীর্ঘ পথ পাড়ি দেয়। তারা মাছের জন্য ছাতার মতো কাজ করে, যা শিকারিদের থেকে আশ্রয় প্রদান করে।

সামুদ্রিক কচ্ছপগুলিও কখনো কখনো সামুদ্রিক পাখিদের অবতরণ করার জন্য একটি বিশ্রামের জায়গা প্রদান করে, সরীসৃপ বিমানবাহী বাহকের মতো!
বিজ্ঞানীরা অনুমান করেছেন যে, সামুদ্রিক কচ্ছপ ১১ কোটি বছর ধরে সাগরে সাঁতার কাটছে। এরা নিজেদের শ^াস প্রশ^াস পাঁচ ঘণ্টা পর্যন্ত আটকে রাখতে পারে। বাচ্চা সামুদ্রিক কচ্ছপের লিঙ্গ বাসার তাপমাত্রার ওপর নির্ভর করে। সাধারণত ৩১ থেকে ৩২ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় ডিম ফোটানো হলে শুধুমাত্র স্ত্রী কাছিম হয়। আর ২৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা তার কম তাপমাত্রায় ডিম ফোটানো হলে শুধু পুরুষ বাচ্চা উৎপাদন হয়। আর ২৯ থেকে ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের তাপমাত্রায় স্ত্রী-পুরুষ মিশ্র-লিঙ্গের বাচ্চা ফোটে।

এক হাজার বাচ্চা থেকে মাত্র একটি বাচ্চা পরিবেশে বড় হওয়ার সুযোগ পায়। এরা দীর্ঘ দূরত্ব সাঁতার কাটতে পারে। একটি মহিলা লেদারব্যাক ৬৪৭ দিনে প্রায় ১৩,০০০ মাইল সাঁতার কাটার রেকর্ড গড়েছে। সামুদ্রিক কচ্ছপ পৃথিবীর চৌম্বক ক্ষেত্র অনুধাবন করতে এবং এটিকে কম্পাস হিসেবে ব্যবহার করতে সক্ষম। এটি মাইগ্রেশনের সময় বিশেষভাবে সহায়ক। সামুদ্রিক কচ্ছপ প্রতি বছর একই  সৈকতে ডিম পাড়ার জন্য ফিরে আসে।

আর আগের বাসাটি যেখানে ছিল তার ১০০ গজের মধ্যে ডিম পাড়ে।
কচ্ছপদের দাঁত নেই। কচ্ছপ ব্যতিক্রমীভাবে শক্তিশালী ওপরের এবং নিচের চোয়াল থাকে, যা কেরাটিন দিয়ে তৈরি। কচ্ছপের খোলস হাড় দিয়ে তৈরি। এদের শেলগুলিতে ৫০টিরও বেশি হাড় মিশ্রিত থাকে। তাই কচ্ছপের খোলস মানে তাদের হাড়।

×