ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

সিরাজগঞ্জ-২

বড় দু’দলেই রয়েছে বিভেদ

বাবু ইসলাম, সিরাজগঞ্জ

প্রকাশিত: ০০:১০, ৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৩

বড় দু’দলেই রয়েছে বিভেদ

জেলার প্রাণ এবং মর্যাদাপূর্ণ আসন হিসেবে পরিচিত সিরাজগঞ্জ-২

জেলার প্রাণ এবং মর্যাদাপূর্ণ আসন হিসেবে পরিচিত সিরাজগঞ্জ-২ (সদর ও কামারখন্দ) আসনটি। ভিআইপি হিসেবে পরিচিতি এ আসন থেকে বিএনপি ও আওয়ামী লীগের প্রার্থী যারাই বিজয়ী হয়েছেন তারা একাধিকবার মন্ত্রিত্ব পেয়েছেন। সিরাজগঞ্জ জেলা সদর থেকেই নিয়ন্ত্রিত হয় জেলার রাজনীতি। জেলার ব্যাপক উন্নয়ন সামনে রেখে আওয়ামী লীগ আসনটি ধরে রাখতে এবং হারানো আসনটি পুনরুদ্ধারে মরিয়া বিএনপি। আগামী নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বড় এই দু’দলেই রয়েছে অভ্যন্তরীণ বিভেদ। 
বঙ্গবন্ধু সেতুর পশ্চিমপাড়ের সিরাজগঞ্জ সদর এবং কামারখন্দ উপজেলা নিয়ে এ আসনটি গঠিত। অনলবর্ষী বক্তা সৈয়দ ইসমাইল হোসেন সিরাজী, মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী, গণিত সম্রাট যাদব চক্রবর্তী, সুফি আফজাল মাহমুদের মতো বহু মনীষীর পুণ্যভূমি সিরাজগঞ্জ সদরের এ আসনটি অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ। স্বাধীনতার পর দলের গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক নেতারা এ আসনে নির্বাচন করেছেন। আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতিম-লীর সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম এ আসনে একাধিকবার নির্বাচন করেছেন। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকুও এ আসনের নির্বাচিত সংসদ সদস্য ছিলেন। 
সরকারের উন্নয়নে সর্বদা জেলা সদরকেই প্রাধান্য দেওয়া হয়। আওয়ামী লীগ সরকারের একটানা তৃতীয় মেয়াদে সিরাজগঞ্জের উন্নয়ন সর্বাধিক গুরুত্ব পেয়েছে। জাতীয় নেতা শহীদ এম মনসুর আলীর নামে সিরাজগঞ্জে মেডিক্যাল কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, যমুনাপাড়ে বিদ্যুত উৎপাদন কেন্দ্র স্থাপিত হয়েছে। যমুনা নদীর ওপর বঙ্গবন্ধু সেতু নির্মাণের পর রেলওয়ের মেগা প্রকল্প শেখ মুজিব রেল সেতুর নির্মাণ কাজ শুরু হয়েছে। এক লাখ শ্রমিকের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থায়  বঙ্গবন্ধু সেতুর পশ্চিম পাদদেশে চারশ’ একর জমির ওপর শিল্প মন্ত্রণালয়ের বিসিক শিল্প পার্ক নির্মাণ কাজ শেষ পর্যায়ে। এক হাজার একর জমির ওপর বেসরকারি অর্থনৈতিক অঞ্চলের নির্মাণ কাজ এগিয়ে যাচ্ছে। 
ব্যাপক ও বিস্তৃত উন্নয়ন এবং মর্যাদাপূর্ণ এ আসনে আওয়ামী লীগ দলীয় মনোনয়ন প্রত্যাশীদের সংখ্যাও এবার বেশি। বিএনপির একক প্রার্থী হলেও দুই বৃহত্তম দলেই রয়েছে দলীয় কোন্দল। ২০১৪ সাল থেকে একটানা দুই মেয়াদে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের উন্নয়ন কর্মকা- এবং গণসংযোগ এত ব্যাপক এবং বিস্তৃত হয়েছে যে, এতে সচেতন অনেক ভোটারের মুখে উঠে এসেছে আগামী নির্বাচনেও এগিয়ে থাকবে নৌকা প্রতীকের প্রার্থী। তবে বিএনপি নির্বাচনে এলে এই আসনে আওয়ামী লীগের সঙ্গে ভোটযুদ্ধ তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হতে পারে। এ আসনে মোট ভোটার তিন লাখ ৫০ হাজার ৮৯৬ জন। 
সিরাজগঞ্জ পৌরসভা, সদর উপজেলার ছয়টি ও কামারখন্দ উপজেলার চারটি ইউনিয়ন নিয়ে সিরাজগঞ্জ-২ আসন গঠিত। এ আসনে ১৯৯১, ২০০১ এবং ২০০৮ সালের নির্বাচনে বিএনপি প্রার্থী বিজয়ী হয়েছিলেন।  ১৯৯৬ এবং ২০১৪ এবং ২০১৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী বিজয়ী হন। ২০১৪ এবং ২০১৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে বিপুল ভোটে বিজয়ী বর্তমান সংসদ সদস্য অধ্যাপক ডা. হাবিবে মিল্লাত মুন্না এ আসনে আগামী নির্বাচনে শক্ত প্রার্থী।

জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা অ্যাডভোকেট কেএম হোসেন আলী হাসানও মনোনয়ন প্রত্যাশী। কেন্দ্রীয় মহিলা আওয়ামী লীগের সাবেক যুগ্ম সম্পাদক ২০০৮ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিয়ে সামান্য সংখ্যক ভোটের ব্যবধানে পরাজিত ড. জান্নাত আরা তালুকদার হেনরিও নির্বাচনী এলাকায় মাঠে কাজ করছেন। সভা-সমাবেশে সক্রিয়ভাবে অংশ নিচ্ছেন। 

রাজনীতিতে ক্লিন ইমেজের দাবিদার সিরাজগঞ্জ পৌরসভার দুই-দুইবার বিপুল ভোটের ব্যবধানে নির্বাচিত পৌর মেয়র এবং জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক কমিটির সহসভাপতি সৈয়দ আব্দুর রউফ মুক্তা দলের প্রতিটি কর্মকা-ে সরাসরি অংশ নিয়ে, জনগণের সঙ্গে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখে মনোনয়নের প্রত্যাশায় কাজ করছেন। প্রবাসী আওয়ামী লীগ নেতা বীর মুক্তিযোদ্ধা ডা. মাসুদুল হাসানও দেশে ফিরেছেন, ভেতরে ভেতরে মনোনয়ন পেতে কেন্দ্রে যোগাযোগ রাখছেন। 
অন্যদিকে, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও সাবেক বিদ্যুত প্রতিমন্ত্রী ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু এ আসনে একক প্রার্থী। কোনো কারণে ইকবাল হাসান মাহমুদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে না পারলে সেক্ষেত্রে তাঁর সহধর্মিণী ও জেলা বিএনপির সভাপতি সাবেক এমপি রুমানা মাহমুদ দলীয় মনোনয়নের প্রথম তালিকায়। জাতীয় পার্টির  সিরাজগঞ্জ জেলা কমিটির সভাপতি আমিনুল ইসলাম ঝন্টু এই আসনে দলের একক প্রার্থী হিসেবে মাঠে রয়েছেন। ১৪ দলীয় জোটের শরিক জাসদ থেকে মনোনয়ন চাইবেন আবু বকর ভুঁইয়া। তবে আগামী নির্বাচনেও এই আসনে আওয়ামী লীগের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হবেন বিএনপির প্রার্থীই।
আওয়ামী লীগ সরকারে একটানা দু’বারের সংসদ সদস্য অধ্যাপক ডা. হাবিবে মিল্লাত মুন্না বলেন, জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আমার নির্বাচনী এলাকায় গ্রামীণ অবকাঠামো থেকে শুরু করে মসজিদ, মাদ্রাসা,স্কুলসহ সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের উন্নয়ন করা হয়েছে। স্বাস্থ্য ব্যবস্থা উন্নয়নে আমার নির্বাচনী এলাকাতেই শহীদ এম মনসুর আলী মেডিক্যাল কলেজ স্থাপন করা হয়েছে। শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের জন্য টিচার্স ট্রেনিং সেন্টার, প্রশিক্ষিত জনবল গড়ে তোলার জন্য মেরিন ইন্সটিটিউটসহ জনগণকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি পূরণসহ  অন্যান্য  উন্নয়ন কাজ সম্পন্ন করা হয়েছে। আমার নির্বাচনী এলাকাকে মাদকমুক্ত ঘোষণা করা হয়েছে।  
