ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

কর্মবিরতি অব্যাহত রাখার ঘোষণা ॥ গণপদত্যাগের হুমকি

খুলনায় চিকিৎসকদের ধর্মঘট, অবর্ণনীয় দুর্ভোগে রোগীরা

স্টাফ রিপোর্টার, খুলনা অফিস

প্রকাশিত: ০০:০২, ৩ মার্চ ২০২৩

খুলনায় চিকিৎসকদের ধর্মঘট, অবর্ণনীয় দুর্ভোগে রোগীরা

চিকিৎসকদের কর্মবিরতিতে খুলনা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা রোগী ও স্বজনরা পড়েন বিড়ম্বনায়

চিকিৎসকদের টানা দুদিনের ধর্মঘটে সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিক কোথাও মিলছে না চিকিৎসাসেবা। রোগীরা কাতরাচ্ছেন হাসপাতালের বেডে। শহীদ শেখ আবু নাসের বিশেষায়িত হাসপাতালের প্লাস্টিক সার্জারি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. নিশাত আব্দুল্লাহর ওপর হামলাকারী পুলিশের এএসআই নাঈমুজ্জামানকে গ্রেপ্তার ও তার স্ত্রীর দায়ের করা মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার করা না পর্যন্ত চিকিৎসকদের কর্মবিরতি অব্যাহত রাখার ঘোষণা দিয়েছে চিকিৎসকরা।

প্রয়োজনে গণপদত্যাগের হুমকিও দিয়েছেন তারা। এতে করে স্থবির হয়ে পড়েছে খুলনা স্বাস্থ্যসেবা। তবে ডা. শেখ নিশাত আব্দুল্লাহর ওপর হামলার ঘটনার মামলায় সাতক্ষীরা সদর থানার সহকারী পরিদর্শক (এএসআই) নাঈমুজ্জামান শেখকে পুলিশ লাইনে ক্লোজ করা হয়েছে। অন্যদিকে, শ্লীলতাহানি ও স্বামীর বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি করার অভিযোগ এনে বৃহস্পতিবার দুপুরে খুলনা প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলনে ডা. নিশাত আব্দুল্লাহর বিচারের দাবি জানিয়েছেন ওই এএসআইএর স্ত্রী নুসরাত আরা ময়না।
বৃহস্পতিবার সকাল ৮টার দিকে খুলনা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগ ও বহির্বিভাগের সামনে গিয়ে দেখা যায়, রোগীদের বিশাল লাইন। রোগীদের কেউ এসেছেন, শহরের এ প্রান্ত থেকে, কেউ এসেছেন অপর প্রান্ত থেকে। আবার কেউ এসেছেন, দূরের কোনো জেলা থেকে। তারা সবাই এসেছেন চিকিৎসক দেখানোর জন্য। তবে, দীর্ঘ সময়েও চিকিৎসকের দেখা না পেয়ে তারা চিকিৎসা সেবা বঞ্চিত হয়ে ফিরে যেতে বাধ্য হন। হাসপাতালে ভর্তি থাকা যশোরের মনিরামপুলের লক্ষণ দাসে স্বজনরা জানান, আমরা নিরুপায়। তাই এখানে পড়ে আছি।

এভাবে কোনো সরকারি হাসপাতাল থাকতে পারে না। তিন দিন আগের প্রেসক্রিপশন দিয়ে ওষুধ খাওয়াচ্ছি। নতুন ওষুধ দিলে হয়ত রোগী ভালো হতো। কিন্তু করব কি! সাতক্ষীরা থেকে আসা আমেনা খাতুন বলেন, আমি ক্যান্সারের রোগী। পরীক্ষা করানোর পর ডাক্তার দেখাতে এসেছিলাম কিন্তু এসে শুনি কর্মবিরতির কারণে ডাক্তাররা আজও রোগী দেখবে না। এতদূর থেকে এসে আবার ফিরে যেতে হচ্ছে। খুলনায় কোনো থাকার জায়গা নেই তাই করার কিছুও নেই।
এ বিষয়ে খুলনা মেডিক্যাল কলেজ (খুমেক) হাসপাতালের পরিচালক ডা. রবিউল হাসান জানান, গত দুদিন হাসপাতালে ৩৭ জন রোগীর মৃত্যু হয়েছে। তবে, চিকিৎসকদের অবহেলায় কোনো রোগীর মৃত্যু হয়নি। তাদের স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে বলে তিনি উল্লেখ করেন। এ রকম মৃত্যু প্রতিদিনই হাসপাতালে হয় বলে তিনি জানান। তিনি বলেন, চিকিৎসকদের কর্মবিরতির কারণে হাসপাতালের বহির্বিভাগ বন্ধ থাকলেও জরুরি বিভাগ খোলা রয়েছে। সেখানে রোগীদের স্বাভাবিক চিকিৎসাসেবা দেওয়া হচ্ছে।
এদিকে, সাতক্ষীরার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সজীব খান জানান, শহীদ শেখ আবু নাসের বিশেষায়িত হাসপাতালের প্লাস্টিক সার্জারি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. শেখ নিশাত আব্দুল্লাহর ওপর হামলার ঘটনায় দায়ের করা মামলায় সাতক্ষীরা সদর থানার সহকারী পরিদর্শক (এএসআই) নাঈমুজ্জামান শেখকে পুলিশ লাইনে ক্লোজ করা হয়েছে। বিষয়টি বর্তমানে তদন্তাধীন রয়েছে।

