ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

আলী আসগর ফটিক

যুদ্ধদিনের স্মৃতি

রাজীব হাসান কচি, চুয়াডাঙ্গা

প্রকাশিত: ২৩:৪২, ৮ ডিসেম্বর ২০২২

যুদ্ধদিনের স্মৃতি

আলী আসগর ফটিক

একাত্তরের ৫ আগস্ট। দিনটি ছিল বৃহস্পতিবার। সকালে চুয়াডাঙ্গা ও  মেহেরপুর জেলার সীমান্তবর্তী জয়পুরে আমরা মুক্তিযোদ্ধারা সবাই ঘুমিয়ে। এমন সময় খবর এলো পার্শ্ববর্তী গ্রামের রাস্তা দিয়ে পাক বাহিনীর একটি দল দামুড়হুদা উপজেলার নাটুদহ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে তাদের ক্যাম্পে ফিরবে।  আমরা তাদের আক্রমণের প্রস্তুতি নিচ্ছি।

এমন সময় মেহেরপুরের বাগুয়ান গ্রামের শান্তি কমিটির সেক্রেটারি কুবাত খান সাধারণ মানুষের ছদ্মবেশে আমাদের খবর দেয় ওই গ্রামের মাঠ থেকে দুজন রাজাকার জোরপূর্বক ধান কেটে নিয়ে যাচ্ছে। খবর পেয়ে বীর মুক্তিযোদ্ধা হাসান জামান, তারিক,  খোকন, কাশেম ও পিন্টু মুহূর্তের মধ্যে ঘটনাস্থলে ছুটে যায়।
তাদের পথ চিনিয়ে নিয়ে যায় সহযোদ্ধা আফাজ ও আশা। সেখানে গিয়ে তারা দেখে কেউ নেই। দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে আফাজ বোকামি করে নিজের থ্রি নট থ্রি রাইফেলের ফাঁকা গুলি ছোড়ে। জবাবে পাক হানাদারদের বৃষ্টির মতো গুলি ছুটে আসে। তারা লক্ষ্য করে অগণিত পাক সৈন্য মাটিতে শুয়ে গুলি ছুড়ছে। অবস্থা বেগতিক বুঝে ওই ৭ জন মুক্তিযোদ্ধা বাগোয়োন গ্রামে ফিরে আসে।

খবর পেয়ে জয়পুর শেল্টার থেকে আমরা ২৪ জন মুক্তিযোদ্ধা তাদের সঙ্গে যোগ দেই। এরপর আগ্নেয়াস্ত্র সজ্জিত ৩১ জন মুক্তিযোদ্ধা পাক হানাদার বাহিনীর সঙ্গে সম্মুখযুদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নেই।  সে অনুযায়ী আমরা দুটি ভাগে ভাগ হয়ে পাক সৈন্যদের দিকে এগুতে থাকি। এক সময় আমাদের প্রথম দলটি পাক হানাদারদের ইউ আকারের অ্যাম্বুসের ফাঁদে পড়ে যায়। হঠাৎ হানাদাররা বৃষ্টির মতো গুলিবর্ষণ শুরু করে। এ অবস্থায় আমাদের পিছু হটে যাওয়া ছাড়া কোন উপায় ছিল না।

সহযোদ্ধাদের বাঁচাতে হাসান জামান কাভারিং ফায়ারের দায়িত্ব নিয়ে শহীদ হন। পিছু হটে যাওয়ার সময় কিয়ামুদ্দিনের মাথায় গুলি লাগলে সেও ঘটনাস্থলে শহীদ হয়। এ সময় আমরা ২৩ জন মুক্তিযোদ্ধা অনেক কষ্টে নিরাপদ আশ্রয়ে পৌঁছাই। কিন্তু কাশেম, আফাজ, রবিউল, তারিক, রওশন ও খোকনকে পাক সৈন্যরা চারদিক থেকে ঘিরে ফেলে। তারা তাদেরকে খুব কাছ  থেকে গুলি করে ও বেয়োনেট দিয়ে খুঁচিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে।