মনোনয়ন প্রত্যাশী জেলা আওয়ামী লীগের প্রবীণ নেতা বীর মুক্তিযোদ্ধা অ্যাডভোকেট কেএম হোসেন আলী হাসান দলের সভাপতি বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বলেন, রাজনৈতিক জীবনে অনেক এমপির মনোনয়নের জন্য সহযোগিতা করেছি। দলীয় প্রার্থীর পক্ষে নির্বাচনের মাঠে কাজ করেছি। বয়সের শেষ প্রান্তে এসে মনোনয়ন পেয়ে একবার এমপি হওয়ার প্রত্যাশা করছি।
বিএনপি প্রার্থী দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু অনেকটাই নিশ্চিত। দলের মুখপাত্র হিসেবে জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক সাইদুর রহমান বাচ্চু জনকণ্ঠকে দেওয়া প্রতিক্রিয়ায় বলেন, বিএনপি নির্বাচনমুখী দল। কিন্তু অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে একটি বিষয় পরিষ্কারÑ দলীয় সরকারের অধীনে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। তাই নির্দলীয়, নিরপেক্ষ সরকার ছাড়া বিএনপি নির্বাচনে যাবে না। যদিও সরকারের প্রতিহিংসার শিকার হয়ে দলের নেতাকর্মীরা হামলা, মামলা এবং নির্যাতনের শিকার। তার পরও সিরাজগঞ্জে দল সুসংগঠিত রয়েছে। নির্বাচনের পরিবেশ ফিরে পেলে এবং জনগণ ভোট দেওয়ার সুযোগ পেলে  এ আসন থেকে বিএনপি প্রার্থী বিজয় লাভ করবে এবং আসনটি পুনরুদ্ধার হবে। 
১৪ দলীয় জোটের শরিক জেলা জাসদের সাধারণ সম্পাদক আবু বকর ভুইয়া বলেন, ১৪ দলীয় জোটের শরিক হিসেবে সিরাজগঞ্জে দল মনোনয়ন দিলে অধিকতর গুরুত্ব দিয়ে সিরাজগঞ্জের উন্নয়ন করা হবে। দুর্নীতি ও মাদককে পেছনে ফেলে সাধারণ মানুষের কল্যাণে কাজ করার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন তিনি।
গুরুত্বপূর্ণ এই নির্বাচনী এলাকায় শিক্ষিত, মার্জিত, সৎ এবং চৌকস রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বকেই অভিভাবকত্বের মর্যাদায় বসাতে চায় এ আসনের সাধারণ ভোটার। এ আসনে অন্যান্য রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দের প্রার্থী হবার খবর শোনা গেলেও মূলত আওয়ামী লীগ ও বিএনপির প্রার্থীদের মধ্যেই মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে বলে ভোটাররা মনে করছেন। তারা মনে করেন, আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এ আসনে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থীর জয়ের সম্ভাবনাই বেশি।

×