এদিকে চিকিৎসকদের আন্দোলনের মধ্যে শ্লীলতাহানি ও স্বামীর বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি করার অভিযোগ এনে ডা. নিশাত আব্দুল্লাহর বিচারের দাবি জানান এএসআই নাঈমের স্ত্রী নুসরাত আরা ময়না। বৃহস্পতিবার দুপুরে খুলনা প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলনে নুসরাত আরা ময়না বলেন, ডা. নিশাত আব্দুল্লাহ আমার স্বামীর বিরুদ্ধে যে এজাহার দায়ের করেন তাতে ২৫ ফেব্রুয়ারি রাত আনুমানিক ১০টায় আর ডা. বাহারুল আলম সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, আমার স্বামী ওই দিন রাত ১টায় সময় ডা. নিশাত আব্দুল্লাহর ওপর হামলা করেছেন।

কিন্তু আমার কাছে রাত ১১টা ৫৪ মিনিটের একটি ৪৪ সেকেন্ডের ভিডিও ক্লিপ রয়েছে, যেখানে দেখা যাচ্ছে, ডাক্তার নিশাত সম্পূর্ণ সুস্থ ও ভাঙচুরের কোনো আলামত নেই। আমার প্রশ্ন হচ্ছে, কখন মারধর ও ভাঙচুর হলো? এ বিষয়টি দেখার জন্য নগরীর হক নার্সিং হোমে গেলে অপারেশন কিংবা অন্য কোনো স্থান ভাঙচুরের আলামত পাওয়া যায়নি। তিনি আরও বলেন, বিএমএ কর্মকর্তারা শুধু এক পক্ষের অভিযোগের ভিত্তিতেই যে কর্মবিরতি পালন করছে, সেটা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক ও রাষ্ট্রীয় আচার-আচরণের পরিপন্থি।

সংবাদ সম্মেলনে তিনি সমাজের জাগ্রত বিবেক, নারী কল্যাণ সংস্থা, হিউম্যান রাইটস অ্যাসোসিয়েশন, মানবাধিকার কল্যাণ সংস্থাসহ সকলের প্রতি সোচ্চার হওয়ার আহ্বান জানান। প্রধানমন্ত্রীর সুদৃষ্টি কামনাসহ তার মেয়ের সুচিকিৎসারও দাবি জানান তিনি।
অপরদিকে অভিযুক্ত পুলিশের এএসআই নাঈমুজ্জামানকে গ্রেপ্তার ও তার স্ত্রীর দায়ের করা মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার করা না পর্যন্ত কর্মবিরতি অব্যাহত রাখার ঘোষণা দিয়েছে খুলনা বিএমএ। এ ছাড়া চিকিৎসকরা আগামীকাল শনিবার বেলা ১২টায় শহীদ শেখ আবু নাসের বিশেষায়িত হাসপাতালে বিক্ষোভ সমাবেশ করার ঘোষণা দিয়েছে। একইদিন সন্ধ্যা ৭টায় বিএমএ ভবন মিলনায়তনে জরুরি সাধারণ সভা অনুষ্ঠিত হবে। প্রয়োজনে ওই দিন চিকিৎসকরা গণপদত্যাগের করবেন।

বৃহস্পতিবার দুপুর আড়াইটায় বিএমএ ভবনে এক সংবাদ সম্মেলনে এ ঘোষণা দেন খুলনা বিএমএর সভাপতি ডা. শেখ বাহারুল আলম। এ সময় সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক ডা. মেহেদী নেওয়াজসহ নির্বাহী কামিন বিভিন্ন সদস্য উপস্থিত ছিলেন।
তিনি আরও বলেন, এই সংকটময় মুহূর্তে রোগীরা চিকিৎসা সেবা পাচ্ছে না। এ দায় সরকারের। এ ছাড়া এএসআই নাঈমুজ্জামানকে পুলিশ গ্রেপ্তার না করে পক্ষপাতমূলক আচরণ করছে বলে আমাদের মনে হয়েছে। ডা. নিশাত আব্দুল্লাহর বিরুদ্ধে এএসআই নাঈমের স্ত্রীর আনা শ্লীলতাহানির সম্পর্কে ডা. বাহারুল আলম সংবাদ সম্মেলনে বলেন, কাউন্টার হিসেবে মিথ্যা তথ্য দিয়ে এই মামলা সাজানো হয়েছে। যদি ঘটনা সত্য হতো তাহলে তিনি কেন আগে মামলা করেননি।
প্রসঙ্গত, ডা. নিশাত আবদুল্লাহর ওপর হামলার প্রতিবাদে গত বুধবার সকাল ৬টা থেকে কর্মবিরতি শুরু করেন চিকিৎসকরা। এতে করে খুলনা মহানগরীসহ জেলার সব সরকারি হাসপাতাল-বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকে চিকিৎসা সেবা কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়ে। বন্ধ রয়েছে ল্যাব কিংবা ডায়াগনস্টিকও। প্রথম এক দিনের জন্য কর্মবিরতি ঘোষণা করলেও সেটি পরে চলমান রাখে বিএমএ খুলনা।

×