এ সম্মুখ যুদ্ধে হানাদার বাহিনীর অর্ধশতাধিক সৈন্য নিহত হয়। মহান বিজয়ের মাসে এভাবেই যুদ্ধদিনের স্মৃতি তুলে ধরেন সাবেক চুয়াডাঙ্গা  পৌর মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আলী আজগর ফটিক। তিনি  পৌর এলাকার রেলপাড়ার বাসিন্দা। দেশ স্বাধীনের পর বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীর কনস্টেবল পদে চাকরি নেন। পরবর্তীতে এসআই পদে পদোন্নতি পেয়ে অবসরে আসেন।
৭১ বছর বছর বয়সী এ বীর মুক্তিযোদ্ধা জানান, সেদিন দুপুর ১টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত যুদ্ধ করি। একপর্যায়ে গেরিলা কমান্ডার গুলিবিদ্ধ হাসান জামানের নির্দেশে আমি ও মোস্তফা পিছিয়ে আসি। পাকিস্তানি  সেনারা আমাদের কয়েক গজ দূরে, ওরা আমাদের জীবিত ধরার জন্য ছুটে আসছে। আমরা গুলি ফুরিয়ে যাওয়ায় অস্ত্র ফেলে দৌড়ে একটি আখখেতে ঢুকে পড়লাম। শুরু হলো বৃষ্টির মতো গুলি।

আমরা খেতের আড়াল দিয়ে পালাতে লাগলাম। হঠাৎ দেখি আমার বাম পায়ের হাঁটুতে বাঁশের গোঁজ ঢুকে আছে। সেখান থেকে প্রচুর রক্তক্ষরণ হচ্ছে। আমি গোঁজ বের করলেও রক্তক্ষরণ থামাতে পারলাম না।
প্রচুর রক্তক্ষরণে দুর্বল হওয়ার কারণে আমাকে চিকিৎসার জন্য কৃষ্ণনগরে ভারতীয় সেনাবাহিনীর ক্যাম্পে পাঠানো হয়েছিল। হাঁটুর ব্যথায় এখনও কষ্ট পাই। তবে এর চেয়ে বেশি কষ্ট ওইদিন সম্মুখ সমর  থেকে না ফেরা সহযোদ্ধা ৮ সাহসী বীর মুক্তিযোদ্ধার জন্য। যা আজও আমি ভুলতে পারিনি।
বীর মুক্তিযোদ্ধা আলী আজগর ফটিক স্মৃতিচারণ করে বলেন, ওইদিন পাক সৈন্যরা ওই ৮ জনকে নির্মমভাবে হত্যা করেই ক্ষান্ত হয়নি, তারা তাদের লাশ জোরপূর্বক বাগোয়ান গ্রামের লাল চাঁদের গরুর গাড়িতে ঠাসাঠাসি করে তুলে সন্ধ্যায় জগন্নাথপুর গ্রামে নিয়ে আসে। সারারাত একজন চৌকিদার লাশগুলো পাহারা দেন। পরদিন শুক্রবার সারাদিন ওই গরুর গাড়িতে করেই লাশগুলো আশপাশের গ্রামের মানুষজনকে দেখানো হয়। সেই সঙ্গে তাদেরকে হুঁশিয়ার করে বলা হয়, ‘কেউ  যেন তাদের জোয়ান ছেলেকে যুদ্ধে না পাঠায়, পাঠালে তাদেরও এই দশা হবে।’
গেরিলাযোদ্ধা আলী আজগর ফটিক কান্নায় ভেঙে পড়ে বলেন, শনিবার জগন্নাথপুর গ্রামের মসজিদের ইমাম সাহেবের অনুরোধে পাক সেনারা আমার বন্ধুদের লাশ দাফনে রাজি হয়। সকাল ১০টার দিকে তাদের লাশ ওই গ্রামের কিতাব হালসোনার মাঠের জমিতে নামানো হয়। এরপর গ্রামবাসীদের পাশাপাশি দুটি গর্ত খুঁড়ে প্রতি গর্তে ৪টি করে লাশ মাটিচাপা দিতে বাধ্য করা হয়।
মুক্তিযোদ্ধা আলী আজগর ফটিক জানান, দেশ স্বাধীনের পর ৮ জন বীর শহীদের কবর পাকা করা হয়। পরবর্তীতে এলজিইডি ওই স্থানে স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করেছে। বর্তমান সরকারের আমলে চুয়াডাঙ্গা-১ আসনের সংসদ সদস্য বীর মুক্তিযোদ্ধা সোলায়মান হক  জোয়ার্দ্দার ছেলুনের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় ওখানে স্মৃতি কমপ্লেক্স নির্মিত হয়েছে। প্রতিবছর ৫ আগস্ট দিনটিকে স্থানীয় শহীদ দিবস হিসেবে পালন করা হয়।

×